তরুণদের ভাবনা এবং ভবিষ্যৎ

বিনয় দত্ত
বিনয় দত্ত বিনয় দত্ত
প্রকাশিত: ০৯:৪৫ এএম, ০২ আগস্ট ২০১৮

আমাদের দেশে একসময় অশিক্ষিত লোকজনকে শিক্ষিত করে তোলার জন্য সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। সেই উদ্যোগ মোটামুটি সফল বলা চলে। কারণ বর্তমানে ৪০ শতাংশ শিক্ষিত বেকার চাকরির অভাবে ঘোরাফেরা করছেন। যাদের একটা চাকরি দরকার। যে চাকরিতে অনেক টাকা বেতন না দিক, ন্যূনতম বেতন যেন তাকে দেয়া হয়, চাকরির নিরাপত্তাটা যেন থাকে। চাকরির নিরাপত্তাটা কতটা জরুরি তা আমাদের নারীদের দেখলেই বোঝা যায়।

আমাদের দেশ থেকে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে ১৯৯১ থেকে ২০১৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ৭ লাখ ২৪ হাজার ৬৩৬ জন নারীকর্মী বাইরে যান। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই গেছেন ২ লাখ ৩৪ হাজার ৮৩১ জন। মাত্র বিশ হাজার টাকা বেতনের জন্য নারীরা সৌদিতে ছুটে যান। ভয়ানক অপমান, নির্যাতন আর অত্যাচার সহ্য করে তাদের আবার দেশে ফিরে আসতে হয়।

তারমধ্যে গত এক যুগ ধরে বেশিরভাগ শিক্ষিত মেধাবী তরুণদের দেশে ছাড়ার অদ্ভুত নেশা কাজ করছে। কোনোভাবেই তারা দেশে থাকতে রাজি নয়। এই ব্যাপারে আমি এই সময়ের বেশকয়েকজন তরুণের সাথে কথা বলেছি। এদের মধ্যে কেউ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, কেউবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে, কেউ আবার পাস করে চাকরি খুঁজছেন। তারা কঠিন কিছু যুক্তি আমার সামনে দাঁড় করিয়েছি যা শোনার পর আমি কিছুটা চিন্তিত এবং বিস্মিত।

গত এক দশক ধরে শিক্ষাব্যবস্থার যে অধঃপতন হয়েছে এই নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। যে ছেলেমেয়েগুলো সঠিকভাবে শিক্ষাটাই পেল না তাদের কাছ থেকে আপনি কি আশা করবেন? সব জায়গায় একটা অদ্ভুত প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় আপনাকে প্রথম হতেই হবে, ভালো থাকতেই হবে। প্রথম হওয়ার নেশায় আমাদের কোমলমতি সন্তানদের ভবিষ্যৎ আমরা কোথায় ঠেলে দিচ্ছি তা আমরা নিজেরাও জানি না। শিক্ষা নিয়ে সরকার যা করেছে তা অসহনশীল। এগারো ধারার শিক্ষাব্যবস্থাকে আমরা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছি না। এর ব্যর্থতা শেষমেষ বর্তাবে শিশু-কিশোর থেকে তরুণদের উপরই।

একজন শিশু কোথায় খেলবে? স্কুলের মাঠে নাকি বাসার পাশের মাঠে? এখন যেইসব স্কুলের অনুমোদন দেয়া হয় সেইসব স্কুলে খেলার মাঠই থাকে না। আর গোটা এলাকা জুড়ে একটা খেলার মাঠ পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার। বেশিরভাগ মাঠগুলো রাজনৈতিক দলের কার্যালয় বনে গেছে। কোথাও আবার সড়কের নির্মাণাধীন বিভিন্ন সামগ্রী রাখা হয়েছে দিনের পর দিন।

শিশুকিশোরদের মূল শিক্ষার পাশাপাশি গান, খেলা, নৃত্য, বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা আমরা দিতে পারিনি। যেখানে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় না, সেখানে বাঙালি সংস্কৃতি ও আচার-ব্যবহার কিভাবে সে শিখবে? তার কাছ থেকে কিভাবে দেশীয় চেতনাবোধ আশা করবে রাষ্ট্র।

আমাদের সবকিছু ভোট কেন্দ্রিক। যে ভোটার যত শক্তিশালী, তার কাছে সরকার ততটাই নমনীয়। কে কত ভোট সরকারকে দিবে, সরকার তার হিসাব করে তাদের সন্তুষ্ট করবে। এ যেন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা বা ব্যাপার। না হয় হেফাজতের মতো একটা ধর্মান্ধ দলের প্রস্তাবে কেন পাঠ্যবইয়ের তালিকা পরিবর্তিত হবে? যাদের নিজেদের মতাদর্শের ঠিক নেই তাদের প্রস্তাবে দেশের পাঠ্যসূতিতে পরিবর্তন এসে গিয়েছে। সত্যি সেলুকাস।

স্কুল, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে চাকরি খুঁজতে যাবে সেইখানে চাকরি নেই। গোটা শিক্ষাব্যবস্থায় কাউকে উদ্যোক্তা হওয়ার কথা শেখানো হয় না। শেখানো হয় সরকারি চাকরি পাওয়ার কথা, শেখানো হয় নিজের মেধা, দক্ষতা জমা দিয়ে দাসত্বের কড়াল বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কথা। কারণ কি?

কারণ হল, সরকারি চাকরি যারা করবেন তারা আজীবন সরকারের অধীনস্ত হয়ে থাকবেন। কখনো সরকারের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস করবেন না। আর এই শিক্ষা থেকে কেউ যদি বের হয়ে উদ্যোক্তা হতে চাই তার প্রতি পদে পদে বিপদ। তার ভাবনাকে মূল্যায়ন করা হবে না। ভাবনার যথাযথ প্রয়োগে বাধা দেয়া হবে। আর ব্যক্তিগতভাবে যদি কেউ আলাদা কোনো উদ্যোগ নেই তবে দলীয় রাজনৈতিক, প্রভাবশালী লোক এসে সেই উদ্যোগে হামলে পড়বে। যেন এদের আসার অপেক্ষায় আপনি উদ্যোগ বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন।

এর মধ্যে বাংলাদেশে একশ্রেণির দুর্বৃত্ত রাজনৈতিক শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে। কার্যত, এদের কোনো পেশা নেই, রাজনীতিই হল তাদের পেশা। রাজনীতি কিভাবে একজনের পেশা হতে পারে। যে রাজনৈতিকরা দেশের এবং জনগণের সেবা করার কথা তারা এখন পেশাজীবী রাজনৈতিক কর্মী হয়ে গিয়েছেন।

জনগণের প্রতি রাষ্ট্র বা সরকারের দায়বদ্ধতা নেই বললেই চলে। রাজনৈতিক দলগুলো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করতে পারেনি। রাজনীতিকে ব্যবহার করে সুবিধা নেওয়ার উদ্দেশে ছুটছে সবাই। এই সকল বক্তব্য বা ভাবনা এইসময়ের মেধাবী তরুণদের। আমি তাদের বক্তব্য শুনে বিস্মিত। কতটা মেধাবী এই প্রজন্ম, তাদের ভাবনায় গোটা দেশের চালচিত্র উঠে এসেছে। তরুণদের কঠোর বক্তব্যের বিপক্ষে কোনো যুক্তি দাঁড় করতে পারিনি। কারণ আমি নিজেও জানি এইসকল কথা সত্য। এই সত্যের আড়ালে কোনো প্রহসন নেই, কোনো মেকী চরিত্র নেই। যারা এখনো এই সত্য অনুধাবন করতে পারছে না তারাই এখনো ছুটছে।

২.
এই সময়ের তরুণরা কেউই রাজনীতিতে আগ্রহী নয়। কারণ দুই বড় রাজনৈতিক দল নিজেদের মধ্যকার কাদা ছোঁড়াছোড়ি থেকে এখনো বের হয়ে আসতে পারেনি। রাজনীতি নিয়ে দেশের বেশিরভাগ তরুণদের কোনো আগ্রহ নেই। আর শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ বিষয়ে অনাগ্রহ সবচেয়ে বেশি। তাদের সকল আগ্রহ নিজের অবস্থান শক্ত করার পেছনে। অর্থাৎ বেশিরভাগ তরুণকে আমরা আমাদের রাজনীতিতে আগ্রহী করে তুলতে পারিনি। তাহলে এই রাজনীতির অবস্থান কোথায়?

গত পাঁচ বছরে ১ হাজার ৫৮৩ জন বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন। এর মধ্যে ২০১২-১৩ সালে দেশে ছেড়েছেন ২৯৯ জন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মেধাবী, উচ্চশিক্ষিত, বিশেষ করে চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও আইটি দক্ষতাসম্পন্ন বাংলাদেশিরা দেশ ত্যাগ করছেন। নাগরিকত্ব ত্যাগের হার দিন দিন বাড়ছে। এর সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছেন শিক্ষকরা।

যে শিক্ষক গবেষণার কাজে দেশের বাইরে যাচ্ছেন তিনি আর দেশের ফিরতে আগ্রহী নন, আরো সহজ করে বলতে গেলে শিক্ষকরা দেশের এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই দেশে থাকতে রাজী নন। গবেষণার জন্য এইখানে যথার্থ ফান্ড পাওয়া যায় না। ফান্ডের অপ্রতুলতায় তারা হতাশ হয়ে পড়ছেন। তারমধ্যে রাজনৈতিক মতাদর্শের না হলে তো ভয়ানক বিপদ ও বিপর্যয় নেমে আসে শিক্ষকদের কপালে।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউই) এর জরিপ থেকে জানা যায়, ভালো জীবনযাপন ও পেশার উন্নতির জন্য বাংলাদেশের ৮২ শতাংশ তরুণ দেশ ছাড়তে চান। দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বেকার তরুণদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে তাই তারা নিজেদের স্থিতিশীল করতে দেশে ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, দেশে এখন সাড়ে চার কোটি মানুষ বেকার। এদের বড় অংশই শিক্ষিত তরুণ। রাষ্ট্র তরুণদের সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। সরকারি চাকরির নিশ্চয়তা কম, অন্যদিকে বেসরকারি খাতেও চাকরির সুযোগ কমেছে। সম্প্রতি সরকারি চাকরিতে সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর কারণে তরুণদের মধ্যে সরকারি চাকরির প্রতি আগ্রহ বেড়েছে অনেক বেশি। কিন্তু বেসরকারি খাতে সেই অনুপাতে সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না।

সরকারি চাকরিতে আগ্রহ বাড়লে কোটা একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই সময়ের তরুণদের কাছে। তাদের ভাবনা ৫৬ শতাংশ কোটা পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি। কিন্তু সরকারি পর্যায়ে কোটা সংস্কার নিয়ে এখন আন্তরিকতার অভাব রয়েছে।

১৬ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজারের জনসংখ্যার দেশে যদি আমরা ৪০ শতাংশ তরুণদের সন্তুষ্ট করতে না পারি তবে দেশে তরুণ নেতৃত্বের সংকট প্রকট হয়ে দাঁড়াবে। আশা করি, দেশের সরকার তরুণদের নিয়ে আলাদাভাবে ভাববেন।

লেখক : সাংবাদিক।
[email protected]

এইচআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।