এগিয়ে যাক মি-টু আন্দোলন
রোকসানা ইয়াসমিন
পশ্চিমা বিশ্বসহ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রলয় সৃষ্টিকারী #মি-টু আন্দোলনের প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। একের পর এক ব্যক্তি প্রকাশ করতে শুরু করেছে তাদের সাথে ঘটা যৌন নির্যাতনের কথা। দীর্ঘদিন ধরে যে চাপাকষ্ট তাদের বয়ে বেড়াতে হয়েছিল একাকী নিভৃতে- তা তারা প্রকাশ করছে #মি-টু প্লাটফর্মে, যার শুরু হয়েছিল মডেল মাকসুদা আক্তার প্রিয়তি মাধ্যমে।
এরপর সিমন্তি, আসমাউল হুসনা, তাসনুভা, অনিক, মুক্তা, তন্বী আর ফারিয়া তাদের নির্যাতিত হওয়ার অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে।
গতকাল মি-টু অভিজ্ঞতা প্রকাশ করল আমার দীঘর্দিনের ঘনিষ্ঠ সহচর, আমার বন্ধু আরজু আলফা। একেবারেই অবাক হইনি তাদের অভিজ্ঞতার কথা শুনে। তবে চমৎকৃত হয়েছি, আপ্লুত হয়েছি তাদের সত্য প্রকাশ করার সাহসিকতা দেখে।
বেশিরভাগ মেয়েই কিন্ত অবাক হচ্ছে না এই নিপীড়নের কথা শুনে। কারণ অধিকাংশ মেয়ে কোনো না কোনোভাবে তাদের শিশুকাল থেকেই যৌননিগ্রহের শিকার হয়ে থাকে এবং তার বেশিরভাগ হয়ে থাকে নিকটাত্মীয় কিংবা পরিবারের ঘনিষ্ঠজনের মাধ্যমে। কিন্ত তারা বলতে পারে না এই নিগৃহীত হওয়ার কথা, কেন না জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই তারা জেনে আসে এগুলো নিষিদ্ধ কথা, কারও সাথে বলতে হয় না। সে জন্য মেয়েরা তাদের কথাগুলো প্রকাশ করার কথা চিন্তাও করত না। কিন্ত গত এক বছরে এর প্রেক্ষাপট পাল্টেছে।
শুধু কি মেয়েরা শিকার হচ্ছে যৌন নির্যাতনের? অনেক সময় ছেলেরা এবং তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিও শিকার হয় এই নির্যাতনের। এই যেমন অনিক ছেলেটি। আহা! কি নিষ্পাপ চেহারা! খুব কাছের মানুষের দ্বারা সে কয়েকবার ধর্ষণের শিকার হয়েছে। কিন্ত ছেলেদের এই নিগৃহীত হওয়ার এই সংখ্যাটা মেয়েদের তুলনায় কিছুটা কম।
আজও পত্রিকায় পড়লাম যে ময়মনসিংহে পাঁচ বছরের একটি শিশুকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। গত বছর ৮১৮ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিল যাদের ৪৭ জনকে পরে হত্যা করা হয়েছিল। আর ২৫৫ জন নারী যৌননিগ্রহের বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করেছিল (সূত্র: আইন ও সালিস কেন্দ্র)।
পত্রিকায় প্রকাশিত কিংবা মামলা করা হয়- এমন ঘটনাগুলোকেই কেবল বিভিন্ন সমীক্ষার উপাত্ত হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বাস্তব অবস্থা আরও ভয়াবহ, কারণ সবাই মামলা কিংবা অভিযোগ দায়ের করে না বিবিধ কারণে। আমাদের সমাজে খুব ছোট বেলায় যৌননিগ্রহের শিকার হয়নি এমন মানুষ পাওয়া কঠিন। আজ যে নিপীড়নকারী, সেও হয়ত কারো দ্বারা নিগৃহীত হয়েছিল।
তারানা বুরকি নামে হারলেম শহরের এক মানবাধিকারকর্মী ২০০৭ সালে মি-টু আন্দোলন শুরু করেন। যৌন নিপীড়নের শিকার নারীদের সাহস দেয়ার উদ্দেশেই তিনি এই আন্দোলনের শুরু করেছিলেন। আর তিনি এই সাহস সঞ্চয় করেছিলেন তারই ক্যাম্পের এক নারীর মাধ্যমে। ওই নারী বুরকিকে জানিয়েছিলেন, তার মায়ের বয়ফ্রেন্ড তাকে একাধিকবার ধর্ষণ করেছিল। আর ওই নারী দ্বারা উৎসাহিত হয়ে তারানি একটি নিবন্ধে "মি টু" ট্যাগটি ব্যবহার করে জানিয়েছিলেন তার যৌননিগ্রহের কথা, জানিয়েছিলেন তিনি কীভাবে গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন।
বুরকির আইডিয়া দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে অভিনেত্রী এলিসা মিলানো ২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর একটি টুইট করেন। ওই টুইটে মিলানো লিখেছিলেন, "আপনি যদি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন তাহলে মি-টু লিখে, এই টুইটের উত্তর দিন। মিলানোর সেই টুইট স্ট্যাটাসের কয়েকদিনের মধ্যে ৪০ হাজার মানুষ মি-টু লিখে উত্তর দিয়েছিল। আর পরোক্ষভাবে এক কোটি ২০ লাখ মানুষ সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার আর ইনস্টাগ্রামে মি-টুর প্রতিউত্তর দিয়েছিল। গত এক বছরে মি-টু লিখেছে এমন লোকের সংখ্যা কয়েক কোটি ছাড়িয়ে গেছে।
বর্তমানে বিশ্বের ৮৫টি দেশের নারী-পুরুষ যৌন নির্যাতনের ভয়াবহতাকে বোঝানোর জন্য মি-টু ট্যাগ ব্যবহার করছেন, মিটু অভিজ্ঞতা প্রকাশকারীর অধিকাংশই হিন্দি, ফরাসি, আরবি, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ আর ইংরেজিভাষী।
এই ধারণাটিকে জনপ্রিয় করতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন হলিউড অভিনেত্রী রোজ ম্যাকগন এবং এসলে জাড। তার এবং আরও কয়েকজন অভিনেত্রীর মি-টু অভিজ্ঞতা নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস সাক্ষাৎকার ছেপেছিল, যা রাতারাতি এই ধারনাটিকে লাইম লাইটে নিয়ে আসে।
আমাদের পাশের দেশ ভারতে অন্তত ১২ জন সেলিব্রেটি মি-টু হ্যাসট্যাগ দ্বারা অভিযুক্ত হয়েছে। এমনকি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম যে আকরব মি-টু তে অভিযুক্ত হয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। খুব সম্প্রতি ইন্ডিয়ান আইডল কর্তৃপক্ষ প্রখ্যাত সুরকার মি-টু অভিযুক্ত আনু মালিককে অনুষ্ঠান থেকে বাদ দিয়েছে।
আমার জানামতে, সিমন্তি অভিযোগের ক্ষেত্রে তদন্ত কমিটি গঠন করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল ডিবিসি টেলিভিশনের পক্ষ থেকে। ওই কমিটি আজও গঠিত হয়েছে কি না আমার জানা নেই।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, নেদারল্যান্ড প্রবাসী শুচিস্মিতা সিমন্তি সম্প্রতি এক ফেসবুকে #Me too এর মাধ্যমে জানায় যে, একদা তাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠজন প্রণব সাহার মাধ্যমে সে শিশু বয়সে যৌননিগ্রহের শিকার হয়েছিল। সে ডিবিসি টেলিভিশন কর্তৃপক্ষকে এক ইমেইল বার্তার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগটি জানায়।
বাংলাদেশে এখনও পযর্ন্ত কোনো প্রতিষ্ঠান মি-টু আন্দোলনের পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করেনি। বিছিন্নভাবে কেউ কেউ চেষ্টা করছে, কিন্ত তাদের এই চেষ্টা হালে পানি পাচ্ছে না বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে। এইক্ষেত্রে তাদের বলব, "একবার না পারিলে দেখ শতবার," কারণ এই বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ এর সাথে জড়িত আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানসিক সুস্থতা। আমি চাই না আমাদের সন্তানরা কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে বেড়ে উঠুক।
বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে এমন কোনো সংস্থা মি-টু আন্দোলনের পক্ষে সংহতি প্রকাশ করেনি। আশা করছি তারা এগিয়ে আসবেন। কারণ প্রেসার গ্রুপগুলো কাজ করা শুরু করলেই রাষ্ট্র বাধ্য হবে মি-টু বিষয়ে মনেযোগী হয়ে উঠতে। সামনে জাতীয় নির্বাচন আর নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো যৌননিগ্রহের বিষয়টি নিয়ে কী ভাবছে এবং এই বিষয়ে কতটা আন্তরিক তা প্রমাণ করার বিষয় আছে। আমরা দাবি নিয়ে যথাযথভাবে সোচ্চার হলেই রাজনৈতিক দলগুলো মি-টু নিয়ে গুরুত্ব সহকারে ভাববে বলে আমার বিশ্বাস।
নারীর কমর্ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য, যৌননিগ্রহের বিষয়ে হাইকোর্ট ২০০৯ সালে যে নিদের্শনা দিয়েছিল তা একটি মাইলফলক। আমাদের দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি যৌন নিপীড়ন বন্ধে এই গাইডলাইনগুলো মেনে একটা নজির সৃষ্টি করতে পারে। কেননা হাইকোর্টের ওই নির্দেশে প্রতিটি কমর্স্থলে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ সেল গঠন করার কথ বলা হয়েছে। কিন্তু এই বিষয়টি খুব কম প্রতিষ্ঠানই আমলে রয়েছে।
বাংলাদেশে মূলধারার মিডিয়াগুলো এই নিয়ে সংবাদ প্রচার করছে না, কারণ তারা আইনের মারপ্যাঁচের মধ্যে যেতে চায় না। যদিও সিএনএন, বিবিসি আর আল-জাজিরার মতো শীর্ষস্থানীয় মিডিয়ার নিউজ কন্টেন্টের অনেকটা জুড়েই থাকে মি-টু মুভমেন্টের বিভিন্ন বিষয়।
পুরুষরাই যে কেবল নিপীড়ককারী, তা কিন্ত নয়। নারীর দ্বারাও পুরুষ নিপীড়িত হতে পারে, হয়ে থাকে। কেউ যদি মনে করে পুরুষই কেবল নিপীড়নকারী এবং মি-টু আন্দোলন সকল পুরুষের বিপক্ষে, তাহলে তারা ভুল ভাবছেন। আমার পরিচিত অনেকে পুরুষ এই আন্দোলনকে সাপোর্ট দিচ্ছে। তারা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। এর বিপরীত চিত্রও আছে। অনেক নারী এর বিপক্ষে কথা বলছেন। আশাকরি একদিন তারা তাদের ভুল বুঝতে পারবেন এবং এই আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করবেন।
আমি বলছি না যে মি-টু আন্দোলনের সুযোগ কেউ নেবে না। হয়ত অন্যায্য কিংবা মিথ্যা অভিযোগও উঠতে পারে কারো কারও বিরুদ্ধ। যে অভিযোগ এনেছে তারও যেমন অভিযোগ প্রমাণ করতে হবে, তেমনি অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অবশ্যই আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। যে দেশে রেপ কেস প্রায়শ প্রমাণ করা যায় না, সে দেশে এসব ঘটনার প্রমাণ চাওয়া প্রকারান্তরে নিপীড়নকারীদের পক্ষেই দাঁড়ানো হয়। যারা সাহস নিয়ে মুখ খুলছে সে জন্য তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়াটা জরুরি।
মি-টু প্লাটফর্মে যারা অভিজ্ঞতা প্রকাশ করছে তারা নিশ্চয়ই নিপীড়নকারীকে আইনের মাধ্যমে শাস্তি দেয়ার জন্য করেনি। মি-টু বলতে পারাটা একটা চ্যালেঞ্জ যেটা তারা অতিক্রম করেছে। যা আমরা অনেকেই হয়তো পারছি না। কেউ যদি কোনো চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে পারে তাদেরকে তো সফল বলাই যায়, নয় কি?
আমি কোনোভাবেই বিশ্বাস করি না মি-টু আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। 'মি-টু' বলতে পারাটা এটাই একধরনের সফলতা। নিপীড়নকারীর মনে এই বোধ ঢুকিয়ে দেয়া যে, আপনি গোপনে যেই অপকর্মটি করছিলেন বা করবেন তা গোপন রয়নি বা রবে না। আর এতেই পটেনশিয়াল নিপীড়নকারী নিজেকে নিপীড়ন করা থেকে নিবৃত করবে। কে চাইবে অন্যের কাছে নিজেকে হেয় প্রতিপন্ন হতে?
চলুন আমরা মি-টু অভিজ্ঞতা প্রকাশকারীদের, তার পরিবাররের ব্যক্তিদের চরিত্র বিশ্লেষণ না করে তাদের বাহাবা দেই, তাদের সাথে সংহতি প্রকাশ করি। এতেই তাদের মি-টু আন্দোলন সাথর্ক হবে। অভিযুক্তকে অপরাধী ভাবা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্যায়, সেটা আমি করতেও চাই না, কিন্তু মি-টুর মাধমে যারা অভিযুক্ত হয়েছে, বর্তমান প্রেক্ষিতে তাদের সাথে রক্ষণশীল না হবার বাস্তব কোনো কারণ নেই।
চলুন আমরা মি-টু অভিযুক্তদের বয়কট করা শুরু করি আর এটা হবে আমাদের সামাজিক আন্দোলন। আর এই আন্দোলন শুরু করার জন্য নিশ্চয়ই কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা আইন-কানুনের দরকার নেই।
হোক প্রতিরোধ, হোক মি-টু শূন্য নতুন সামাজিক ব্যবস্থা।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/বিএ