বৃষ্টির জলে ধুয়ে যায় চোখের জল


প্রকাশিত: ০৬:৩৪ এএম, ৩১ আগস্ট ২০১৫

বৃষ্টি আমার ভীষণ প্রিয়। সেই শৈশবে বৃষ্টি নামলেই ছুটে যেতাম বাইরে। বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল নিয়ে হুটোপুটি। বাসায় ফিরে মায়ের বকুনি। কিন্তু বৃষ্টিতে ভেজা বন্ধ হয়নি কখনো। আজ জানলাম বৃষ্টিটা তাঁরও নাকি ভীষণ প্রিয়। কিন্তু বৃষ্টি-বিলাসতো তাকে করতে দেখলাম না! বরং উল্টোটাই চোখে পড়লো। বড় কষ্ট বুকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজলেন। নিস্তব্ধ-নির্বাক হয়ে অভিমানে ভিজেছেন অঝোর ধারার বৃষ্টিতে। সেকি লজ্জা আর ঘৃণা ভর করে ছিলো তার চোখেমুখে! পাশেই ছাতা মাথায় ভিড় করে দাঁড়িয়েছিলেন অন্য শিক্ষকরা।  আর জাফর ইকবালের চোখের জল আড়াল হয়ে যাচ্ছিলো বৃষ্টির জলে। যেন প্রকৃতিও ধুয়েমুছে দিতে চাইছিলো মানুষ গড়ার একজন কারিগরের সব কষ্ট; সব অভিমান।

এই একটি মানুষ- জাফর ইকবাল। ভীষণ রকমের বিজ্ঞানমনস্ক মানুষটি কল্পনার জগতেও ঘুরে বেড়ান সমানভাবে। তাই বলে বাস্তবতা ভুলে যাননি কখনোই। মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম আর দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা তার অসীম। সুযোগ ছিলো অনেক। কিন্তু পড়ে আছেন দেশের এক কোণে। পড়ে আছেন মানুষ গড়ার স্বপ্ন বুকে নিয়ে। ভয়ডরহীন থেকেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন সবসময়।

বিজ্ঞান শিক্ষায় শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম সব সময়ই ছিলো। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই মাঝেমধ্যেই অশান্ত হয়ে উঠেছে এই বিদ্যাপীঠ। গেলো এপ্রিল থেকেই চলছে এখনকার সমস্যাটি। নির্দিষ্ট করে বললেন ১২ এপ্রিল থেকে। কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে ওই দিন থেকে ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ’ ব্যানারে আন্দোলনে আছেন শিক্ষকদের একটি অংশ। আগেও দেখেছি, এই বিশ্ববিদ্যালয়টির ন্যায়সঙ্গত যেকোনো আন্দোলনেই আছেন জাফর ইকবাল স্যার। কখনো সামনে থেকে, কখনোবা পাশে দাঁড়িয়ে সমর্থন দিয়ে।

জাফর ইকবাল এই আন্দোলনে আছেন কি নেই- সেটা বড় কথা নয়। মূল কথা আন্দোলন। যে কারোরই প্রধান চিন্তা শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ। কিন্তু শাহজালালের বর্তমান উপাচার্য- যার বিরুদ্ধে আন্দোলনে শিক্ষকদের একটি অংশ, তিনি কি সেই চেষ্টা করেছেন? তার অনুসারী কিংবা সহযোগীরা কি সেই পথ রেখেছেন? উল্টো আন্দোলনকে বিশ্ববিদ্যালয় অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা হিসেবে আখ্যা দিয়ে সরকারসমর্থক শিক্ষকদের একটি অংশ ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্ত চিন্তার চর্চায় ঐক্যবদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ’ ব্যানারে উপাচার্যের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। পাশাপাশি আন্দোলনরত শিক্ষকদের আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ানোর দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে আন্দোলন করছে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। ফলাফলটা কি হলো?

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরিচয়টি ভুলে গিয়ে কিছু শিক্ষার্থী হয়ে গেলো ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ হয়েই তারা হাত তুললো শিক্ষকদের গায়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক যে উপাচার্য তার সামনেই শিক্ষকদের সঙ্গে রীতিমতো গুন্ডামি করতে দেখলাম আমরা। উপাচার্যের কার্যালয়ে যাওয়ার পথ তৈরি করে দিতে আন্দোলনরত শিক্ষকদের ব্যানার কেড়ে নিলো তারা। গলাধাক্কা, এমনকি মারধর করেও সরিয়ে দেয়া হয় তাদের। সেই ফাঁকে নিজের কার্যালয়ে ঢুকে যান উপাচার্য আমিনুল হক ভূঁইয়া। ছাত্রলীগ কর্মিদের ধাক্কায় মাটিতে পড়ে যান অধ্যাপক ইয়াসমিন হক। ওই সময় আরেক কর্মিকে দেখা যায় এক শিক্ষকের গায়ে লাথি মারতে। অন্তত সাতজন শিক্ষক আহত হয়েছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যম খবর দিয়েছে।

প্রশ্ন হলো কাকে লাথি মারলো ওই ছাত্রলীগ কর্মি? যে মানুষটা তাকে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য গড়ে তোলার দায়িত্ব নিয়েছেন, তাকেই? সন্তানকেতো তার জন্মদাতা কেবল মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করে দেয়। কিন্তু শিক্ষক? সেতো ওই সন্তানকে গড়ে তোলে মানুষ হিসেবে। জন্মদাতার চেয়েওতো বড় কাজটি করে দিচ্ছেন আমাদের শিক্ষকরা। সেই শিক্ষককেও ছাড়লো না ছাত্রলীগ?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি শুনেছেন এই খবর? আপনি কি দেখেছেন এই ঘটনার স্থির কিংবা ভিডিওচিত্র? না দেখে থাকলে একবার দেখুন দয়া করে। আপনার প্রিয় সংগঠনের নেতাকর্মিদের আজ কি হাল! মায়ের পেটের শিশু থেকে শিক্ষক: ছাত্রলীগ আর কত লজ্জা দেবে এই জাতিকে। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া ছাত্রলীগ। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে নিয়ে এই ছাত্রলীগই দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলো! সংগ্রাম করেছিলো সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে!
জাফর ইকবাল স্যার যথার্থই বলেছেন। যে `জয় বাংলা` স্লোগান দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো, স্বাধীন হয়েছিলো এই দেশ; সেই স্লোগানের এতবড় অপমান শুধু জাফর ইকবাল কেন, আর কেউ কখনো দেখেছে কি? `জয় বাংলা` স্লোগান দিয়ে শিক্ষকদের উপর হামলা! `জয় বাংলা` স্লোগান দিয়ে শিক্ষককে গলা ধাক্কা, লাথি! ক্ষোভে অভিমানে তাইতো জাফর ইকবালের মতো মানুষদের গলায় দড়ি দিয়ে মরে যেতে ইচ্ছে করে।

ছাত্রলীগ নেতারা প্রায়ই বলেন, `ছাত্রলীগের ইতিহাস বাংলাদেশের ইতিহাস`। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পক্ষে গুন্ডামির নামে শিক্ষকদের পেটানোও নিশ্চয়ই ইতিহাস হয়েই থাকবে। এই ছাত্রলীগ কখনো রাজপথে আন্দোলন করেনি। কারণ বহুদিন ধরেই যে রাজপথ তাদের দখলে। এই ছাত্রলীগ কখনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করেনি। কারণ একের পর এক অন্যায় যে কেবল তারাই করছে। সত্যি কথা বলতে কি, এই ছাত্রলীগ কোনোদিনই বঙ্গবন্ধুকে অন্তরে ধারণ করেনি। এরা শুধু জানে গুন্ডামি। তাইতো নতুন অভিজ্ঞতা হলো জাফর ইকবাল স্যারদের। রোববার যা দেখলেন, জাফর ইকবালের মতো এমন কল্পনাপ্রবণ মানুষও তা কখনো কল্পনা করতে পারেননি। সে কারণেই `তীব্র মানসিক যন্ত্রণা` কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে জাফর ইকবাল স্যারকে। এই যন্ত্রণার সমান ভাগীদার পুরো শিক্ষক সমাজ।

এই ছাত্রলীগকে শাসন করার মতো কেউ কি নেই! যাদের উপর ছাত্রলীগকে দেখভালের দায়িত্ব- তারা কি এগুলো দেখছেন না? নাকি তাদেরও প্রশ্রয় আছে এসবে? কয়েকদিন আগেই একই রাতে ক্রসফায়ারে মারা গেলো ছাত্রলীগের দুই নেতাকর্মি। বিনা বিচারে মৃত্যু সমর্থন করা যায় না কখনোই। কিন্তু নিজেদের সংগঠনের দুইজন মারা যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতাই সুনির্দিষ্টভাবে ওই দুইটি ক্রসফায়ারের সমালোচনা করেছেন। হয়েছেন ক্ষুব্ধ। অবশ্য সবসময় প্রচারের আলোয় থাকায় কয়েকজন নেতা-মন্ত্রী বলেছেন, `অ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে`। ছাত্রলীগকে সতর্ক করে দেয়ার জন্যই কি তারা এমন মন্তব্য করেছেন? আপনাদের ছাত্রলীগ কি সতর্ক হয়েছে? সতর্ক হয়ে থাকলে শাহজালালে এভাবে অপমানিত হতেন না শিক্ষকরা।

আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা আবার ছাত্রলীগকে দায় থেকে মুক্তি দিতে `হাইব্রিড ছাত্রলীগ` কিংবা `ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারী` শব্দগুলো ব্যবহার করছেন।অনুপ্রবেশকারীর দোহাই দিয়ে আর কতদিন? ছাত্রলীগের সাবেক কিংবা বর্তমান যেসব নেতাকর্মি সত্যিকার অর্থেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে নিয়েছে, তাদের আজ বড় বেশি লাগছে। বুকের ঠিক কোথায় লাগছে- তা না বোঝার কোনো কারণ নেই। কিন্তু সব জেনেও, সব বুঝেও নিশ্চুপ ছাত্রলীগের অভিভাবকরা। তাইতো এতো বেপরোয়া হয় ছাত্রলীগ। তাইতো ছাত্রলীগের গলাধাক্কা খেতে হয় শিক্ষককে। তাইতো অভিমানী শিক্ষকের চোখের জল ধুয়ে যায় বৃষ্টির জলে। এই ছাত্রলীগ আমরা চাই না।

লেখক : বার্তা সম্পাদক, এসএটিভি
[email protected]

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।