এবারের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের শপথ

প্রেক্ষাপট-১ :
একজন প্রবীণ চিকিৎসক। এক নামে চেনেন দেশের অনেকেই। নাম আমি উহ্য রাখলেও জানি তাও চিনবেন অনেকেই। এতটাই পরিচিতি তার। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর বদন্যতাতে ঢাকার পাশেই গড়ে তুলেছিলেন বিশাল স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান, যার নামটাও বঙ্গবন্ধুরই দেয়া। ব্যবসার পরিধি প্রসারিত হয়েছে ক্রমাগতই। স্বাস্থ্যের পাশাপাশি এমনকি জুতার ব্যবসায়ও জড়িয়েছেন নিজেকে। ব্যবসা করতে গিয়ে যেমন কিছুই ছাড়েননি, তেমনি ছাড়েননি সাধারণ মানুষের ভিটামাটিও। ইদানীং জানা যাচ্ছে সমৃদ্ধ ওই জনপদের অন্যতম শীর্ষ ভূমিদস্যুও তিনিই।

প্রেক্ষাপট-২ :
আরেকজন প্রবীণ চিকিৎসক। আগের জনের মতো না হলেও যথেষ্টই প্রসিদ্ধ তিনিও। একাত্তরে মেলাঘরের ফিল্ড হাসপাতালে মেডিকেল ছাত্র থাকা অবস্থায় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা প্রদান করেছেন। পরবর্তীতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে নাম-ধাম এবং অর্থ-বিত্ত দুই’ই অর্জন করেছেন। অতি সম্প্রতিও ছিলেন সাবেক প্রধান বিরোধী দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য। ২০০৯ ওই দলটির জাতীয় সম্মেলনে দুজন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর সাথে তার হাস্যোজ্জ্বল ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তা সে সময়ই যথেষ্টই আলোচনার খোরাক যুগিয়েছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে জানা যাচ্ছে এই প্রবীণ চিকিৎসক সম্প্রতি স্বাধীনতার স্বপক্ষীয় একটি রাজনৈতিক দলে যোগদান করেছেন।

উপরে উদাহরণ দুটি পেশার অঙ্গনে আমাদের মেধাশূন্যতা আর মেধার দৈন্যতার পরিচায়ক। পেশাজীবীরা হলেন জাতির বিবেক। জাতির মননে থাকেন তারা, সমৃদ্ধ করেন জাতির মেধাকে। দুর্ভাগ্য আমাদের, আমাদের বিবেকদের বিবেকশূন্যতাই আমাদের সম্বল। ঠিক এইটাই চেয়েছিল ওরা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপ্তি আমাদের বেশিভাগের কাছেই সময়ের হিসাবে নয় মাস মাত্র। আমরা ভুলে যাই এর পেছনে ছিল দীর্ঘ প্রস্তুতি। এর সূচনা ৫২’র ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগারে। ৭১’র ১৬ ডিসেম্বর এর পরিণতি মাত্র। প্রস্তুতি যেমন ছিল আমাদের, ছিল ওদেরও।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অনিবার্য হয়ে পড়লে দেশটিকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার সব আয়োজন সাজানো ছিল পাকিস্তান সরকারের। এ কারণেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পরই তাদের এদেশীয় দোসরদের সংগঠিত করে তারা গড়ে তুলেছিল রাজাকার, আল-বদর আর আল-শামসের মতো মিলিশিয়া বাহিনী একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন পুরোটা সময় এরা দেশের আনাচে-কানাচে পাখির মতো মানুষ মেরেছে। পাক সেনাবাহিনীকে পথ চিনিয়ে নিয়ে গেছে দেশের প্রত্যন্ততম অঞ্চলে। গণহত্যা, গণধর্ষণ আর লুঠতরাজের বিভীষিকা ছড়িয়ে গেছে ঢাকার সীমানা ছাড়িয়ে দুর্গমতম জনপদেও।

এরা শুধু দেশের আপামর মানুষগুলোকে মেরে আর দেশের অবকাঠামোকে গুড়িয়ে দিয়েই খ্যান্ত দেয়নি। এদের লক্ষ্য ছিল দেশের মেরুদণ্ডকে গুঁড়িয়ে দেয়া। বাংলাদেশে ১৯৭১-এ যে গণহত্যা সংঘঠিত হয়েছিল তা গণহত্যার ইতিহাসে অন্যতম বিভৎস। গণহত্যা মানেই নিন্দনীয়, গর্হিত। কোনো গণহত্যাই অন্য কোনো গণহত্যার চেয়ে কম জঘন্য হতে পারে না। এ ধরনের তুলনা বাঞ্ছনীয় নয়। তারপরও বাংলাদেশের গনহত্যার একটি অন্য আঙ্গিক ছিল আর তা হলো বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। আমাদের মনে করার কোনো কারণই নেই যে আল-বদর-রাজাকাররা বিচ্ছিন্নভাবে বুদ্ধিজীবীদের ধরে এনে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল।

একাত্তরের বুদ্ধিজীবী নিধন শুরু হয়েছিল ২৫ শে মার্চের রাতে অপারেশন সার্চলাইটের মধ্যদিয়ে। আর না জানলে জেনে রাখুন পৃথিবীর দ্বিতীয় আর কোনো রাষ্ট্রের সরকারি ক্যালেন্ডারে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস বলে কোনো দিবসের উল্লেখ নেই। সেদিন রাতেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর ঝাপিয়ে পড়েছিল উন্মত্ত বিভৎসতায়। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড শুধু যেমন ১৪-১৫ ডিসেম্বরে সীমাবদ্ধ ছিল না তেমনি এর ব্যাপ্তিও ছিল ঢাকার সীমানা ছাড়িয়ে দেশের প্রতিটি জনপদে। এদেশের প্রতিটি বসতিতে আছে এক বা একাধিক গণকবর যেখানে সাধারণের সাথে শায়িত আছেন তারাও যারা ছিলেন ওই জনপদের মুক্তচিন্তার ধারক ও বাহক, ছিলেন ওই জনপদগুলোর বিবেক।

মুক্তিযুদ্ধের পর পাওয়া গিয়েছিল পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলির ডায়েরি। একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মূল খলনায়ক এই সেনা কর্মকর্তা। তার ডায়েরির পাতায়-পাতায়, তারিখে-তারিখে তালিকাবদ্ধ ছিল অসংখ্য বাঙালি বুদ্ধিজীবীর নাম। একাত্তরে আমরা হারিয়েছি শহীদ মুনির চৌধুরীকে, আর ১৬ ডিসেম্বর না হয়ে যদি হতো ১৭ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস তাহলে আমরা হারাতাম জাতীয় অধ্যাপক কবির চৌধুরীকেও। এমনই সিস্টেমিক বুদ্ধিজীবী নিধনে মেতেছিল পাক সেনাবাহিনী আর তাদের দোসররা একাত্তরে নয়টি মাসে।

এবার ওদের অর্জন দেখুন। জাতি যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের দ্বারপ্রান্তে তখনও কত বিভক্তি, বিভ্রান্তিই না কত। মুক্তিযুদ্ধের বহ্নিশিখা যাদের হৃদয়ে তাদের ক্ষমতার যখন দশক পূর্তি, তখনও জামায়াত-বিএনপির জনসভায় স্লোগান উঠছে জয় বাংলা, জয় ধানের শীষ। বলা হচ্ছে ডা. আলীম চৌধুরী আর ডা. ফজলে রাব্বীর খুনিদের দলে নাকি মুক্তিযোদ্ধা আছে। একাত্তরের লাখো শহীদের আত্মত্যাগে আমাদের বাংলাদেশ। আর শুধু ওই একটি কারণেই আজ আমি লিভারের অধ্যাপক।

৭১’র ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল অরোরা যদি সারেন্ডার করতেন নিয়াজীর কাছে, আমি জানি আমার সর্বোচ্চ প্রাপ্তি হতো কোনো একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাধারণ একজন কর্মচারী হওয়া। শহীদের রক্তের সাথে যদি বিশ্বাসঘাতকতা করতে না চান, যদি চান শান্তিতে ঘুমাক ডা. আলীম আর ডা. রাব্বীরা, ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের সেদিনের সব নির্মমতা ভুলে, তবে বুকে হাত রাখুন আর শপথ নিন, ‘আর যাই করি না কেন, ত্রিশ ডিসেম্বর আমি কোনো ভুল করবো না।

লেখক : অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

বিএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।