ডাক্তার বললেন সিজার মাস্ট

মোকাম্মেল হোসেন
মোকাম্মেল হোসেন মোকাম্মেল হোসেন , সাংবাদিক, রম্যলেখক
প্রকাশিত: ১০:৩৪ এএম, ২৬ এপ্রিল ২০১৮

অযুত-নিযুত ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে সুখ্যাতি আছে এমন একটিতে লবণ বেগমের প্রেগনেন্সি টেস্ট করতে দিয়ে পরদিন রিপোর্ট অনতে গেছি। ডেলিভারি সেকশনের ভদ্রলোক ড্রয়ার খুলে একটা সাদা খাম ধরিয়ে দিলেন। বাসায় এসে লবণ বেগমকে বললাম-

: বিসমিল্লাহ বইলা ওপেন করো।
: কেনো! তুমি খোলো নাই?
: না।
: খোলোনি কীজন্য?
: ভাবলাম, গুড নিউজটা তোমার চোখ দিয়াই প্রথম দেখো।

খাম খুলে রিপোর্ট দেখার পর লবণ বেগম আঁতকে উঠল। বলল-
: হায় আল্লাহ রহমানির রাহিম। এইসব কী!
: কী হইছে! রেজাল্ট কি নেগেটিভ?
: রেজাল্ট পজিটিভই আছে। কিন্তু নামে মিলতেছে না। রিপোর্টে লেখা- বিলকিস আক্তার। বয়স আটত্রিশ।
: মনে হয় প্রিন্টিং মিসটেক।
: যে টেকই হোক, তুমি যাইয়া ক্লিয়ার হইয়া আসো।

ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে সেই ভদ্রলোককে বললাম
: ভাই, খামের উপরে সবকিছু ঠিক আছে কিন্তু ভিতরে আরেকজনের বউ ঢুইক্যা গেছে।

ভদ্রলোক আমার কথা শুনে আবাক হয়ে বললেনÑ
: বুঝলাম না!

সবকিছু বুঝিয়ে বলার পর তিনি ব্যস্ত হয়ে কিছুক্ষণ ড্রয়ার হাতড়ালেন। শেষে হতাশ ভঙ্গিতে বললেন-
: মনে হয়, খামে ভরার সময় রিপোর্ট উল্টাপাল্টা হইয়া গেছে। আপনে একটু বসেন। আমি কম্পিউটার থেইকা আরেকটা প্রিন্ট বাইর কইরা দেখি- কন্ডিশন কী?

নতুন প্রিন্ট নিয়ে বাসায় যওয়ার পর লবণ বেগম জানতে চাইলো-
: কী অবস্থা?
আমি বললাম-
: আলহামদুলিল্লাহ!

ডাক্তার যে তারিখ দিয়েছিলেন, তার তিনদিন আগে রাত পৌনে একটার সময় লবণ বেগম যখন-তখন অবস্থায় উপনীত হলো। আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে ভীত গলায় বলল-
: আম্মা আসে নাই?
: আগামীকাল বিকালের ট্রেনে আসবে।
: বড় আপা কোথায়? ওনারে ডাক দেও। আমার দম বন্ধ হইয়া আসতেছে।

বড় আপা এসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বললেন-
: চিন্তার কিছু নাই! ব্যথা উঠছে। দমে দমে আল্লাহর নাম নেও। সবকিছু ঠিক হইয়া যাবে।
এরপর আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে তিনি বললেন-
: এসময় এক চামচ সরিষার তেল খাওয়াইলে উপকার পাওয়া যায়।

আমি জিজ্ঞেস করলাম-
: তেল আছে?
: আছে। জাবদুলের দোকান থেইকা খরিদ করা।

আপার কথা শুনে বললাম-
: তেলে যদি ভেজাল থাকে? ভেজাল মিশাইতে যাইয়া কী না কী মিশাইছে কে জানে! তেল খাওয়ার পর বাচ্চার যদি কোনো ক্ষতি হয়! তেল-ফেল বাদ দিয়া চলো হাসপাতালে যাই।

হাসপাতালে পৌঁছলাম রাত আড়াইটায়। জরুরি বিভাগে পা রাখতেই বয়স্ক এক মহিলা আমাদের পিছু নিল। প্রসূতি ওয়ার্ডে পৌঁছার পর বিভিন্ন বয়সী মহিলার সংখ্যা পাঁচে উন্নীত হলো। এদের আচরণ দেখে বাস টার্মিনালে যাত্রী দখলের দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠছে। পরীক্ষ-নিরীক্ষা শেষে কর্তব্যরত ডাক্তার জানালেন-
: সবকিছু নরমাল আছে, চিন্তার কিছু নেই।

হাসপাতালে রোগী ভর্তির যে প্রক্রিয়া, তা সম্পন্ন করে প্রসূতি ওয়ার্ডের দিকে অগ্রসর হচ্ছি, হঠাৎ লবণ বেগম চিৎকার করে উঠল। জানতে চাইলাম-
: কী হইছে!

পাশে থাকা এক মহিলার দিকে হাত তুলে লবণ বেগম বললÑ : এই বেটি কী সব বাজে কথা বলতেছে!
মহিলার মুখোমুখি হয়ে জানতে চাইলাম-
: আপনে কী বলছেন?
: খারাপ কুনু কথা বলি নাই আব্বা।
: আমি জানতে চাইতেছিÑ আপনে তারে কী বলছেন?
: আপনে এইরকম চেতাচেতি করতেছেন ক্যান? আমি শুধু জিগাইছি- পরিষ্কার হওনের দরকার আছে কিনা? ডেলিভারির আগে এইটা খুবই জরুরি বিষয়।
: কোনটা জরুরি আর কোনটা জরুরি না, এইটা আমরা আপনের চাইতে কম বুঝি না! আপনে যান।
: ওরে আল্লাহ! আপনে যে সুরে কথা বলতেছেন, হাসপাতালের ডাকতরসাবরাও আমার লগে এইরকম কইরা কথা কওয়ার সাহস দেখায় না।
: সাহস দেখায় না, কারণ তাদের স্বার্থ আছে। আপনারা তাদের রোগী ধরার মেশিন হিসেবে কাজ করেন। আমি তো ডাকতর না- আপনেরে আমার ম্যাডাম-ম্যাডাম কইরা কথা কওন লাগবো!
ওয়ার্ডে আসার পর জানতে পারলাম, এ মুহূর্তে কোনো বেড খালি নেই। নিরুপায় হয়ে এক দালালের শরণাপন্ন হলাম। সে জানালো-
: হাসপাতালের এক দারোয়ানের মেয়ের নামে একটা বেড বুকিং দেয়া আছে। তবে সকালবেলা সে আসার পর বেড ছেড়ে দিতে হবে।
তার হাতে দালাল-ফি তুলে দিতে দিতে বললাম-
: রাইতটা আগে পার করি। পরে কী হবে, সেইটা আল্লাহ ভরসা।
ভোরে দারোয়ানের মেয়ে চলে আসায় লবণ বেগম বেডচ্যুত হলো। তাকে সঙ্গে নিয়ে ওয়ার্ডের এ মাথা থেকে ও মাথা ঘুরতে লাগলাম- অবস্থা দেখে যদি কারও করুণা হয়! অবশেষে একজনের দয়া হলো। লবণ বেগমকে তিনি বললেন-
: আপা আসেন। বেড না পাওয়া পর্যন্ত আমার সঙ্গে থাকেন। ভদ্রমহিলা শুয়েছিলেন। লবণ বেগম তার পায়ের কাছে খালি জায়গাটায় বসার পর তার হাতে পুশ করা স্যালাইনের ব্যাগ রডের সঙ্গে বাঁধতে বাঁধতে বললাম-
: বুঝলা, একটা বিষয়ে ইউনির্ভাসিটির আবাসিক হল আর সরকারি হাসপাতালের মধ্যে মিল আছে। সেইটা হইল, ডাবলিং।
ঘন্টা দুয়েক বাদে ভদ্রমহিলার স্বামী এসে খুব রাগারাগি শুরু করলেন। স্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বললেন-
: আমি এতো কষ্ট কইরা একটা সিট ম্যানেজ করছি আর তুমি জোড়া বাইন্ধ্যা বইসা রইছো। খাইয়া আর কাম পাইছো না?
এখান থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর লবণ বেগমের মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। কোনোমতে তাকে বললাম-
: বাইরে অতি চমৎকার হাওয়া বইতেছে। চলো, আমরা বারান্দায় যাইয়া বসি।

লবণ বেগমের হাতে পুশ করা স্যালাইন শেষ হয়ে আসছিলো। ওয়ার্ডে কোনো নার্সের দেখা না পেয়ে নার্সদের জন্য নির্দিষ্ট রুমে প্রবেশ করলাম। কয়েকজন নার্স গোল হয়ে বসে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সব ইস্যু নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছিলেন। একজনকে লক্ষ করে আমি বললাম-
: সিস্টার! নতুন স্যালাইন দেওন লাগব। আমার সঙ্গে চলেন।
আসছি বলে নার্স আমাকে বিদায় করে দিলেন। ফেরার সময় দেখি, মলিন বেশভূষার এক লোক হেঁচকি তুলে কাঁদছে। কেউ মারা গেছে ভেবে পাশ কাটিয়ে চলে আসতে গিয়েও নরম সুরে জানতে চাইলাম-
: ভাই! কী হইছে!
লোকটা কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলল-
: আমার সর্বনাশ হইয়া গেছে। আমারে মার্ডার কইরা ফেলছে!
: ঘটনা কী!
: আমার সব ওষুধ চুরি হইয়া গেছে। বউয়ের সিজার করাইতে একজনের কাছ থেইকা ডাবল সুদে দশ হাজার টাকা ঋণ কইরা ওষুধ কিনছিলাম। সেই ওষুধ বিছানার নিচে রাইখা ডাকতরসাবরে ডাকতে গেছি। আইসা দেখি, ওষুধ নাই।
: ডাকতরসাবদের জানান নাই?
: জানাইছি। একটা বিহিত করার লাইগা তাদের হাতে-পায়ে ধইরা কতো কান্দাকাটি করলাম! লাভ হয় নাই। বউয়ের পেটে বাচ্চা উল্টা মাইরা রইছে। অপারেশন না করলে বউ-বাচ্চা দুইডাই মরবে।
: আল্লারে ডাকেন।
লোকটার সামনে থেকে বারান্দায় চলে এলাম। আর কয়েক ফোঁটা আছে। এরপরই স্যালাইন শেষ হয়ে যাবে। আবার দৌড় দিলাম নার্সের উদ্দেশ্যে। সর্দারনী গোছের একজন নার্স ধমক দিয়ে বললেন-
: হাসপাতালে আইসা এতো অস্থির হইয়া পড়েন কেনো? এইটা অস্থির হওয়ার জায়গা না!
ধমক খেয়ে ফিরে এলাম। লবণ বেগমের কাছে গিয়ে দেখি- স্যালাইনের নল দিয়ে রক্ত উঠা শুরু হয়েছে; সে হাউমাউ করে কাঁদছে। দৌড়ে গিয়ে নার্সকে বললাম-
: সিস্টার, স্যালাইনের নল দিয়া ব্লাড উঠতেছে।

নার্স ধমক দিয়ে বললেন-
: আগে বলেন নাই কেনো?
: এই নিয়া আপনের কাছে তিনবার আসলাম।
: ব্লাডের কথা তো স্পষ্ট কইরা কিছু বলেন নাই! যা বলার স্পষ্ট কইরা বলতে হয়। এতো হৈচৈয়ের মধ্যে বিড়ালের মতো মিউ-মিউ করলে কিছু বোঝা যায়?
: মিউ-মিউ না কইরা জোরে হুংকার দিলে উপায় আছে? সবাই জোট বাইন্ধা দাঁত-নখ দিয়া তারে ফালা-ফালা কইরা ফেলবেন না?
: কী বললেন?
: বলছি- আপনে দয়া কইরা তাড়াতাড়ি আমার সঙ্গে চলেন।
সন্ধ্যার পর বেড জুটলো। উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর অজানা ভবিষ্যতের পানে তাকিয়ে সারারাত পার করার পর ভোরবেলা ডাক্তার জানালেন-
: সিজার করতে হবে।
ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললাম-
: এক ঘন্টা আগেও আপনেরা বললেন, সবকিছু নরমাল আছে। আর এখন বলতেছেন অপারেশন লাগবে। বিষয় বুঝলাম না!

আমার কথায় বেজার হয়ে ডাক্তার উঁচুগলায় জানতে চাইলেন-
: ডাক্তার আমি, না আপনি?
: আপনে ডাকতর।
: তাহলে আমার কথার ওপর কথা বলছেন কোন সাহসে? আমি বলছি- সিজার মাস্ট। রোগীর প্রেজেন্ট কন্ডিশন এটাই বলছে।
ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে ডাক্তারের উদ্দেশে বললাম-
: স্যরি আপা। আমি এক্সট্রিমলি স্যরি। দিস ইজ মাই ফার্স্ট টাইম। তবে হাসপাতালে আসার পর যে ফুলকোর্স শিক্ষা পাইলাম- এই শিক্ষা ভবিষ্যতে আপনাদের সঙ্গে যে কোনোরকম বেয়াদবি করা থেইকা আমারে বিরত রাখবে, ইনশাআল্লাহ।
: লেকচার বাদ দিয়া দশ মিনিটের মধ্যে এই মেডিসিনগুলো নিয়া আসেন।
স্বাভাবিক প্রসবের জন্য দরকারি ওষুধের যে তালিকা হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করা হয়েছিলো, সেগুলো কিনে রেখেছিলাম। আগের ওষুধসহ নতুন তালিকা নিয়ে ফার্মেসিতে গেলাম। দোকানদারকে বললাম-
: নরমাল কেইসের ওষুধ রিটার্ন নিয়া আমারে অ্যাবনরমাল কেইসের ওষুধ দেন।
কোনো ভূমিকা না করে দোকানদার জানতে চাইলো-
: আপনেরে সিজারে কনভার্ট করছে?

বেদনামিশ্রিত হাসি উপহার দিয়ে তাকে বললাম-
: আপনাদের কথা ভাইব্যা, ওষুধ কোম্পানির কথা ভাইব্যা, ডাকতর-ম্যাডাম তার নিজের পার্সেন্টেজ, পদোন্নতি, বোনাস ইত্যাদির কথা ভাইব্যা, সর্বোপরি দেশের জনসংখ্যা সেক্টরের কথা ভাইব্যা আমার কেইসটারে নরমাল থেইকা অ্যবনরমালে উন্নীত করছেন।

আমার কথা ফুঁ মেরে উড়িয়ে দিয়ে দোকানদার বললেন-
: মনের মধ্যে কোনো কুচিন্তা ঠাঁই দিবেন না। ডাক্তার হচ্ছেন সেকেন্ড গড। জীবন-মৃত্যুর ব্যাপারে আল্লাহর পরেই তাদের অবস্থান। কাজেই তারা যেটা উপযুক্ত মনে করেন, সেটাই করবেন।
দোকানদারের কথার উত্তরে কাষ্ঠহাসি হেসে বললাম-
: জি।

লেখক : সাংবাদিক, রম্যলেখক

এইচঅঅর/আরআইপি

‘লোকটা কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলল- : আমার সর্বনাশ হইয়া গেছে। আমারে মার্ডার কইরা ফেলছে! : ঘটনা কী!’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।