আমাদের অস্বাস্থ্যকর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা
খুবই মুখস্ত তিনটি দৃশ্যের কথা বলবো। প্রথমটিতে ধরে নিন দেশের যেকোন প্রান্তের একটি সরকারি হাসপাতাল। ঢুকতেই দেখবেন হাতের ডান বায়ে কোথাও একটি, কোথাও একাধিক ভাঙ্গা গাড়ি পড়ে আছে বছরের পর বছর। ভালো করে লক্ষ্য করলেই বুঝবেন এগুলো অ্যাম্বুলেন্স। শুরুতেই অব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। সবখানেই একই পরিস্থিতি। শয্যা সংখ্যা ৫০ হোক আর ৫০০ হোক, শুরুতেই শুনবেন সিট নেই। তার পর যে কোনো সূত্রে প্রভাব সৃষ্টি করে আপনাকে শয্যা পেতে হবে।
এই যে সূত্র বা তদবির যাই বলেন না কেন, এদিক দিয়ে সবচেয়ে এগিয়ে দেখবেন ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীরা। একেকজন একেক জনের চেয়ে প্রভাবশালী। আরেকটু দাঁড়ালে হাসপাতালকে ঘিরে নানা চক্রের সন্ধান পাবেন। যারা নিয়ন্ত্রণ করছে হাসপাতালের শয্যা, গাড়ি এমন কী ভাড়া গাড়ি পর্যন্ত। খোঁজ নিলেই জানবেন এদের বেশিরভাগই ধনী পর্যায়ের টাকা ওয়ালা। এরা প্রত্যেকেই জড়িত হাসপাতালের কর্মচারীদের কোনো সংগঠনের সঙ্গে।
প্রতিটি হাসপাতালে আউটডোর বলে একটি জিনিস আছে, যেখানে সাধারণ একটা একটা টিকিট কেটে যেকোন রোগের চিকিৎসা করার কথা। সেখানে চিকিৎসক পাওয়া রীতিমত ভাগ্যের ব্যাপার। কারণ নানা যদি’ এর পথে আপনাকে হাঁটতে হবে.. ধরুন যদি স্যারের কোন বিশেষ কাজ না থাকে, যদি কোন বিনোদনের মধ্যে না ঢুকে থাকেন, এমন কী যদি তিনি হাসপাতালে এসে পৌঁছে থাকেন, তবে একটা লাইনে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবেন।
কিন্তু একটা এখনো বাকি, সেটা হচ্ছে যদি আপনি তদবির করে এসে থাকেন তাহলে লাইনে দাঁড়াতে হবে না। আগেই ইশারা পেয়ে যাবেন। তবে ওষুধ কিন্তু নেই। বেশিরভাগ ওষুধ আপনাকে কিনতে হবে হাসপাতালে বাইরের রমরমা বাজার থেকে। এর মধ্যে হয়তো কালেভাদ্রে পত্রিকায় খবর পাবেন ‘হাসপাতালের সামনের দোকান থেকে সরকারি ওষুধ জব্দ, স্টোরকিপার গ্রেফতার’।
এবার দ্বিতীয় দৃশ্য। ব্যস্ত জেলা অথবা উপজেলা শহর, চারদিকে আবাসিক ঘরবাড়ি। এর মধ্যে গড়ে ওঠা একটি মধ্যম মানের বেসরকারি ক্লিনিক। যদিও নামের সঙ্গে লেখা হাসপাতাল। ভবন বানানোর সময় থাকার বাসাবাড়ির উপযোগী করে বানানো হয়েছিল। এখন রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। একদিকে ডাক্তারদের দীর্ঘ তালিকা এবং ছোট ছোট খুপরি। অন্যদিকে আবাসিক রোগীদের ওয়ার্ড।
সারাক্ষণ সব ধরনের মানুষের যাওয়া আসা। ক্লিনার–নার্সে ঠাসা। হাঁটতে গেলে কারো না কারো সঙ্গে ধাক্কা লাগবেই। রোগীদের কেবিন নামের খুপরিতে ঢুকে দেখা যাবে ময়লা বালিশ, চাদর দেয়া বিছানা। এক পাশে শুয়ে আছেন রোগী, অন্যপাশে লাইন দিয়ে বসেছেন স্বজনেরা। যেখানে সেখানে গড়াগড়ি খাচ্ছে অন্য রোগীর ব্যবহৃত স্যালাইনের খোসা, সিরিঞ্জ ওষুধের স্ট্রিপ।
খোঁজ নিয়ে দেখবেন তালিকায় যাদের নাম আছে, তাদের বেশিরভাগই বসেন না। কিন্তু তাদের কথা বলে সমস্যা বুঝে সিরিয়ালে নাম লেখানো হয়। সন্ধ্যায় রোগী আসলে কোন একটা অজুহাত দিয়ে সেই অখ্যাত চিকিৎসকই চিকিৎসা দেন। এদের কেউ কেউ যে সম্প্রতি আলোচিত ভুয়া সার্টিফিকেটধারী নন তার নিশ্চয়তা পাওয়া পাওয়া যাবে না।
বেসরকারি এসব হাসপাতালের নিচে নেমে একটু খেয়াল করলেই দেখবেন কিছু মোটরসাইকেলধারী ঘুরছেন আশপাশে। এরা আসলে ওই হাসপাতালের মার্কেটিং এ কাজ করেন। দূর দূরান্তে চলে যান হাসপাতালের প্রচারে। পাশাপাশি ওইসব এলাকার ডাক্তারদের সঙ্গে চুক্তি করে ফেলেন। একটা রোগী পাঠালে কোন ডাক্তারের মোবাইলের কত পার্সেন্ট পৌঁছাবে সেই দরকষাকষী করেন এই মোটরসাইকেলধারীরাই।
এই হাসপাতালগুলোর আশপাশেই দেখবেন জমে আছে রাজ্যের চিকিৎসা বর্জ্য। একটা শহরে এ রকম ১০টা হাসপাতাল থাকলেই যথেষ্ট পরিবেশ নরকীয় করার জন্যে। সুখের খবর হচ্ছে বাংলাদেশের প্রতিটি শহরে এ রকম হাসপাতাল ১০টা তো বটেই কোন শহরে এর চেয়ে বেশি আছে। আর তার চেয়ে বেশি আছে ডায়াগনস্টিক সেন্টার। যাদের কাজ যতটুকু স্বাস্থ্য পরীক্ষা তার চেয়ে বেশি মধ্যম মানের বেসরকারি হাসপাতালের মার্কেটিং।
এবার আসেন তৃতীয় দৃশ্যে। মূলত রাজধানী, কখনো কখনো দু’একটি বিভাগীয় শহরে যেতে হবে এ রকম দৃশ্য দেখতে। বাইরে থেকে দেখতে তারকা মানের হোটেল। চকচকা প্রহরীর কড়া পাহারা এবং কয়েক দফা লিখিত এবং মৌখিক সাক্ষাতকার দিয়ে আপনাকে পৌঁছাতে হবে ভেতরে। জি পাঠক এটি একটি অত্যাধুনিক মানের বেসরকারি হাসপাতাল। পরীক্ষা-নিরীক্ষা অস্ত্রোপচার চিকিৎসা সব ব্যবস্থাই এখানে আছে।
দেখবেন এখানে রোগী হিসেবে যারা আছে শুরুতেই তাদের দিয়ে দিতে হয়েছে আয় বিবরণী। অর্থাৎ কর্তৃপক্ষ আপনাকে চিকিৎসা দেয়ার শুরুতে নিশ্চিত হয়ে নেবে, কাটার মতো গলা আপনার আছে কি-না। অন্যভাবে যদি বলি, বিষয়টা এ রকম দাঁড়ায় যে, এখানে শুরুতেই কোন রোগীকে বার্তা দিয়ে দেয়া হয় ‘এখানে আপনার গলা কাটা হবে কোন সন্দেহ নেই’। যার টাকা নেই তার হাসপাতাল এটি নয়। তবে হাসপাতালে আপনি চিকিৎসা ভালো পাবেন। দেশি বিদেশি গুণী চিকিৎসকের সান্নিধ্য পাবেন। শুধু নিজেকে মানুষ ভাববেন না। কারণ এখানে কোনভাবেই মানুষ মুখ্য নয়, মুখ্য তার আর্থিক অবস্থা।
পাঠক এতক্ষণ ধরে বলার চেষ্টা করলাম বাংলাদেশের মানুষের তিন স্তরের চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা। আমি মোটামুটি নিশ্চিত যারা বাংলাদেশের মানুষ তারা সবাই আমার সঙ্গে একমত। এও জানি যে আপনাদের কাছে স্বাস্থ্য অব্যবস্থাপনার আরও সব ভয়ঙ্কর তথ্য আছে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় পাতায় এসব খবর চকচকে ভাষায় ছাপা হয়। টেলিভিশনের রিপোর্টার বন্ধু ছবি দিয়ে কথা বলান।
আপনারা জানেন যে, অব্যবস্থাপনার চিত্র এটি কিন্তু এক দিনের নয়। দিনের পর দিনের। যতদিন যাচ্ছে এই অব্যব্যবস্থাপনা আরও বাড়ছে। শহরগুলো হয়ে উঠছে হাসপাতাল ক্লিনিক আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারের শহর। আমার তো মনে হয় গণমাধ্যমে কোন অব্যবস্থাপনার চিত্র প্রচার হয়, আর কোন একজন ব্যবসায়ী ভাবেন আরে আমি কেন পিঁছিয়ে পড়ছি? আরে বিনা বাঁধায় এ রকম অনিয়ম আর কটা হয়?
আমি তো বলতে চাই আমাদের দেশের বেসরকারি স্বাস্থ্য খাত হচ্ছে সহজে টাকা তৈরির মেশিন। কেউ কিচ্ছু বলবে না। শুধু মাঝে মধ্যে ক্ষমতার আশে পাশে ঘোরা কিছু কাক আসবে। কা কা করবে, তাদের সামনে এক মুষ্টি আধ-মুষ্টি ছিটিয়ে দিলেই হবে। খারাপ কী?
কেউ কেউ ভাবতে পারেন আমি বোধ হয় বেশি বলে ফেলছি। মোটেও নয়। অনেক কম বলছি। বাস্তবতা আরও ভয়াবহ। পাঠক চিন্তা করুন আমাদের দেশের মানুষের যে কোন রোগ হওয়া মানেই তার জীবনে নেমে এল দুর্যোগ। রোগ যত জটিল, জীবন তত জটিল হতে থাকলো। ক্যান্সারের মতো রোগ হলে তো রক্ষা নেই। পথে বসে গেলো গোটা পরিবার। খুব স্বাভাবিকভাবে পরিবার চেষ্টা করে মানুষটিকে সুস্থ্য করার। এক পর্যায়ে সেই চেষ্টায় যুক্ত হয় আত্মীয় বন্ধু-বান্ধব প্রতিবেশী। যোগাযোগ থাকলে সরকারি আর্থিক সহায়তাও পাওয়া যায় কোন কোন ক্ষেত্রে।
সবাই এগিয়ে আসে। কিন্তু এগোয় না আমাদের ব্যবস্থাপনা। অথচ এত কিছুর দরকারই হয় না যদি না ব্যবস্থানাটি সুষ্ঠু হতো। যদি উত্তর থাকতো কে দিচ্ছে এই ব্যবসার অনুমতি? কে ঠিক করছে চিকিৎসা সেবার দাম ? এর সঙ্গে আমার দেশের মানুষের আর্থিক সক্ষমতার সম্পর্ক কতটুকু? আমি জানি এসব প্রশ্নের উত্তর নেই। আমাদের স্বাস্থ্যসেবা আটকে আছে স্বাস্থ্য ব্যবসার ঘেরাটোপে। তবু বলার জন্যে বললাম আর কী।
লেখক : বার্তা সম্পাদক একাত্তর টেলিভিশন।
palash_ahasan2003@yahoo
এমআরএম