আমাদের হিংস্র হয়ে উঠা


প্রকাশিত: ০৫:২৩ এএম, ০৮ আগস্ট ২০১৫

একটা কথা আমরা প্রায়ই শুনি, নিজেরাও বলি যে, বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। এই এগিয়ে চলা বলতে দেশের অর্থনীতির সমৃদ্ধির কথাই বলা হয়। কিন্তু অর্থনীতির সাথে সমাজ কি এগিয়ে চলেছে? সমাজের অগ্রগতির সঙ্গে যেমন কুসংস্কার ও কুপ্রথার প্রাচীন নিগড় ভেঙে ফেলতে হয়, তেমনই আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত সামাজিক চেতনা ও বিবেক অকারণ নিষ্ঠুরতার অনুশীলন থেকেও নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে হয় সমাজে বাস করা ব্যক্তি মানুষকে।

রাষ্ট্র হিসেবে এ মুহুর্তের বাংলাদেশকে দেখলে অবশ্য তেমনটা মনে হয় না। ঘরে-বাইরে নানা সময়েই শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা আমরা শুনি। শিশু ধর্ষণ, শিশু অপহরণ ও শিশু নির্যাতন আর খুন খুব স্বাভাবিক খবর এখন। পরিবারে, স্বজনদের হাতেও নির্যাতিত হচ্ছে শিশুরা।

কিন্তু সিলেটের রাজন আর খুলনার রাকিবকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা সবাইকে নাড়া দিয়েছে। জনসমক্ষে এমন নির্যাতন করে হত্যা করার এসব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন হিসেবে দেখার আর সুযোগ নেই। এক অদ্ভুত অবস্থা এ সমাজে। নিষ্ঠুর থেকে নিষ্ঠুরতর হয়ে ওঠার একটা পরিবেশ যেন আমরা আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসছি। একটি নৃশংস ঘটনা ঘটলে তার পরপরই একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটানো তারই প্রমাণ। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও বিকৃত মানসিকতার কারণে অপরাধীরা নৃশংস ও নির্মম অপরাধের অনুকরণ করে অসুস্থ বিনোদনে মেতে উঠছে।

শিশু রাজনের প্রতি নিষ্ঠুরতার পর সমাজে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল, ধারণা করা গিয়েছিল এমনটা হয়তো আর ঘটবে না। কিন্তু দেখা গেল নতুন উদ্ভাবনী পদ্ধতিতে শিশু রাকিবকে হত্যা করা হলো খুলনায়। তাতে একটি বিষয় পরিষ্কার হল- সমাজে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি আইন-কানুনের তোয়াক্কা করে না। তাদের নিষ্ঠুর আমোদের কাছে তুচ্ছ নীতি নৈতিকতা, আইন কানুন, বিবেক বা মূল্যবোধ।

রাজন রাকিবরা খুন হয়েছে খুব পরিচিতজনদের দ্বারাই। তারা সব একই এলাকার মানুষ। দূরের কেউ নয়। কার কাছে মানুষের ভরসা?  বিশ্বাসহীনতার অন্ধ গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছি আমরা! চোখের তারায় আমাদের অনিঃশেষ সন্ধিগ্ধতা, দিশেহারা আতঙ্ক আমাদের নিত্য সহচর। কাছের মানুষেরা, স্বজনেরা, পরিচিতরাই যদি এমনটা করে তবে কেমন করে বাঁচবে মানুষ?

মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত মানুষের পক্ষেই শুধু শিশুর প্রতি নৃশংস আচরণ করা সম্ভব। বিকৃত মানসিকতা দূর করতে হলে, শিশুকে সব ধরনের নির্যাতন থেকে সুরক্ষায় সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতার মূল উৎপাটন করতে হলে পরিবার ও কমিউনিটি পর্যায়ে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা শিক্ষা দানের মাধ্যমে মানুষের বিবেকবোধ জাগ্রত করা প্রয়োজন। এগুলো সবই আমরা জানি, জোর করে বললে বলা হবে আপনি আতলামি করছেন।

‘কল্যাণ’ ‘অধিকার’ ‘সুষ্ঠু বিকাশ’ ইত্যাদি শব্দের মুখোশে ঢাকা রাষ্ট্রের একটা ভয়ঙ্কর মুখ এর মধ্যে আমরা দেখতে পাই, যে মুখ অনায়াসে অনাচার এবং হিংসার পথ নেয়। তাই শুরুতে যা বলছিলাম যতই উন্নত হই, প্রগতিশীল হই, যতই মুখে থাক বহু-সংস্কৃতির মহতী বাণী, আমরা মানুষের প্রতি সহিষ্ণু হতে শিখিনি। উন্নয়ন, অর্থনীতির অগ্রগতি দিয়ে আজকের সংকটটা পুরোপুরি ধরা যাবে না।  আসলে আমাদের অসংবেদনশীলতার মূলে আছে সংস্কৃতির ইতিহাস। আমরা যুগে যুগে দেখেছি রাষ্ট্র, সমাজ ঠাণ্ডা মাথার ঘাতককে পুরস্কৃত করেছে যেমনটা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের। আমরা লগি বৈঠা দিয়ে যেমন মানুষ হত্যা করি, তেমনি পেট্রল বোমা দিয়ে জ্বালিয়ে দেই শত শত প্রাণ, গ্রেনেড হামলা করে উড়িয়ে দেই শত জীবন। রগ কাটার মতো সহিংস রাজনৈতিক সংস্কৃতি যে দেশে বছরের পর বছর জায়গা করে নেয় ধর্মের নামে, সেদেশে তথাকথিত কল্যাণ রাজনীতির আড়ালেতো এমন অসহিষ্ণুতার ভয়াল হিংস্র মুখ লুকোনো থাকবেই।

আমাদের রাজনীতি কি সত্যিকারভাবে কখনো ভেবেছে যে প্রতিটি শিশুর সুস্থ বৃদ্ধি প্রয়োজন? দেশে শিক্ষা-অধিকার আইনে দৈহিক শাস্তি নিষিদ্ধ।  কিন্তু কোথায় প্রয়োগ হয় সে আইন? এদেশে শিশু-অধিকার আন্দোলন দূরস্থান, শিশু-অধিকারের প্রশ্নটি পর্যন্ত ন্যাকামি বলে পরিগণিত। শিশু-শাসন ও শিশু-নির্যাতনের পার্থক্য কী, আমাদের মাথা ঘামানোর সময় নেই। শারীরিক নির্যাতনের কথাতো জানি, কিন্তু কত শিশু প্রতিদিন মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে?  আমরা জানি না, শুধু এটুকু বুঝতে পারি আমরা অনেক বাড়াবাড়ি করে ফেলছি, এবার কমাকমি-টার চর্চা জরুরি।

reja

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।