অর্থমন্ত্রীর নয়া জ্ঞানদান
মাননীয় অর্থমন্ত্রী আপনি যথার্থই বলেছেন দেশের সবচেয়ে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী জ্ঞানের অভাবে আন্দোলন করছে। তাদের জ্ঞান এতই কম যে রাতারাতি একজন সচিব মর্যাদার অধ্যাপককে যুগ্ম সচিবের মর্যাদায় নামিয়ে এনেছেন সেটা তারা বুঝতে অনেক সময় নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্যকে দাবড়ে বেড়াবেন একজন অতিরিক্ত সচিব। সেটাও তারা সময়মতো বুঝতে পারেননি। শিক্ষকদের জ্ঞানের অভাব না থাকলে মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আমলাদের সঙ্গে লড়বেন কেন? আর আপনি যে আমলাতন্ত্রের ফসল সেটাই বা তারা জানবে কোত্থেকে। তারাতো মূর্খ। তারা রাবিশ।
মিস্টার আবুল মাল আবদুল মুহিত আমরা জানি আপনি জ্ঞানী। আপনি ছাত্রজীবনে মেধাবী ছিলেন। ১৯৫১ সালে সারা প্রদেশে আইএ পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ (অনার্স) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম এবং ১৯৫৫ সালে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এমএ পাস করেন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমপিএ ডিগ্রিও নিয়েছেন। আপনার মতো কয়েকশ মেধাবী মানুষ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক। ওই শিক্ষকরা মাস্টারি ছেড়ে দিয়ে আমলাতন্ত্রে যোগ দিয়ে জি হুজুর জি হুজুর করা শুরু করলে তাদের অনেকেই আপনার মতোই স্বৈরাচারের বা গণতন্ত্রের মন্ত্রী হতেই পারতেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরাই শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এটাই হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। তাঁরা অন্য যেকোনো পেশায় যোগ দিলে উন্নতির চরমে পৌঁছাতে পারতেন। যেমনটি পৌঁছেছেন আপনি। শিক্ষকতাকে একটি মহৎ পেশা মনে করেন বলেই সব বাদ দিয়ে একজন দরিদ্র বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে নিজেকে তৈরি করেছেন।
মাননীয় অর্থমন্ত্রী আপনি আপনার মেধা আমলাতন্ত্রে কাজে লাগিয়েছেন। জাতিকে কী দিতে পেরেছেন সে হিসেব ইতিহাস বিচার করবে। আপনার সময়ে কোনো কোনো মেধাবী দরিদ্র শিক্ষক হতে চাননি, সুন্দরী পাত্রীর লোভ হোক আর ‘উজ্জ্বল’ ভবিষ্যতের নেশায়ই হোক শিক্ষকতার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমলাতন্ত্রকে বেছে নিয়েছিলেন পেশা হিসেবে। সবশেষ পর্যন্ত সচিব হয়েছিলেন। আইয়ুব খানকে স্যার ডেকেছেন। ইয়াহিয়াকে স্যার ডেকেছেন। জেনারেল জিয়াকে স্যার ডেকেছেন। আপনার জ্ঞানের মাত্রা একটু বেশি ছিল বলে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক আইন জারির সঙ্গে সঙ্গেই আপনাকে ডেকে নিয়েছেন। সব সামরিক জান্তাকে সেবা দিয়েছেন এরশাদকে কেন নয়? এরশাদ আপনাকে মন্ত্রীই বানিয়ে দিল। স্যার স্যার ডেকে ডেকেই আপনার জীবন গেল। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আপনার কেন ভালো লাগবে? তাদেরকে সবাই স্যার ডাকে। আপনার গায়েতো লাগবেই।
মাননীয় মন্ত্রী আপনি বলছেন “শিক্ষকদের করাপ্ট প্রাকটিস নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।” তারা কি সবাই করাপ্ট? পাইকারি বলে দিলেন? সাংবাদিকরা জানতে চাইলো তাদের করাপশনের উদাহরণ দেন। বললেন, “যেমন প্রত্যেকটি শিক্ষক প্রফেসর হয়। অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, প্রফেসর (পদে) তাদের ইচ্ছেমত প্রমোশন দেয়। অসংখ্য প্রফেসর হয়েছে দেশে। প্রফেসর, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ও লেকচারার। এদের মধ্যে লেকচারার সবচেয়ে কম। নিচে ১০ জন হলে উপরে এক হাজার। এটা কোনো সার্ভিস হল? শুধু উপরে পদোন্নতি হবে। এটা ঠিক করা দরকার।”
এটা ঠিক করবেন ভালো কথা। সবকিছুই যখন নিয়ন্ত্রণ করছেন শিক্ষকদের কেন নয়? তারাতো এরই মধ্যে আপনাদের নিয়ন্ত্রণে। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। আপনার বর্তমান দলের প্রতি আনুগত্য নেই এমন উপাচার্য কী বানিয়েছেন কাউকে? পদোন্নতি নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলছেন সেটা করেন। তার আগে যেসব নীতিমালার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদোন্নতি হয়ে থাকে; সেগুলো একটু পড়ে দেখবেন! বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এসব পদোন্নতি অনুমোদন কেন করে সেটাও খতিয়ে দেখবেন নিশ্চয়ই। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ নিয়েও মাঝে মাঝে দুর্নীতি হয় শুনি। আপনার দলের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত কতোজনকে নিয়োগ দিতে চাপ দেওয়া হয়েছে সে ব্যাপারে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করবেন আশা করি।
অর্থমন্ত্রী সাহেব আপনি বললেন শিক্ষকদের কোথায় মর্যাদার হানি হয়েছে তা আপনার জানা নেই। আপনি জানবেন কী করে? আমলারা না বললেতো কিছুই জানেন না দেখি! এদেশে যে দু টাকায় চকলেট পাওয়া যায় সেটাও আপনার জানা ছিল না। তাই এক টাকা দুই টাকা উঠিয়ে দিতে ৩০০ কোটি টাকা খরচ করতে চেয়েছিলেন। শিক্ষকরা দুর্নীতি করে সেটা আপনি জানেন, আপনি আরো জানেন হলমার্ক ৪ হাজার কোটি টাকা চুরি করলেও দেশের অর্থনীতিতে কোনো প্রভাব পরে না। আপনি এটাও জানেন দেশের শেয়ার বাজার লুটেপুটে খাওয়ার পরও দেশের কোনো ক্ষতি হবে না। আর বিসমিল্লাহ গ্রুপের হরিলুট বা বেসিক ব্যাংকের হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি কোনো ব্যাপারই না। আপনি শুধু জানেন না সপ্তম বেতন কাঠামোতে বেসামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে সচিব, সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে মেজর জেনারেল এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেকশন গ্রেডের অধ্যাপক সর্বোচ্চ গ্রেডে (গ্রেড-১) ছিলেন। আর জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকরা গ্রেড-২ এবং অধ্যাপকরা গ্রেড-৩ এ বেতন পেয়ে আসছিলেন। অষ্টম বেতন কাঠামোতে অধ্যাপক ও জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের অবস্থান ঠিক থাকলেও সিলেকশন গ্রেডের অধ্যাপকদের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়নি, যা নিয়ে শিক্ষকরা আন্দোলন চালিয়ে আসছেন।
মাননীয় অর্থমন্ত্রী আপনার কথায় শুধু শিক্ষকরাই নয় সরকারি কর্মচারিদেরও কষ্ট পাওয়ার কথা। আপনি বলেছেন “ প্রায়ই বলা হয়, সরকারি চাকুরেদের বেতন কম, এজন্য তারা একটু ঘুষ টুস খায়, যাতে এই জিনিসটা চলে যায়…। আশা করছি এখন সরকারি চাকুরেরা বেতন কম এই অভিযোগ আর করতে পারবে না।”
সরকারি কর্মচারিরা ঘুষ খায় বলে তাদের বেতন বাড়িয়েছেন। একথা বলার পরেও তারা চুপ মেরে আছেন। জি হুজুররা সব সময় চুপটি মেরেই থাকেন। আপনি অনেকদিন সরকারি কর্মচারি ছিলেন। আপনার বিরুদ্ধে ঘুষ খাওয়ার অভিযোগ নেই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের যে ঢালাওভাবে বলে দিলেন তারা জ্ঞানের অভাবে আন্দোলন করছে এবং সব সরকারি কর্মচারি ঘুষ খায়, এখন কেউ যদি বলে রাজনীতিবিদরা দুর্নীতিবাজ, তার মানে কী আপনিও দুর্নীতি করেন? এই যুক্তি কি আপনি মানবেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী। তবে আপনার সহকর্মী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কথাটা উড়িয়ে দিয়েন না। সরকারি কর্মচারিদের উদ্দেশে যেমনটি তিনি বলেছেন ‘‘বেতন যেমন দ্বিগুণ হয়েছে, আপনাদের সেবা যেন চার গুণ হয়, আমরা তাই আশা করি। তবে ঘুষের পরিমাণ যেন চারগুণ না হয়।’’
মাননীয় জ্ঞানী মন্ত্রী শিক্ষকদের সম্পর্কে যখন আপনার এমনই ধারণা তাহলে ওইসব শিক্ষকদের দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন কেন? সব জায়গায়ইতো দলীয় লোক বসিয়ে দিয়েছেন। দলের নেতাদের সেখানে বসিয়ে দেন। নয়তো দেশের সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক যেমন একজন করে সেনা কর্মকর্তা তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপ সচিব, যুগ্ম সচিব বা ব্রিগেডিয়ার মর্যাদার কর্মকর্তাদের বসিয়ে দেন। এর উপরের কাউকে আবার ভুলে বসিয়ে দিয়েন না। কারণ আপনার পে স্কেল অনুযায়ী অধ্যাপকরা যুগ্ম সচিবের উপরে নন। যদি তা না পারেন তাহলে এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধই করে দেন। কী দরকার মূর্খ দুর্নীতিবাজ শিক্ষকদের দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর। দেশের ৩৭ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যলয়ের কয়েকটিকে অনায়াশে ক্যান্টনমেন্ট বানাতে পারেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সচিবালয়ের এক্সটেনশন বানাতে পারেন। হলগুলোকে সরকারি কর্মচারিদের আবাসিক স্থান করে দেন। শিক্ষকদের বাসাগুলো আমলাদের নামে বরাদ্দ দেন।
রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য পণ্ডিতের যে দরকার নাই সেটাতো এখন প্রতিষ্ঠিত। জি স্যার জি স্যার আর লেফট রাইট যদি খুশি থাকে তাহলেইতো চলে। সেখানে শিক্ষকদের দরকারটা কী? জ্ঞানহীন শিক্ষকেরাতো মূর্খ ছাত্রই তৈরি করবে। যে শিক্ষকেরা আপনাকেও তৈরি করেছে। দেশে সেই শিক্ষকের আদৌ দরকার আছে কিনা শুধু আপনার কনিষ্ঠপুত্রকে একটু জিজ্ঞেস করে নিবেন প্লিজ! কারণ তিনিও একজন শিক্ষক।
এইচআর/এমএস