তিন হাজার কিলোমিটার পথ বনাম বছরে তিন হাজার মৃত্যু
গত বছর জুনে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সংসদে জানিয়েছেন পুলিশ বিভাগের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০০০ সাল থেকে ২০১৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত গত ১৫ বছরে পাঁচ হাজার ৩১৬টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব দুর্ঘটনায় ৪৫ হাজার ৪৯৫ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।
পুলিশের এই তথ্যের বাইরে মৃত্যুর আরো বড়ো একটা অংক রয়েছে। তাছাড়া আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর যারা মারা যান তারা পুলিশের খাতায় ওঠেন না। বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুযায়ী বছরে পাঁচ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়।
দুর্ঘটনা এড়াতে ১ আগস্ট থেকে সারা দেশের মহাসড়কে অটোরিকশা ও অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ঈদুল ফিতরের আগে ও পরে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যুর পরই মহাসড়কে অটোরিকশা চলাচল নিষিদ্ধের কথা সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
গত ২৭ জুলাই এ সিদ্ধান্ত নিয়ে সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জাতীয় মহাসড়কে অটোরিকশার অবাধ চলাচল দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। তাই জাতীয় মহাসড়কে অটোরিকশা চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে সারাদেশের তিনচাকার যানবাহনের চালকেরা। তারা ধর্মঘটও করেছেন।
গত ২ আগস্ট সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এম এ এন ছিদ্দিক বলেছেন, জাতীয় মহাসড়কে থ্রি-হুইলার অটোরিকশা, অটোটেম্পু এবং সব ধরনের অযান্ত্রিক বাহন নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে না সরকার। তিনি জানান, দেশের আড়াই লাখ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে মাত্র তিন হাজার ৫শ ৭০ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়কে তিন চাকার যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার। জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থেই সরকার এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে।
বোঝাই যাচ্ছে ঈদের সময় মৃত্যুর মিছিল ক্রমান্বয়ে বড়ো হতে থাকায় সরকার এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। বছরে ৩-৫ হাজার মানুষের মৃত্যু সংখ্যার দিক দিয়ে অনেক বড়ো। এই অপমৃত্যু ঠেকাতে ওই সিদ্ধান্ত অনেকবার নেওয়া হয়েছে। কখনোই কার্যকর করা যায়নি। জনগণের নিশ্চিন্তে যানবাহনে চলাচলের ব্যবস্থা করতে হলে ওই সিদ্ধান্ত কার্যকরের কোনো বিকল্প নেই- এটা মানতেই হবে। পাশাপাশি সরকারের আরো কিছু বিষয় ভাবা দরকার ছিল।
সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার পথে কতো লাখ মানুষ চলাফেরা করে? কতো হাজার মানুষ এইসব যানবাহন চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে? কতো হাজার শিশু স্কুলে যায়, কতোজন রোগী হাসপাতালে যায়? এসব ভেবে একটি বিকল্প উপায় বের করে এরপর সিদ্ধান্ত কার্যকর করলে হয়তো সারাদেশে এতো বিক্ষোভ হতো না। তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা কেন রাখা হলো না এই প্রশ্ন উঠতেই পারে। কারণ সরকারের তরফ থেকে ২ বছর আগেই বলা হয়েছিল পুনর্বাসনের ব্যবস্থা রেখেই এ জাতীয় সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে।
২০১৩ সালের ৯ জুন জুন এ বিষয়ে একটি মন্ত্রিসভা কমিটির প্রথম বৈঠক হয়েছিল। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল- পুর্নবাসনের ব্যবস্থা রেখে সড়ক-মহাসড়কের পাশে অবৈধ হাটবাজার, ভাসমান ও অস্থায়ী দোকান, বিলবোর্ডসহ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। সড়ক-মহাসড়কের পাশের অবৈধ স্থাপনা অপসারণ এবং মহাসড়ক থেকে নছিমন, করিমন, ভটভটিজাতীয় যান চলাচল বন্ধ করা হবে।
দুবছর আগে ওই বৈঠক শেষ করে তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, “আগামী ১৫ জুন থেকে পর্যায়ক্রমে এগুলো উচ্ছেদ করা হবে। দুর্ঘটনা ও যানজটের বিরুদ্ধে আমাদের এই পদক্ষেপ।” তিনি আরো বলেছিলেন “বিভিন্নভাবে চেষ্টার পরেও যখন পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হলো না তখনই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। নির্বাচনের বছর এসব বিষয় বাস্তবায়ন কঠিন হলেও এ থেকে পিছিয়ে আসার কোনো সম্ভবনা নেই।” তিনি আক্ষেপ করেছিলেন এই বলে যে মন্ত্রিসভার এই কমিটি আরো আগে হলে ভাল হতো।”
দু`বছর পর তারই মন্ত্রণালয়ের সচিব বলছেন, ওই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে না সরকার। এটা সরকারের চ্যালঞ্জ। সরকারের এই সিদ্ধান্তে দেশের আপামর জনসাধারণ সমর্থন জানাবে ঠিকই। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না মহাসড়কে ধীরগতি যান চলাচলের জন্য দুর্ঘটনার মাত্রা বেড়ে গেছে। তবে এই সিদ্ধান্ত এখন হুট করে কার্যকর করতে গিয়ে যেসব সমস্যা দেখা দিয়েছে তার জন্য সরকারের পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না এটা পরিষ্কার। কারণ জনসাধারণের এতোদিনের অভ্যাস হুট করে তো পরিবর্তন করা যাবে না। কথা হলো পরিকল্পিত বিকল্প ব্যবস্থা নেয়ার পর এই সিদ্ধান্ত নিলে সেটা বরং কার্যকর করতে সুবিধা হতো। কারণ সরকারের অমন অনেক সিদ্ধান্তই দেখি হুট করে নেওয়া হয় আবার হুট করে তা বাতিলও করা হয়। আর উন্নয়ন প্রকল্পও চলে ধীরগতিতে।
গত বছরের অক্টোবরে মহাসড়কগুলোর ১৪৪টি স্থানে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতে সরকার ১৬৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাস করে। ২০১৬ সালের জুনে এই কাজ শেষ হওয়ার কথা। সেটিও চলছে ধীরগতিতে। আগামী বছরও তার কাজ শেষ হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের হিসেবে সড়ক অবকাঠামোর মানের দিক থেকে এশিয়ার সব দেশগুলোর নিচে বাংলাদেশের অবস্থান। বিশ্বের ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ আছে ১০৯তম স্থানে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের হিসেবে মহাসড়কের ৭৩ শতাংশই মানহীন। ২৬ শতাংশ মাঝারি মানের হলেও ভালো মানের মহাসড়ক মাত্র ১ শতাংশ।
মহাসড়কের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বাংলাদেশে আসলে কোনো মহাসড়কই নেই। এখন সরকার যে বিকল্প ব্যবস্থা না রেখে মহাসড়ক থেকে ধীর গতির যান চলাচল বন্ধ করলো ১৬ কোটি মানুষের দেশে ওই সব যানবাহনের প্রয়োজন ছিল বলেই তো তা চলেছে। পৃথিবীর কোনো মহাসড়তেই ধীরগতির যানবাহন চলাচল করে না। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতির দেশে মানুষকে ঠেকানো যাবে না। জীবিকার তাগিদেই তারা ছুটাছুটি করবে। কিন্তু উন্নত দেশের মতো মূল মহাসড়কের পাশে সার্ভিস লেন থাকলে আজ এই সমস্যা থাকতো না। বাংলাদেশে এ ধরনের ব্যবস্থা আছে একমাত্র বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহসড়কে। এদেশে এ ধরনের মহাসড়ক আর নেই বললেই চলে। এছাড়া মহাসড়কে যেখানে সেখান থেকে সংযুক্ত হওয়ার ব্যবস্থাও থাকার কথা না। কিন্তু এদেশে সব মহাসড়কেই যত্রতত্র তিন চাকা আর চার চাকা এমনকি রিকশাও ঢুকে পড়তে পারে।
এরপর রয়েছে চালকদের বেপরোয়া মনোভাব। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিটিউটের (এআরআই) তথ্য মতে, যে সাত কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে চালকদের বেপরোয়া ড্রাইভিংয়ের কারণে ৯১ শতাংশ দুর্ঘটনার তথ্য।
এসব প্রতিকার না করে হুট করে নিষিদ্ধ করলেই তা কার্যকর করা যাবে কিনা এটা ভেবে দেখা দরকার। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে সরকার কতটা সক্ষম হবে সেটা সময়ই বলে দিবে। যদিও সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ৪ আগস্ট ঢাকা-চট্রগাম মহাসড়ক পরিদর্শনে গিয়ে বলেছেন মন্ত্রিত্ব গেলেও তিনি মহাসড়কে অটোরিকশা চলতে দিবেন না। মহাসড়ক থেকে শুধু তিন চাকার যান চলাচল বন্ধ করলেই কী দুর্ঘটনার মাত্রা কমে যাবে? এই প্রশ্নের জবাব এতো সহজ নয়। সরকার বাহাদুরের অজানা থাকার কথা নয় যে মহাসড়কগুলোতে হাট বাজার, মাছের আড়ৎ, সবজি বাজার এমনকি গরুর হাটও বসে। এগুলো উচ্ছেদ করবে কে?
সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পর অনেক পরিবারের উপার্জন ক্ষমতা যেমন সীমিত হয়ে যাবে, পাশাপাশি সরকারি দলের ছত্রছায়ায় একটি গোষ্ঠিরও আয়ে টান পড়বে। সারাদেশে সিএনজি, করিমন, নসিমন জাতীয় তিন চাকার যানবাহনের জন্য শত শত স্ট্যান্ড তৈরি হয়েছিল। যেখান থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলা হতো। এই তোলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় একটি গোষ্ঠি যে নাখোশ হয়েছে সেটিও স্পষ্ট হয়ে গেছে- এইসব যানবাহনের চালক শ্রমিকদের সমাবেশে। সেই তোলার ভাগ শুধু সরকারি দলের চেলাচামুণ্ডারাই পায় না, স্থানীয় প্রশাসনও পেয়ে থাকে।
গত বছর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ১০ জেলার মহাসড়কে শ্যলো ইঞ্জিনচালিত তিন চাকার বাহন নছিমন, করিমন, আলমসাধু, ভটভটি না চালানোর নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। কিন্তু অটোরিকশা ও নছিমন চালকদের আন্দোলনের মুখে হাইকোর্টের ওই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পারেনি সরকার। এবার র্যাব-পুলিশ দিয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত কার্যকরের চেষ্টা চলছে। রাজনৈতিক সরকারের এখানেও রাজনৈতিক শক্তি কাজে লাগাতে হবে। সারাদেশে যে বিক্ষোভ হচ্ছে সেখানে সরকারি দলের লোকজনকে অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে। প্রথমেই তাদের আন্দোলনে দলীয় লোকদের অংশগ্রহণ বন্ধ করতে হবে। কাজটা কঠিন।
এইচআর/এমএস