রাজনীতির কদর্য চেহারার উল্টোপিঠ-ই সংলাপ

অঘোর মন্ডল
অঘোর মন্ডল অঘোর মন্ডল , এডিটর, দীপ্ত টিভি
প্রকাশিত: ০২:৪৮ পিএম, ০৪ নভেম্বর ২০১৮

সংলাপ- কী জিনিস, ঠিক বুঝে ওঠা যাচ্ছে না। এদেশের মানুষ সংলাপের কথা শুনেছেন। টেলিভিশনের সৌজন্যে অনেক সংলাপের খণ্ডচিত্র দেখেছেন। সেটা বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে আলোচনা। খাওয়া-দাওয়া। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে এসে সংবাদমাধ্যমে নিজেদের মত করে কিছু বলা।

সাকুল্যে এই হচ্ছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংলাপ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আবার সংলাপ শুরু হয়েছে। সংলাপ চলছে। সেটা দেখে এবার বিশিষ্টজনরা বলছেন; রাজনীতিতে সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। কেউ বলছেন, অপরাজনীতির যে জমাট বাঁধা অবস্থা সেটা গলতে শুরু করেছে।

সংলাপের মাধ্যমে বিবাদমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জমাট বাঁধা মতপার্থক্য যদি দূর হয়, সেটা স্বস্তির খবর হবে বাংলাদেশের মানুষের জন্য। কারণ, এদেশের মানুষ রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। সেটা আমাদের রাজনীতিবিদদের জন্য। তাদের কারণেই এদেশের রাজনীতির একটা কদর্য চেহারা বার বার বেরিয়ে পড়েছে।

এখানে রাজনীতিবিদরা একজন আরেকজনের সাথে ব্যবসা করতে পারেন। ব্যবসায়িক পার্টনার হতে পারেন। আত্মীয়তা করতে পারেন। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য হিসেবে কেউ কারো চেহারা দেখতে চান না! মুখ দেখাদেখি বন্ধ থাকে।

ক্ষমতার জন্য এক দল আরেক দলের নেতানেত্রীকে হত্যা চেষ্টা করতে পারেন। হত্যা-ক্যু-ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতার ভাগ পেতে চান। কিন্তু আলাপ-আলোচনা করে দেশের উন্নয়ন, গণমানুষের সমস্যার সমাধান, গণতন্ত্রের পরিসর বাড়ানোতে তাদের চরম অনীহা!

তারপরও ভাল খবর আগামী নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-দুশ্চিন্তা দূর করার জন্য হলেও ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক নেতারা আলোচনার টেবিলে বসেছেন। যে ক্ষমতাসীন নেতারা দিন কয়েক আগে বলেছেন,‘ কীসের আলোচনা? কার সাথে আলোচনা?’ তারাও স্ট্যান্স বদল করেছেন।

এখন দেখছেন সদিচ্ছা থাকলে অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যায়। অনেকের সাথে আলোচনা করা যায়। এবং তারা করছেন। তবে হ্যাঁ, যারা আলোচনা সফল মানে বুঝতে এবং বুঝাতে চান তাঁদের সাত দফার সবগুলো মেনে নেবে সরকার বা সরকারকে মেনে নিতে হবে, তারা হয় নিজেরা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। অথবা জনগণকে বোকা মনে করছেন।

তাদের সব দফা যদি শাসক দল মেনে নেয়, তাহলে আর সংলাপের কোন দরকার ছিল কী! তারা তো পল্টনে বা প্রেস ক্লাবে বসে বলতে পারতেন, আমরা হিংসাত্মক আন্দোলনের পর অহিংষ্ণু আন্দোলন করে সরকারকে বাধ্য করেছি সব কিছু মেনে নিতে! সংলাপ মানে সবাইকে খুশি হয়ে ফিরতে হবে, এমন কোন গ্যারান্টি ক্লজ কোন সংলাপে থাকে না। আবার সংলাপ মানে টেবিলের উল্টো পাশে বসা লোকজনের কোন কথা শোনা যাবে না, তাদের কোন দাবিকে যৌক্তিক মনে করা যাবে না , তাও নয়।

সংলাপের মত ভারি শব্দটাকে একটু সহজ করে বোঝার চেষ্টা করলে, বোঝা যায় আলোচনা। আর আলোচনার মাধ্যমে যে কোন বিষয়ে একটা সমঝোতা হতেই পারে। এদেশের মানুষ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা দেখতে চায়। সহিংসতা নয়। হামলা-মামলা-খুন-গুমের সংস্কৃতি দেখতে দেখতে জনগণ রাজনীতিবিদদের ওপর বিরক্ত। সেটা রাজনীতিবিদরা উপলব্ধি করতে পারলে ভাল।

রাজনীতির বাইরের কেউ শাসন ক্ষমতায় চলে আসলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি কাদের হয়, সেটা ভাল জানেন রাজনীতিবিদরা। সেই অভিজ্ঞতা তাদের আছে। অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে না পারলে তারা আবার কীসের রাজনীতিবিদ! সংলাপের নামে নাটক করছে সরকার- এই মন্তব্য যারা করছেন,তারা ভুলে যাচ্ছেন আন্দোলনের নামে মানুষ মেরে তারা সংলাপের দরোজাই বন্ধ করে রেখেছিলেন। সেই দরোজা খুলেছে বলে অনেকে গণভবনে যাচ্ছেন। আলোচনা হচ্ছে।

হয়তো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের একটা পথও বেরিয়ে আসবে আলোচনা থেকে। আর আন্দোলন? সংলাপ বা আলোচনা অব্যাহত রেখেও আন্দোলন করা যায়। সফল হওয়া যায়। সেটা ’৭১ এ বঙ্গবন্ধু দেখিয়েছেন। কিন্তু এখন যারা আন্দোলনের কথা বলেন, তারা অনেক কিছু করে এসেছেন। কিন্তু জনগণের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারেননি। তবে হ্যাঁ, রাজনীতিতে সফল মানে ক্ষমতায় যাওয়া আর ক্ষমতা ধরে রাখার চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হওয়া নয়।

সংলাপ সফল হবে কী না সেটা পরের প্রশ্ন। তবে আপাত সংলাপের সাফল্য দৃশ্যমান। শাসক দলের সাথে সংলাপ বা আলোচনার জন্য বিএনপির মত বড় দলও অনেক কিছু ছাড় দিতে বাধ্য হয়েছে। তারা গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেনকে ঐক্যফ্রন্টের নেতা মেনে নিয়েছেন। সেটা শাসক দলের সাথে সংলাপের জন্যই।

আবার ছোট ছোট সাইনবোর্ড সবর্স্ব দলের বড় নেতারাও ঐক্যফ্রন্ট বা যুক্তফ্রন্টের ব্যানারে এক হয়ে নিজেদের একটু ওজনদার ভাবতে পারছেন। আওয়ামী লীগের মত দলের নেতাদের উল্টো দিকে বসে অনেক কথা বলতে পারছেন। শাসক দলের প্রধান তাদের কথা শুনছেন। সংলাপ যদি হয়, শুধু অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ-অংশগ্রহণমূলক একটা নির্বাচনের জন্য, তাহলে সেটা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধনে হলেও ঐ সব দলের ভারী ভারী নামের নেতাদের জেতার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

তারপরও তারা সংলাপের কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই মুর্হুতে গুরুত্ব পাচ্ছেন। সেটাও কম প্রাপ্তি কী! সংলাপ, আলোচনা শুধু নির্বাচনের জন্য নয়। সেটা হওয়া উচিত, গণতন্ত্রের জন্য। জনকল্যাণ্যের জন্য। রাষ্ট্রের জন্য। গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় সংলাপের কোন বিকল্প নেই। সেটা শুধু টেলিভিশনে দেখানোর জন্য ঘটা করে হওয়ার দরকার নেই। সদিচ্ছা থাকলে অনেকভাবেই হতে পারে।

এদেশে সংলাপের ইতিহাসে সাফল্য বলে কিছু নেই। কিন্তু নেই বলে নতুনভাবে সংলাপের ইতিহাস লেখা যাবে না, তা তো নয়। আমরা সংলাপের সদর্থক অর্থটাই খুঁজতে চাই শাসক দলের সাথে অন্যান্য রাজনৈতিক আলোচনায়।

লেখক : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট।

এইচআর/আরআইপি

‘ক্ষমতার জন্য এক দল আরেক দলের নেতানেত্রীকে হত্যা চেষ্টা করতে পারেন। হত্যা-ক্যু-ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতার ভাগ পেতে চান। কিন্তু আলাপ-আলোচনা করে দেশের উন্নয়ন, গণমানুষের সমস্যার সমাধান, গণতন্ত্রের পরিসর বাড়ানোতে তাদের চরম অনীহা!’ মতামতে আপ করুন, লিংক শেয়ার দিন...

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।