সুমাইয়া শিমুর ‘স্বামী’ ও অন্যদের ‘বিকৃতি’


প্রকাশিত: ১১:১৩ এএম, ৩০ আগস্ট ২০১৫

অন্যের ব্যক্তিগত জীবনে অবৈধ অনুপ্রবেশ রীতিমতো আমাদের অভ্যেসে পরিণত। সেই অনুপ্রবেশ কতটা নৈতিক-অনৈতিক, উচিত-অনুচিত, শালীন-অশালীন, সভ্য-অসভ্য তার ন্যূনতম সীমারেখাটিও বোধহয় জানা নেই আমাদের। কিংবা জানলেও, না জানার ভান করে, না মানার দুর্নিবার পণ করে অনেকটা জোর করে ঢুকে পড়ি আমরা। এই অবস্থাটি সুস্থতা নয়, অসুস্থতা। বিকৃতি অনেকটা। একটা রোগের কথা বলি, নাম ‘ভয়োরিজম’। মনোব্যাধি। রোগী গোপনে গোপনে বা আড়াল থেকে অন্যের রতিক্রিয়া দেখে পুলক লাভ করে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমাদের অবস্থা অনেকটা ভয়োরিজমের বিকারগ্রস্তদের মতো। যখন-তখন, যার-তার শয্যাকক্ষে ঢুকে যেতে, দুর্নিবার আকর্ষণ বোধকরি।

তাই যদি না হবে, তবে সুমাইয়া শিমু কাকে বিয়ে করল কী করল না, সেই লোক কালো কী ফর্সা, লম্বা কী বেটে, মোটা কী চিকন, ভূড়ি আছে কী  নেই- তা নিয়ে এত মাথাব্যথা হবে কেন? ফেসবুকের পাতাজুড়ে আজকাল যা হচ্ছে তাকে আপনি কী বলবেন? একটা অসভ্যতার চারণ ভূমি। যে কেউ, যে কারও সম্পর্কে, যেকোনো মন্তব্য ফেসবুকে ছুড়ে দিয়ে আমরা বেশ পুলকবোধ করি। এই মন্তব্যে কারো সামাজিক সম্মান, আর্থিক, মানসিক, শারীরিক ক্ষতি ও ঝুঁকির কারণ হচ্ছে কিনা তা ভাববার বিন্দুমাত্র প্রয়োজনবোধ করি না।

সুমাইয়া শিমুর বিয়ে নিয়ে ফেসবুকে তোলপাড়। মন্তব্যে যে বিষয়গুলো এসেছে সেগুলো অনেকটা এরকম ১. এত কালো লোকটিকে কেন বিয়ে করেছেন শিমু? ২. শিমু এত দেরিতে বিয়ে করলেন! তবে কী এতদিন তার কারও সঙ্গে ‘কিছু’ ছিল না? ৩. শিমুর এই বিয়ে টিকবে না, তারকাদের বিয়ে টেকে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। খুব প্রচলিত যুক্তি।
 
আমার কথা হলো, মানুষকে আমরা কি দিয়ে বিচার করি? অর্থ, প্রতিপত্তি, ক্ষমতা, গায়ের রং? এর যেকোনো একটিও যদি মানুষকে সম্মানের, মর্যাদার, মূল্যায়নের মাপকাঠি হয়ে থাকে তবে দুঃখজনক। সে নারীই হোক, হোক পুরুষ। কালো কিংবা ফর্সা কোনোটি হওয়াই কোনো অযোগ্যতা যেমন নয়, নয় যোগ্যতাও। বিষয়টি প্রাকৃতিক। আবার এমনও তো হতে পারে শিমুর একটু ‘ডার্ক’, ‘ব্ল্যাক’ পুরুষ পছন্দ। পছন্দতো যার যার, আমার যেমন কালো, ফর্সা দুই রঙের নারীদেরই ভালো লাগে। আসলে রং বিষয় নয়, বিষয় ব্যক্তিত্ব, রুচি, সংস্কৃতি, বোঝাপড়া। আমরা এখনও সৌন্দর্য্যের ক্ষেত্রে বৃটিশ ঔপনিবেশিক ‘কনসেপ্ট’ মস্তিষ্কের নিউরনে বিল্ট-ইন করে বসে আছি। যত কথাই বলি, শেষ পর্যন্ত আমরা কুৎসিত বর্ণবাদী।

একজন লোক, কখন বিয়ে করবেন কিংবা আদৌ করবেন কিনা বা বিয়ে যদি কোনোদিনই না করেন সেটি তার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। বিয়ে না করলে বা দেরিতে বিয়ে করলেই যে কারও সঙ্গে তার কোনো ‘কিছু’ জাতীয় যৌন ইঙ্গিত তা বড় অশ্লীল। আর কারও সঙ্গে যদি কারও বিবাহপূর্ব সম্পর্ক থেকেই থাকে তাহলে সেটি যৌন না অযৌন তা ভেবে ভেবে আমি আপনি কেন পুলকিত? সম্পর্কটি তো আমার নয়, অন্যের।

তারকাদের বিয়ে ভেঙে যায়, এমন মন্তব্য করেছেন অনেকেই। বিয়ে ভাঙা বা ডিভোর্সের সঙ্গে তারকা, অতারকার কোন সম্পর্ক নেই। তারকাদের যে কোন খবর প্রচার হয় বেশি, অতারকা বা আম জনতার হয় না, এটাই স্বাভাবিক। আসল কথা হচ্ছে জীবনে ভালো থাকা, সুস্থ থাকা, সুখবোধ করা। সেটি বিয়ে করে হতে পারে, বিয়ে না করে হতে পারে, ডিভোর্স নিয়ে হতে পারে, ডিভোর্স না নিয়ে হতে পারে।

একটি কথা আমি প্রায়ই বলি, কখনো কখনো একত্রবাস; দুঃসহবাসও হতে পারে। কখনো ভালো থাকার জন্য গড়তে হয় সম্পর্ক, কখনো সম্পর্ক ভেঙেও ভালো থাকে লোকে। সে যাই হোক, আপনি আমি কেন একজন নবদম্পতি সম্পর্কে এমন মন্তব্য করছি? যারা সুমাইয়া শিমুর স্বামীকে নিয়ে কুমন্তব্য, বিষোদগার, অশ্লীল মন্তব্য করেছেন, করছেন তাদের কারও কারও শিমুর প্রতি কোনো ‘বাসনা’ ছিল কিনা তা জানা নেই।

আগেও দেখেছি, রেলমন্ত্রীর বিয়ে নিয়ে রস রসিকতার শেষ নেই। ভদ্রলোক ‘পারবেন’, কি ‘পারবেন না’, ‘ভায়াগ্রা’ প্রয়োজন হবে কি হবে না, এমন অশ্লীল মন্তব্য করতেও ছাড়িনি আমরা। আসিফ নজরুল কিভাবে ‘কচি’ শীলাকে বিয়ে  করলেন? এটা আসিফের কততম বিয়ে? এমন মন্তব্যে ছিল ফেসবুকে ছড়াছড়ি। অথচ শীলা-আসিফ দুজনই প্রাপ্তবয়স্ক। তারা তাদের মতো বিয়ে, ডিভোর্স যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এই সিদ্ধান্ত একান্তই ব্যক্তির নিজস্ব।

জীবন যার, জীবনের সিদ্ধান্তও তার। বাইরে থেকে আর যাই বোঝা যায়, জীবন বোঝা যায় না কখনো। তাই বাইরে থেকে অন্যের জীবন সম্পর্কে, দাম্পত্য সম্পর্কে, যৌন জীবন সম্পর্কে মন্তব্য করা অন্যায়। আমাদের ন্যায় অন্যায়ের বোধ দিন দিন ভোতা হচ্ছে, ভোতা হতে হতে প্রায় বিলপ্তির পথে, বোঝা যায় চারপাশ দেখলেই । নৈতিকতা তলানিতে এসে ঠেকেছে। অশিক্ষা, অসভ্যতা, অশ্লীলতা, ইতরামো দিনকে দিন সীমাহীন। যতদিন এই দুঃশ্চরিত্রতা থেকে নিজেদের সংশোধন না করব, যতই কেতা দুরস্ত হই, নেট-ট্যাব ব্যবহার করি, চকচকে জুতো ঘড়ি স্যুট টাই, শাড়ি-চুড়ি পরি, অ্যালিয়ন-প্রিমিও চড়ি, বিদেশ যাই, শপিং করি, সেমিনারে বক্তৃতা দেই, থেকে যাব অসভ্যই!

লেখক : সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম এন্ড কমিউনিকেশন। সম্পাদক, সাপ্তাহিক কাগজ ও মিডিয়াওয়াচ।

[email protected]


এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।