চকবাজার অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করালো

অঘোর মন্ডল
অঘোর মন্ডল অঘোর মন্ডল , এডিটর, দীপ্ত টিভি
প্রকাশিত: ১২:২৪ পিএম, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

মানুষ সৃষ্ট এক একটা বিপর্যয়। অজস্র প্রাণহানি। তারপর আর্তনাদ। আহাজারি। তারপর সরকারের পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি। বিরোধীদের পক্ষ থেকে সরকারকে দোষারুপ! গণমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোকার্ত মানুষের বিলাপ। প্রলাপ।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রায়ই এরকম রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়াতে হচ্ছে আমাদের। কিছু দিন পর আবার আমরা চলি স্বাভাবিক গতিতে। আসলে কিছু জীবন হারিয়ে যায়। ফুরিয়ে যায়। কিছু মানুষ জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে বেঁচে থাকে বটে! কিন্তু বাকি মানুষ চলে স্বাভাবিক গতিতে। চকবাজারের বিপর্যয়ের পরও সেই একই চিত্র!

এবারও চকবাজারে ফাগুন এসেছে। এসেছে বসন্ত। সঙ্গে নিয়ে এসেছিল অনেক কিছু। প্রেম দিবস। ভালোবাসা দিবস। গোলাপ দিবস। কিন্তু আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রথম প্রহর এবারের বসন্ত নিয়ে এলো শোকের অন্যরকম বার্তা। চকবাজারে আগুন। কত কিছু পুড়ে ছাই! কত প্রাণহীন দেহ পরিণত হলো অঙ্গারে!

এ ফাগুন দারুণ নয়। এ যেন রুক্ষ বসন্ত। কিন্তু যা হলো তার দায় প্রকৃতির কাঁধে চাপিয়ে আমরা দায় মুক্তি পেতে পারি না। এই দুর্ঘটনার দায় আমাদের। আর এরকম অগ্নিকাণ্ড পুরনো ঢাকায় নতুন কিছু নয়। শুধু পুরনো ঢাকা বলছি কেন?

দেশজুড়ে এরকম দুর্ঘটনাতো ঘটছেই। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে বিলাপ এড়ানোর কত কথা আমরা শুনি টেলিভিশন টকশো-তে। খবরে। কখনো বিশেষজ্ঞের মুখে। কখনো সাধারণ মানুষের কণ্ঠে। কিন্তু এই বলাবলিই সার।

আমাদের মুনাফালোভী মন, বিচার-বুদ্ধিহীন লোলুপ মানসিকতা আর সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মানুষগুলোর উদাসীনতা আমাদের বার বার ঠেলে দিচ্ছে এই বিপর্যয়ের মধ্যে।

চকবাজারের অগ্নিকাণ্ড নিয়ে কত মানুষ কত কথা বলছেন। চক বাজারের খুব কাছে নিমতলী ট্র্যাজেডি নিয়েও কত কথা শুনেছিলাম আমরা। কিন্তু কী দেখলাম! কী পেলাম অবার কিছু পোড়া মানুষ ছাড়া!

আমরা পুড়বো না কেন? আমাদের পড়শি কারা? কীসের সাথে আমাদের বসবাস! উপরে মানুষ। নিচে রাসায়নিক গুদাম। কোথাও উপরে মানুষ পাশে রাবার ফ্যাক্টরি। কোথাও মানুষ আর দাহ্য পদার্থের পাশাপাশি বসবাস। বিস্ফোরণ-অগ্নিকাণ্ড ঘটলে মানুষের পুড়ে অঙ্গার হতে কতক্ষণ? চকবাজারে তাই হলো।

গণমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখনও চলমান বিতর্ক আগুনের এই ভয়াবহতার কারণ গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, নাকি রাসায়নিক গুদামে দাহ্য বস্তুর মজুদ। মন্ত্রী থেকে সাবেক মন্ত্রী একেকজন একেক রকম কথা বলছেন। এক সাবেক শিল্পমন্ত্রী দুষছেন আরেক শিল্পমন্ত্রীকে। কিন্তু তাতে কী আর স্বজন হারানো, সব হারানো মানুষগুলো ফিরে পাবেন কিছু?

এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড আমাদের সামনে অনেকগুলো প্রশ্ন এনে হাজির করলো। কিন্তু আমরা কেউ তার উত্তর খুঁজতে রাজি নই। অতীতেও এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আগ্রহ দেখাইনি। তাই বার বার এই ট্র্যাজেডি। চারশ বছরের পুরোন ঢাকা যেভাবে গড়ে উঠেছিল, একুশ শতকে এসে আজ কী তার সেই রুপটা আমরা ধরে রাখতে পেরেছি? পারিনি। পারার চেষ্টাও করেনি।

ঢাকা অনেক আগে থেকে জনবিস্ফোরণ ঘটছে। আমরা সেই বিস্ফোরণ ঠেকাতে পারিনি। ঠেকানোর উদ্যোগ যেভাবে নেয়া হচ্ছে সেখানেও হাজার রকম জটিলতা। আমলাতান্ত্রিক। সদিচ্ছার অভাব। পাশাপাশি ঢাকা যেভাবে প্রতিদিন বাড়ছে সেটা আরো বিপজ্জনক।

অপরিকল্পিত নগরায়ণের বলি হচ্ছে ঢাকা। যার গায়ে তকমা এঁটে গেছে বসবাসের অনুপোযোগী নগরীর। আর বসবাস অনুপোযোগী নগরীর তালিকায় ঢাকা অনেক উপরের দিকে স্থান করে নিয়েছে। এই অপরিকল্পিত নগরায়ণের দায়টা কার?

ঢাকা বাঁচাও শ্লোগানটা অনেক দিন ধরে শুনছি। কিন্তু বাঁচানোর উদ্যোগ কোথায়? যে বুড়িগঙ্গার পাড়ে গড়ে উঠেছিল ঢাকা, সেই নদীটাই এখন দখলদারদের লোলুপ থাবায় রক্তাক্ত। আর তার পানি সেটাও বিষময়। সেই নদীর পাড়ে থাকা ঢাকা বাণিজ্যিক নগরী। শিল্প নগরী। প্রশাসনিক নগরী। নাকি মানুষের বসবাসের জন্য আবাসিক নগরী তার কোন সঠিক উত্তর আমরা দিতে পারি না।

এই ঢাকাকে নিয়েই আমাদের ব্যবসায়ী, সওদাগর, চাকরিজীবী, আমলা, আইনজীবী, চিকিৎসক সবার প্রীতি। কিন্তু ভুল করেও তাদের মনে কখনো ভয় জাগে না, এই শহর আমাদের সবার চাহিদা মেটাতে পারবে তো! সবাই আমরা ঢাকায় কিছু একটা করতে চাই। ঢাকা ছাড়া ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশের অন্য জায়গার যেন তেমন কোন মূল্য নেই।

আবার সরকারও অন্য জায়গাকে মূল্যহীন করে রাখছে সেটা বললে ভুল হবে না। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ না হলে ঢাকার ওপর থেকে চাপ কমবে না। এই ঢাকা জনভারে আরো ন্যুজ্ব হয়ে পড়বে। কখনো আগুনে পুড়বে। কখনো বাড়ি ধসে বিপর্যস্ত হবে। তারপরও আমরা ঢাকায় থাকার স্বপ্নে বিভোর থাকবো। ঢাকাকে নুতনভাবে সাজানো হবে; এমন স্বপ্নের কথা শুনবো নগরপিতাদের মুখে।

কিন্তু এই ঢাকায় আমরা কে কেন থাকছি তার একটাই উত্তর-ঢাকা রাজধানী শহর। ঢাকায় কিছু না কিছু একটা করে বেঁচে থাকা যাবে। কিন্তু এখানে জীবন সংগ্রামে এসে কত মানুষ লাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছে? আমরা কীভাবে থাকছি, তারচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিলো চকবাজার কাণ্ড; আমরা কে কার প্রতিবেশি হয়ে আছি?

গলির ভেতর কারখানা, দোকান, রাসায়িক দোকানের ভেতর, উপর, নিচে আবার কত মানুষের বসবাস। আমরা কে কার পড়শি? ঢাকার ইতিহাস-ভূগোল-দর্শন-সমাজ চর্চা কিন্তু অন্য কথা বলতো এক সময়।

চকবাজার আবার আমাদের আচমকা অনেক অপ্রিয় প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল। সেখানে দাঁড়িয়ে অপ্রিয় কিন্তু অমোঘ সত্য খুঁজতে অনীহা দেখালে আরো অনেক রূঢ় বসন্ত হয়তো হাজির হবে আমাদের সামনে।

লেখক : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।

এইচআর/আরআইপি

‘চকবাজার আবার আমাদের আচমকা অনেক অপ্রিয় প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল। সেখানে দাঁড়িয়ে অপ্রিয় কিন্তু অমোঘ সত্য খুঁজতে অনীহা দেখালে আরো অনেক রূঢ় বসন্ত হয়তো হাজির হবে আমাদের সামনে।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।