ত্রিদেশীয় ভরসায় বিএনপির ভোটের আগে জোটের চিন্তা
খুলনা- গাজীপুর বা ৫ জানুয়ারির মতো দুষ্টকর্ম থেকে পিছু হটতেই হবে সরকারকে- নিশ্চিৎ বিএনপি। দলটির এমন কনফিডেন্স সাংগঠনিক শক্তিতে নয়- ভারত, চীন, আমেরিকান দাওয়াইতে। শক্তিশালী জোট নিয়ে নির্বাচন করলে আওয়ামী লীগ সরকারে থেকে নির্বাচন করলেও গেলবারের মতো একতরফা কিছু করতে পারবে না বলে ভিনদেশি আশ্বাস মিলেছে। দলের বিভিন্ন পর্যায়ে এমন একটি প্রচারণা, ধারণা ও বিশ্বাস সম্প্রতি বেশ জোরদার। সেই ধারণা ও বিশ্বাসে ভোটের আগে জোট করে শক্তিবর্ধনের চিন্তা করছে বিএনপি।
শোনা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটি বৃহত্তর মোর্চা গঠনের ব্যাপারে সহযোগিতা করছে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস। তুলনামূলক উদারপন্থী দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচনী প্ল্যাটফর্ম গঠনে সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন মার্কিন দূতাবাসের কয়েক কর্মকর্তা।
দেশের কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলছে দূতাবাসের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা। তাদের টার্গেট বি. চৌধুরীর বিকল্পধারা, ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য এবং আসম রবের জেএসডি। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকেও আমলে রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের সাম্প্রতিক তৎপরতা আগের চেয়ে জোরদার এবং অনেকটা ওপেন সিক্রেট। বিএনপির বাইরে আওয়ামী লীগ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও তার ওঠাবসা, দেনদরবার বেড়েছে। এর কিছু খবর গণমাধ্যমেও আসছে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একটি রাজনৈতিক মেরুকরণ গড়তে চান তিনি। সেই লক্ষ্যে কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন। মাঝেমধ্যে আগবাড়িয়ে কিছু বক্তব্যও রাখছেন। খুলনার পর গাজীপুর সিটি নির্বাচন নিয়েও কিছু প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন তিনি। বলেছেন- ভোট জালিয়াতি, কারচুপি, বিএনপি নেতাকর্মীদের ধরপাকড়ের খবরে তার দেশ উদ্বিগ্ন। এসবের সুষ্ঠু তদন্তও দাবি করেছেন বার্নিকাট।
বার্নিকাটের এ ধরনের প্রতিক্রিয়ায় বিরক্ত আওয়ামী লীগ। দলের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছাচাছিলা জবাব দিয়েছেন। বার্নিকাটের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে কী হয়, সেই প্রশ্নও তুলেছেন। অবশ্য বার্নিকাটের পক্ষ থেকে এখনো ওবায়দুল কাদেরের প্রশ্নের জবাব আসেনি।
গাজীপুর নির্বাচনের আগের দিন মার্কিন দূতাবাসের দুই কর্মকর্তা বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেছেন। নির্বাচনের পরদিনও ঐ দুই কর্মকর্তা গুলশানের একটি রেস্তোরাঁয় আলাদা বৈঠক করেন বিএনপি নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে। এর বাইরে ড. কামাল হোসেন, ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।
বারিধারায় আমেরিকান ক্লাবে বসেছেন দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে। এর বাইরে সুশীল সমাজের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে নিয়মিতই বসছেন। এসব বৈঠকের বিষয়বস্তুর সুনির্দিষ্ট তথ্য বাইরে আসছে না। তবে, এসবের উদ্দেশ্য ও সারমর্ম বুঝতে রাজনৈতিক সচেতনদের অসুবিধা হচ্ছে না।
সম্প্রতি ভারত সফর করে আসা বিএনপির প্রতিনিধিরা বার্তা দিয়েছেন দিল্লিও এ রকম কিছুরই পরামর্শ দিয়েছে। চীনা লবির বুদ্ধিও এমনই। বিএনপির সিনিয়র কয়েক নেতা নিয়মিত চীনা শক্তির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আগামী নির্বাচনকে নিরপেক্ষ করার ব্যাপারে ভারতের মতো চীনা সহযোগিতার জন্য ধর্না দিচ্ছেন তারা। কিন্তু চীনের কূটনীতির ধরন ভিন্ন। তারা ভারত বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো কোনো দেশের রাজনৈতিক বিষয়আসয়ে প্রকাশ্য তৎপরতায় নামে না। সব বিষয়েই রয়ে-সয়ে এগোন দেশটির কূটনীতিকরা। তাদের টার্গেট হয় দীর্ঘমেয়াদি।
এদিকে, কারাগার থেকে বেগম খালেদা জিয়ার নামে কিছু চিরকুট আসছে। বিভিন্ন জন এ চিরকুট পাচ্ছেন বলে বাহাদুরি জাহির করা হচ্ছৈ। দলের নেতাদের মধ্যে এ নিয়ে দ্বিমুখী কথাবার্তা চলছে। বেশিরভাগের ধারণা কারাগারে দেখা করতে যাওয়া আত্মীয়-স্বজনদের মাধ্যমে কিছু বিশেষ বার্তা আসতে পারে। মোটেই চিরকুট নয়। এসব বার্তায় তিনি দলকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। এমন কি তা গাজীপুর বিপর্যয়ের পরও। রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল তিন সিটিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে তার গ্রিন সিগনাল রয়েছে।
অন্যদিকে, লন্ডন থেকে তারেক রহমানের বার্তাও প্রচুর। অনেকে তার সঙ্গে দেখা করতেও যাচ্ছেন। ফিরছেন নানা বার্তা ও নির্দেশনা নিয়ে। এক সূত্রে জানা গেছে, ব্রিটিশ আইনজীবী ও হাউজ অফ লর্ডের সদস্য লর্ড কার্লাইলকে বেগম খালেদা জিয়ার লবিংয়ের এজেন্ডা নিয়ে ভারতে আসছেন।
দিল্লিতে এই আইনজীবীর সঙ্গে খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও সিনিয়র নেতাদের বিশেষ বৈঠক হতে পারে। বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত, এ বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরতে ভারতে একটি সম্মেলনও করবেন তিনি। এর আয়োজনে সহযোগিতা করবেন বিএনপির ভারতীয় হিতাকাঙ্খীরা।
আগামী ৩০ জুলাই বেশ ইন্টারেস্টিং তারিখে হতে যাচ্ছে সিলেট, রাজশাহী ও বরিশাল সিটি নির্বাচন। সেদিনই হাইকোর্টে সাজার বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার আপীলের রায়ের তারিখ। স্বাভাবিকভাবেই সেদিন ভোটের চেয়ে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণী রায়ের দিকেই বেশি নজর থাকবে মানুষের। সেই সুযোগে ৩ সিটিতে যা হবার তাই হবে অনেকটা অনায়াসে। এর আগে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে একটি নতুন ট্রেন্ড সম্পন্ন হয়েছে।
রূপসা পাড়ের খুলনার পর তুরাগ পাড়ের গাজীপুরের নির্বাচনী হালচাল দুদিকের জন্যই বিশেষ বার্তা। বিএনপি বুঝে ফেলেছে ৩০ জুলাই পদ্মা, সুরমা ও কীর্তনখোলা পাড়ের রাজশাহী, সিলেট, বরিশালে খুলনা-গাজীপুরের পুনরাবৃত্তি বা তার চেয়েও বেশি কিছু হবে। ক্ষমতাসীনদের মতিগতিও তাই। তারা নিশ্চিৎ এবং আশাবাদী নির্বাচনের নামে যা হয়েছে, হচ্ছে, ভবিষ্যতেও তা-ই হবে। তেমন টু শব্দ হবে না।
যে যতো তর্ক-বিতর্কই করুক নিঃশব্দে নির্বাচনের নতুন মডেল তৈরি হয়েছে খুলনা-গাজীপুরে। ভোটকেন্দ্রে বাড়াবাড়ি, ব্যালটে ইচ্ছেমতো সিল মারা, প্রতিপক্ষের এজেন্টদের গায়েব করে দেয়ার ঘটনা তেমন গুরুতর অপকর্ম নয়। গুণগতভাবে তা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের চেয়ে উত্তম। কারণ ৫ জানুয়ারিতে এসব ছিল না। ভোটই লাগেনি।
খুলনা-গাজীপুরে সে রকম কিছু হয়নি। ভোটগুলো একসাথে করে গুণতে হয়েছে। সেই বিবেচনায় রূপসা-তুরাগপাড়ের নির্বাচন অনেক ভালো হয়েছে। গাজীপুরে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম ২ লাখেরও বেশি ভোটে বিএনপি প্রার্থী হাসানউদ্দিন সরকারকে হারিয়েছেন। এ নির্বাচনের সারকথা এটাই।
এ রকম অবস্থায়ও বিএনপি সামনের তিনটি সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে সিদ্ধান্তে স্থির। এরমধ্যেই আবার বেগম জিয়াকে প্যারোলে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী তার পরিবারের কয়েক সদস্য। শোনা যায় এর অগ্রভাগে রয়েছেন ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার। তাদের আগ্রহে খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি প্রক্রিয়া অনেকদূর এগিয়ে ছিল। কিন্তু জিয়া পরিবারের বাইরে কাউকে বিএনপির নেতৃত্বে আনতে হবে- এই শর্তে বেঁকে বসেন বেগম জিয়া এবং তারেক দুজনই। ভেস্তে যায় প্যারোলে মুক্তি নিয়ে লন্ডন যাবার প্রক্রিয়া।
এরপর তিন মাস পার হয়েছে। বিএনপি তার মুক্তির আন্দোলন এগিয়ে নিতে পারেনি। আবার আইনি লড়াইও এগোয়নি। তবে, খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার ব্যাপারে সরকারের উপর বিদেশি চাপ রয়েছে। এর ফ্রন্টলাইনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি দেশ। ভারত-চীনের ব্যাপারে তেমন তথ্য নেই। তবে, আগামী নির্বাচনে শক্তিশালীভাবে নির্বাচন করার ব্যাপারে রয়েছে দেশ দুটিরই জোর পরামর্শ। তখন পরিস্থিতি পাল্টে যাবে বলে অভয়ও দেয়া হচ্ছে বিএনপিকে।
এসব বিদেশি ভরসায় বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান দুজনই দলকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করার ব্যাপারে এককাট্টা। সেজন্য ভোটের আগে জোট পোক্ত করার ব্যাপারে একমত তারা। যাবতীয় পদক্ষেপও চলছে সেই আলোকে।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/আরআইপি