প্রতিটা ঘরই যেন এক একটা বৃদ্ধাশ্রম

মো. সাইফুল ইসলাম মাসুম
মো. সাইফুল ইসলাম মাসুম মো. সাইফুল ইসলাম মাসুম , ব্যাংকার
প্রকাশিত: ০৫:০০ পিএম, ১৩ অক্টোবর ২০১৮

শুরু করছি নচিকেতার বৃদ্ধাশ্রম গানটি দিয়ে। চুপ করে গানটি শুনলে গায়ে কাঁপন ধরে। সন্তান এবং মায়ের এমন অকৃত্রিম বন্ধন যখন বৃদ্ধ বয়সে উল্টো
হয়ে যায়, তখন দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। এই বুঝি জীবন!

শুধু গানের কথাগুলো শুনলেই গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়-

"ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার
মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার ওপার।
নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামি-দামি
সবচেয়ে কম দাশি ছিলাম একমাত্র আমি।
ছেলের আমার আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম
আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম!

আমার ব্যবহারের সেই আলমারি আর আয়না
ওসব নাকি বেশ পুরনো, ফ্ল্যাটে রাখা যায় না।
ওর বাবার ছবি, ঘড়ি-ছড়ি, বিদেয় হলো তাড়াতাড়ি
ছেড়ে দিলো, কাকে খেলো, পোষা বুড়ো ময়না।
স্বামী-স্ত্রী আর আ্যালসেশিয়ান-জায়গা বড়ই কম
আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম!

নিজের হাতে ভাত খেতে পারতো নাকো খোকা
বলতাম আমি না থাকলে কি করবি রে বোকা?
ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতো খোকা আমার কথা শুনে-
খোকা বোধ হয় আর কাঁদে না, নেই বুঝি আর মনে।
ছোট্টবেলায় স্বপ্ন দেখে উঠতো খোকা কেঁদে
দু’হাত দিয়ে বুকের কাছে রেখে দিতাম বেঁধে
দু’হাত আজো খুঁজে, ভুলে যায় যে একদম-
আমার ঠিকানা এখন বৃদ্ধাশ্রম!
খোকারও হয়েছে ছেলে, দু’বছর হলো
তার তো মাত্র বয়স পঁচিশ, ঠাকুর মুখ তোলো।
একশো বছর বাঁচতে চাই এখন আমার সাধ
পঁচিশ বছর পরে খোকার হবে ঊনষাট।

আশ্রমের এই ঘরটা ছোট,জায়গা অনেক বেশি-
খোকা-আমি, দু’জনেতে থাকবো পাশাপাশি।
সেই দিনটার স্বপ্ন দেখি ভীষণ রকম
মুখোমুখি আমি,খোকা আর বৃদ্ধাশ্রম!’

এই গানটি এ দেশের প্রতিটা সন্তানের দৈনিক দু একবার শোনা উচিৎ। কারণ
আমরা অন্ধ হয়ে গেছি। মায়ের কান্না আমরা দেখিনা। আমরা মূক ও বধির হয়ে গেছি। অসহায় মায়েদের বৃদ্ধ বয়সের আর্ত চিৎকার আমাদের৷ কর্ণ কুহরে প্রবেশ করেনা।

একটা বাস্তব ঘটনা মনে পড়লো-
ঘটনাটি চীন দেশের। সেই সময়ের ঘটনা এটা যে বার ভয়াবহ ভূমিকম্পে চীনের বিশাল
এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। ভূমিকম্প কবলিত এলাকায় উদ্ধারকর্মীরা উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কাজ চালাতে চালাতে তাঁরা এখন একটা ছোট বাড়ির ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে। বাড়িতে এক যুবতী মহিলা তার কয়েকমাস বয়সী বাচ্চাকে নিয়ে বসবাস করতেন। উদ্ধারকর্মীদের টিম লিডার তার লোকজন নিয়ে ভিতর থেকে পলেস্তরা, রড, ইট, পাটকেল সরিয়ে প্রাণের চিহ্ন খুঁজে বেড়াচ্ছে। অতঃপর সেই যুবতীর খোঁজ মিলল। ভাঙ্গা ছাদের অংশবিশেষ এর নিচে তার নিথর দেহটি চাপা পড়ে আছে।

টিম লিডার ভালভাবে যুবতীর দেহ পরীক্ষা করে বুঝল, পাখি আর খাঁচায় নেই, উড়াল দিয়েছে অজানা উদ্দেশ্যে। সে তার দলবল নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ কি মনে করে সে থেমে গেল। তার মনের গহীনে কোন এক জায়গায় কিছু একটা খচখচ করছিল। সে আবার যুবতীর নিথর দেহের কাছে ফিরে গেল। মেয়েটা কেমন যেন অদ্ভুত অবস্থায় আছে। নামাজে সিজদা দিলে যেরকম লাগে সেরকম। হাঁটু ভাঁজ করে, উপুর হয়ে মাথা নিচু করে কি যেন জাপটে ধরে আছে।

মনে হচ্ছে, কিছু আগলে রেখেছে। লোকটি আরো কাছে গিয়ে ভালভাবে খেয়াল করল। লোকটি চীৎকার দিয়ে বলে উঠল, "একটা বাচ্চা, একটা বাচ্চা আছে ওর নিচে!" সবাই তড়িঘড়ি করে ইট, পলেস্তরা সরাতে লাগলো। মেয়েটিকে সরিয়ে দেখল, তার বুকের নিচে ছোট এক বাচ্চা শুয়ে ঘুমুচ্ছে। বাচ্চাটা একটা ফুলের নক্সা করা কম্বল দিয়ে জড়ানো। চেহারায় হাল্কা ধুলো ছাড়া আর বিন্দুমাত্র আঘাতের নিশানা নেই। ভূমিকম্প হবার সময় মেয়েটি তার শরীর দিয়ে বাচ্চাটাকে আগলে রেখেছিল যাতে কোন আঘাত না লাগে। ফলে ছাদ ভেঙে যখন নিচে পড়ে তখন বাচ্চার কিছু হয় না, তবে মেয়েটার ঘাড় এবং মেরুদণ্ড ভেঙে যায়।

ডাক্তার এসে দ্রুত বাচ্চাকে পরীক্ষা করে দেখল, সে সুস্থ আছে, তখনও ঘুমুচ্ছে। হঠাৎ বাচ্চার ফুলেল কম্বল এর ভেতর থেকে একটা মোবাইল পেল তারা। মোবাইলের স্ক্রিনে কিছু একটা লেখা ছিল। তাতে লেখা ছিল, "আমার সোনা মানিক! তুমি যদি বেঁচে যাও, তাহলে এই মায়ের কথা মনে রেখ; কারণ আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি!"

ডাক্তার কেঁদে দিল ম্যাসেজটি পড়ে। মোবাইলটা সবার হাতে হাতে ঘুরছে। যে ই পড়ছে, সে চোখের পানি আটকে রাখতে পারছে না। এমনই হয় মা এবং তার সন্তানের ভালবাসা।মায়ের ভালবাসা বিরল, সন্তানের প্রতি মায়ের ভালবাসা কোন ভালবাসা দিয়ে তুল্য হয় না। সেই ভালবাসার প্রতিদান এমন করুণ হয়,তবে তা বড়ই মর্মান্তিক।

কিছুদিন আগে ইউটিউবে একটা ভিডিও দেখছিলাম। একটি এক মিনিটের ভিডিও, জানিনা কোন মহান কীর্তিমান আলোকচিত্রী এ দুর্লভ ভিডিওগ্রাফি টি ক্যামেরায় ধারণ করেছিল। ভিডিওটি ছিল এমন যে একটা হরিণশাবক একটি খাল/লেক/ জলাশয় সাঁতরে পার হচ্ছিল, পিছন থেকে একটি কুমির হরিণশাবক টিকে আক্রমণের জন্য তাড়া করছিল। ঘটনাটি দেখে মুহূর্তেই মা হরিণটি কোনরকমে দৌড়ে এসে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে দ্বিগুণ গতিতে সাঁতরে কুমিরের লক্ষ্যস্থল অর্থাৎ বাচ্চা হরিণটির পেছন পেছন এসে বাচ্চা হরিণটির বরাবর এসে কুমিরের থাবার মুখে পড়লো এবং কুমিরের লক্ষ্যভ্রষ্ট করল, অবশেষে রক্ষা পেল সন্তান হরিণের জীবন এবং কুমিরটি মা হরিণটিকেই আক্রমণ করে টেনে হিচঁড়ে ছিড়ে খেল।

জীবন বিনিময়। জীবনের অদ্ভুত বিনিময়। মানুষ হোক,পশু হোক,পাখি হোক,সব মা প্রাণিদের বৈশিষ্ট্য একই। মায়েদের ধর্মই হলো স্যাক্রিফাইজ, ত্যাগেই মায়ের শান্তি, এমনকি সেটা জীবন বিসর্জনেও। মায়ের প্রতি সন্তানের ভালবাসাও এমনি হওয়া উচিৎ। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এমন হয় না। হয় তার উল্টোটা। খুব কম ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটে। সন্তান ছোটবেলায় মাকে হারালে তখন মায়ের প্রতি ভালবাসা অটুট থাকে।থাকে নিকষ ও গাঢ়।

একটা গল্প চোখে অশ্রু ঝড়ায়। গল্পটি কাল্পনিক ও সংগৃহীত। কিন্তু গল্পটি অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। মনকে থমকে দেয়। চলুন গল্পটি শোনা যাক। "এক লোক তার গাড়ি পার্ক করে এক ফুল দোকানে গেল। সেখানে তিনি তার মায়ের জন্য কিছু ফুলের অর্ডার দিলেন এবং ঠিকানা দিলেন কোথায় পাঠাতে হবে। তার মা তার থেকে প্রায় ২০০ মাইল দূরে থাকেন। সেখানে ফুলগুলো পাঠানোর জন্য বললেন তিনি। অর্ডার শেষে যখন গাড়ির কাছে আসলেন দেখলেন যে , ছোট্ট এক মেয়ে গাড়ির পাশে বসে কাঁদছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন কাঁদছো কেন? মেয়েটি বললো যে, সে তারা মায়ের জন্য একটি গোলাপ কিনতে চায়। কিন্তু তার কাছে টাকা নেই। লোকটি মেয়েটিকে দোকানে নিয়ে গেল এবং একটা ফুল কিনে দিল।

এরপর বললো যে, চল তোমাকে আমি নামিয়ে দিয়ে আসি, তোমার মায়ের কাছে, যদি তুমি চাও। মেয়েটি গাড়িতে উঠে বসলো। লোকটি জিজ্ঞেস করলো কোথায় নামবে?

মেয়েটি কাছেই একটি কবরস্থানের কথা বললো। লোকটি কবরস্থানের কাছে নিয়ে গেল।

অবাক হয়ে বললো, এখানে কোথায়! মেয়েটি কিছু না বলে গাড়ি থেকে নেমে নতুন একটি কবরের দিকে এগিয়ে গেল। ওখানে ফুলটি গেঁথে দিয়ে বললো, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি মা।”

লোকটির চোখে পানি চলে আসলো। সে আবার আগের ফুল দোকানে গেল এবং তার অর্ডারটি বাদ দিয়ে ফুলের একটি তোড়া কিনলো। এরপর চললো ২০০ মাইল দূরে মায়ের কাছে।" শুধু কাল্পনিক কেন, এমন বাস্তব গল্প হাজার হাজার রয়েছপ ভুবন জুড়ে মাকে ঘিরে। মা একটা অদ্ভুত ভালবাসার নাম। খুব কম মানুষই আছে, মায়ের কথায়,মায়ের স্মৃতিচারণে তাদের নয়ন সিক্ত হয় না। খুব কম সন্তানই আছে যাদের হৃদয় জমিন চৌচির হয় না,মায়ের শূন্যতায়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়টা হলো মা যখন বৃদ্ধ হয়, আর ছেলেরা যখন বিয়ে করে সংসার পাতে তারা মাকে মায়ের প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয় না। বরং সম্মানের পরিবর্তে অবজ্ঞা, ঘৃণা,অবহেলা আর বিরক্তি দেখায়। মায়েদের জন্য এটা কত যে কষ্টের তা কেবল একজন মায়ই বুঝেন।

মায়েদের বুকের ভেতরের আর্তনাদ শুনা যায় না, ভেতরের গর্জনগুলোকে মায়েরা বের হতে দেয় না। মা তখনও সন্তানের ভালটার কথা চিন্তা করে। হায়রে মা! এমন কেনরে ‘মা’ ছোট্ট একটা শব্দ। কিন্তু তার পরিধি অসীম। সবচেয়ে কাছের মানুষ তিনি, সবচেয়ে প্রিয়। মায়ের বুকের হৃদস্পন্দন তার কাছে পরিচিত। মায়ের বুকের দুধে, শরীরের উষ্ণতায় সবার বেড়ে ওঠা, তেমনিভাবে মা তার সন্তানকে আগলে ধরে পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছে।মায়ের কান্না তার অসুস্থ সন্তান কে সুস্থ করে দেয়। মায়ের ভালবাসার কি যে এক জাদুকরী ক্ষমতা! কেবল একজন মায়ই জানেন কতটা নিবিড় ভাবে ভালবাসেন তিনি তার সন্তানকে।

জীবনের সকল শক্তি দিয়ে আগলে রাখেন একজন মা তার সন্তানকে। মায়ের ভালবাসার ঋণ কি করে শোধ করবো আমরা? কেউ কি পেরেছে এ পর্যন্ত মায়ের ভালবাসার বদলা দিতে? দুনিয়ার কোন মা কি কিছু চায় সন্তানদের কাছে? কি দিয়ে খুশি করবেন তাকে?

কি ক্ষমতা আছে আমার,আপনার একজন মা কে খুশি করতে? শুধু একটু ভালবাসা, একটু ভাল ব্যবহার, একটু ডাক খোঁজ, একটু দেখভাল? এইটুকুইতো? এইটুকুই দিতে আজকাল আমাদের মত কুলাঙ্গার সন্তানদের প্রাণে সয়না। শুধু বৃদ্ধাশ্রম কেন, প্রতিটা বাড়ি আজ পরিণত হয়েছে এক একটা নীরব বৃদ্ধাশ্রমে। এত এত জায়গা থেকেও মায়েদের জন্য একটু জায়গা হয় না। এত এত রুম থেকেও মায়ের জন্য/বাবার জন্য একটা রুম হয় না। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস!

লেখক : ব্যাংকার।

এইচআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।