ওদের ‘অপর’ করে রাখা


প্রকাশিত: ০২:১২ এএম, ২২ আগস্ট ২০১৫

রানা দাশ গুপ্ত, একজন বিদগ্ধ আইনজীবী, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। তার যে কোন কথা খুবই গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হবে, এটাই সাধারণ প্রত্যাশা। সেই তিনি যখন অভিযোগ করেন যে, ক্ষমতাসীন দলের ছত্রচ্ছায়ায় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতনের পাশাপাশি সম্পত্তি দখল চলছে, তখন উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘২০১৪ সালে রাজনৈতিক সহিংসতার রেশ কাটতে না কাটতেই সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে দুর্বৃত্তরা আবারো ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর, দোকানপাট, জায়গা-জমি, দেবোত্তর গির্জা ও বিহারের সম্পত্তি জবর দখলের উন্মত্ততায় মেতেছে। সরকারি দলের সাংসদ থেকে শুরু করে মন্ত্রী পরিষদের প্রভাবশালী সদস্যদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছ’।

রানা দাশ গুপ্ত এ কথাগুলো এমন এক সময়ে বলেছেন, যখন দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার একটি সরকার ক্ষমতায়। এবং একথা সবাই স্বীকার করবেন যে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে নিজে এসব অন্যায়, নির্যাতন সহ্য করার মানুষ নন। কিন্তু তারওতো সীমাবদ্ধতা থাকে। কতদিকে নজর দিবেন তিনি যদি দলের মন্ত্রী এমপিদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উত্থাপিত হয়?  
 
রানা দাশ গুপ্ত যা বলেছেন, তাতে একটা কথা পরিষ্কার হয়েছে, অনেক স্থানেই হিন্দুরা খুব অসহায়।  সংখ্যালঘুরাও তাঁদের সংখ্যালঘুত্বের কারণে যেন ‘মরমে মরে’ আছে,  গুটিয়ে থাকে।

দেশভাগের পর যে বিপুলসংখ্যক হিন্দু ভারতের হাতছানি উপেক্ষা করে এ দেশে রয়ে গেলেন, বুঝতে হবে বাংলাদেশই তাদের স্বদেশ। ১৯৭১-এও এরা নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে। স্বাধীন হওয়ার পর তাদের আরো বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে বাংলাদেশই তাদের ভূমি। ১৯৪৭ আর ১৯৭১, এই দু’বারের ঝড়ে অনেক পরিবার খণ্ডিত হয়ে যায়। এক ভাইয়ের পরিবার ওপারেতো, আরেক ভাই এপারে। কখনও দুই যমজ ভাইয়ের একজন এখানে, অন্য জন ভারতে। তাই স্বজনদের জন্য, তাদের সঙ্গে কটা দিন একত্রে কাটানোর জন্য তাদের প্রাণ কাঁদে। তারা ভারতে গেলে সেই আপনজনদের দেখতে পান, তাদের জন্য কিছু করতে মন চায়। এই স্বাভাবিক সৌভাতৃত্বকে অন্য চোখে দেখা হবে কেন? কেন সব হিন্দুকে ‘ভারতীয় চর বা দালাল’ ধরে নেয়া হবে? কেন তাঁদের সন্দেহভাজনদের তালিকায় রাখা হবে এবং সমাজ সেই অনুযায়ী তাদের সঙ্গে আচরণ করবে? কেন তাদের সম্পত্তি দখল করলে মনে করা হবে এমন কোন অন্যায় করা হচ্ছেনা?

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেয়া বাংলাদেশের প্রতিটি কোণ যেমন মুসলমানের ঘরবাড়ি, তেমনি প্রতিটি কোণ হিন্দুর, বা খ্রীষ্টানের, বা বৌদ্ধের। প্রতিটি হিন্দু একজন বাংলাদেশী বাঙালি। এরা শত অনাচার, অত্যাচার এমনকি লোভ পরাভূত করে বাংলাদেশকেই নিজেদের স্বদেশ শিরোধার্য করেছেন। অথচ দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজও এদের সতত দেশপ্রেমের পরীক্ষা দিতে হয়। এই কাল্পনিক সন্দেহ ও তা থেকে উদ্ভূত বিদ্বেষই হিন্দু সংখ্যালঘুদের বাংলাদেশে ‘অপর’ করে রেখেছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নামে সংখ্যালঘু সেই মনস্তত্বেরই প্রকাশ। আজ তার জমি সম্পত্তি যখন আওয়ামীলীগ আমলে দখল হয়ে যায় শাসকদলের নেতাদের দ্বারা, তারা যখন ভয়ে চুপসে থাকে, তখন বুঝতে হবে মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেও ভিতরে-ভিতরে আমরা আসলে একটা কট্টর মুসলিম রাষ্ট্রই চাই। সংখ্যালঘুর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ প্রগতির সবচেয়ে বড় বাধা।

নিরাপত্তার দিক থেকে দেখলে বলতেই হয় এদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ভাল নেই। তাদের ওপর ভয়ভীতি, অত্যাচার-নির্যাতন অব্যাহত আছে। বিশেষ করে, ২০১২ সালের শুরু থেকে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি একাত্তরের মতোই সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে, তাদের ঘরবাড়ি ও উপাসনালয়ে হামলা করেছে। সে সময়ে সরকার, প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের কাছ থেকে যে প্রতিরোধ ও প্রতিকার আশা করেছিলাম, সেটি পাওয়া যায়। আবার এখন যখন পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত তখন শাসক দলের বিরুদ্ধেই সংখ্যালঘুদের জমি ও সম্পত্তি দখলের অভিযোগ। দুঃখজনক যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায় থাকতে সেই দলের সাংসদ ও প্রভাবশালীদের দ্বারা সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর বা সম্পত্তি দখলের ঘটনা ঘটছে।  

আমরা তাদের ভোট-ব্যাংক হিসাবে ভাবছি, ভাবিনি মানুষ হিসেবে, ভাবিনি এদেশের বৈধ নাগরিক হিসেবে। সংবিধান যে ধর্মনিরপেক্ষতার সাধনা করতে বলে, তা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সাধনা, বহুত্বের সাধনা, অভিন্নতা বা একত্বের সাধনা নয়, বহু ধর্ম ও সংস্কৃতিকে খর্ব করার সাধনা নয়। অথচ তাদের জমি সম্পত্তি দখল করে, সাধারণ রাজনৈতিক সংঘাত হলে হিন্দু এলাকায় আক্রমণ করে আমরা এই বার্তাই দেই যে এদেশ কেবল একটিই ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। কারণ আমরা ধরেই নিয়েছি যে ক্রমশ কোণঠাসা করে চললেও, তাদের ধর্মাচরণের স্বাধীনতা খণ্ডন করার চেষ্টা হলেও, তারা মুখ বুজে সব সহ্য করে যাবে, বা তারা দেশ ছেড়ে ওপারে চলে যাবে।

রানা দাশ গুপ্ত বলেছেন পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যারাই ক্ষমতায় এসেছে, তারা সংখ্যালঘুদের প্রতি চরম বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে। ১৯৯০, ১৯৯২ ও ২০০১ সালে সংখ্যালঘুদের ওপর ভয়াবহ হামলা হয়েছে। ২০০১ সালে ক্ষমতার পালাবদলের পর বিএনপির ছত্রচ্ছায়ায় জামায়াতে ইসলামী এ কাজটি করেছে অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে। তাদের যে রাজনৈতিক দর্শন, সেখানে সংখ্যালঘুদের জায়গা নেই। উদ্বেগের বিষয় হলো, সংখ্যালঘুদের ওপর এই যে নির্যাতন চলছে, এর বিচার হচ্ছে না। বলা যায়, দায়মুক্তির সংস্কৃতি চলছে। সরকার বদল হয়, সংখ্যালঘুদের প্রতি রাষ্ট্রের মনোভাব ও আচরণে বিশেষ কোনও পরিবর্তন ঘটেনা, বা ঘটতে দেয়া। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা জানেন, তাদের বন্ধু এবং ভরসা শেখ হাসিনাই। তাহলে তার আমলে তাদের দলের কারো কারো এমন আচরণ কেন?

রানা দাশ গুপ্ত ঠিকই বলেছেন যে, দেশের অরক্ষিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষা ও অধিকার রক্ষায় এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিতে সরকারকে যত দ্রুত সম্ভব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সরকারি দলসহ সব রাজনৈতিক দলকে দুর্বৃত্তায়নের হাত থেকে রক্ষা করতে দৃশ্যমান রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

reja

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।