খালেদা তত্ত্বাবধায়ক ছাড়লেন, ছাড়লেন না
আলোচনাটা আসলে থেমে যায়নি কখনোই। তার কারণ হয়তো টানা রাজনৈতিক অস্থিরতা আর সহিংসতায় ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে পড়েছিলো খোদ ২০ দলীয় জোট। ছোটখাটো পরিসরে মূলত বিএনপি নেতারা বিচ্ছিন্নভাবে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার কথা বলে চলেছেন ঠিকই। কিন্তু বড় পরিসরে এই আলোচনা ফিরে আসলো শনিবার সন্ধ্যায়। গুলশান কার্যালয়ে এই আলোচনা ফের চাঙ্গা করলেন বিএনপি নেত্রী। খালেদা জিয়ার ভাষাতেই, `আমি বলব না, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। যে নামেই হোক একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আমরা দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চাই।`
বেশ কয়কটি গণমাধ্যমেরই শিরোনাম, `তত্ত্বাবধায়কের দাবি থেকে সরে আসলেন খালেদা জিয়া।` ঠিক একই ধরনের বিশ্লেষণ করতে শোনা গেছে মধ্যম সারি থেকে শুরু করে বিশিষ্ট থেকে বিশিষ্টতর রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কণ্ঠেও। আসলেই কি খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়কের দাবি থেকে সরে এসেছেন? তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি নিরপেক্ষ সরকারব্যবস্থারই ধারণা নয়? নাকি ভিন্ন কিছু? নাকি `তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা` আর `নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা` ভিন্ন দুইটি ধারণা? বিএনপিপ্রধান এবং তাঁর উপদেষ্টারা কি সেটিই বোঝাতে চাইছেন? সেটা হওয়ার কথা নয়। বাংলাদেশে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার চরিত্র বিশ্লেষণ করলে সেটিকে নিরপেক্ষই বলতে হবে। যদিও রাষ্ট্রপতি থেকে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেয়া অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টার নিরপেক্ষতা এবং সর্বজন গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে বরাবরই। সেই বিতর্ক এখনো টেনে লম্বা করার দরকার নেই। মূল প্রসঙ্গে ফিরি।
তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী না বুঝেই `তত্ত্বাবধায়ক নয়, যে কোনো নামে নিরপেক্ষ সরকার`-এর কথা বলেছেন, এটা বোকারাই ভাবতে পারেন। মাঠের আন্দোলনে পরিপক্কতা দেখাতে না পারলেও বিএনপির থিংক ট্যাঙ্ককে রাজনৈতিক জ্ঞানশূন্য ভাবার অবকাশ নেই। বরং ওই থিংক ট্যাঙ্ককে এমন কয়েকজন আছেন যাঁরা রাজনৈতিক ভাষার সূক্ষ্ম ব্যবহারে যথেষ্ট পারঙ্গম। তাঁরা হয়তো শুধু `তত্ত্বাবধায়ক` শব্দটিতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে শব্দের রাজনীতিতে জয়-পরাজয়ের হিসেব কষছেন। তাতে খুব একটা দোষের কিছু নেই। টানা চার বছর ধরে যে দল কিংবা জোট একটা অবস্থানে অনড় সেখান থেকেতো অ্যাবাউট টার্ন করতে পারে না! তাতে যে প্রকাশ্যেই তাদের রাজনৈতিক পরাজয় ঘটে। এই ভাবনার পেছনে কারণও আছে বৈকি।
সেই ব্যাখ্যায় যেতে হলে খানিকটা পেছনে ফিরতে হয়। বর্তমান সঙ্কটের শুরু ২০১১ সালে। ওই সময় সংবিধান সংশোধন করে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি প্রবর্তিত নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছিলো। ২০০৬ সালে তিন মাসের একটি নির্দলীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনে ব্যর্থ হয়ে সেনাসমর্থনে দুই বছরের জন্য ক্ষমতায় থাকে তত্ত্বাবধায়কের আদলে একটি সরকার। সেই সরকারের অভিজ্ঞতা থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকার। আওয়ামী লীগের সাফ কথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আর ফিরতে দেয়া হবে না। জাতীয় নির্বাচন হবে নির্বাচিত সরকারের অধীনেই।
বিএনপিও নাছোড়বান্দা। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তারা না মানায় ১৯৯৬ সালে মাত্র পাঁচ মাসে প্রাণ গিয়েছিলো ৮২ জনের, সেই তত্ত্বাবধায়কের দাবিতেই চার বছর ধরে অনড় তারা। বিএনপি জোটের এই রাজনৈতিক অবস্থানের খেসারতটাও অনেক। জোট বললে ভুল হবে। আসলে বিএনপির ইচ্ছাই যে ২০ দলীয় জোটের শেষ কথা তা বুঝিয়ে বলতে হবে না কাউকে। কি হলো তাদের এই অনড় অবস্থানের ফল? চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি থেকে টানা ৯২ দিনের অবরোধ আর থেমে থেমে দেয়া হরতালের আগুনে পুড়েছে দেশ। প্রাণ গেছে ১৩৭ জনের। হিসেবটা কিন্তু এতটুকুই না। ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫৯ জন নিহত হন। চাইলের আরো আগের অনেক মৃত্যুর খতিয়ানও টানা যায়। তাতে আলোচনা কেবল দীর্ঘই হবে না, সামনে তুলে আনা হবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক হানাহানির কদর্য দিকটি।
আপাতত হিসেবের খাতা থেকে চোখ ফেরাতে চাই। ফিরতে চাই তত্ত্বাবধায়ক কিংবা নিরপেক্ষ সরকারের আলোচনায়। শনিবার খালেদা জিয়া`র বক্তব্যের বিশ্লেষণ এরইমধ্যে হয়ে গেছে নানা মহল থেকে। কেউ বলছেন, সঙ্কট উত্তরণে বেগম জিয়া নাকি এক কদম অগ্রসর হয়েছেন। কারো মতে, বিএনপিপ্রধানের বক্তব্য বাস্তবোচিত। কিন্তু এটি নাকি তার বিলম্বিত বোধোদয়। এই বক্তব্যকে সরকারের সঙ্গে বিএনপি`র আপোসরফার ইঙ্গিত হিসেবেও বর্ণনা করা যায় সহজে। তাই যদি হয়ে থাকে, তাকে কি বিলম্বিত বোধোদয় বলা চলে? মোটেও না। কারণ আপোসরফার ইঙ্গিতটা আসলে মিলেছিলো বছর দুয়েক আগেই। তাও শুধু খালেদা জিয়া`র একার তরফ থেকে নয়। বরং শেখ হাসিনার তরফ থেকেই আগে পাওয়া গিয়েছিলো।
২০১৩ সালের ১৮ অক্টোবর নির্বাচনকালীন একটি সরকার ব্যবস্থার ধারণা দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। সব দলের সমন্বয়ে সর্বদলীয় সেই সরকারের মন্ত্রিসভায় বিরোধী দলের সদস্যদেরও রাখার প্রস্তাব করেন তিনি। তার প্রস্তাব অনুযায়ী নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীই থাকবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে। মূলত সেই রূপরেখাতেই আয়োজন করা হয় ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
কিন্তু রাজনৈতিক রেষারেষিটা আসলে জাতীয় পর্যায়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছিলো ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে। সে কারণেই শেখ হাসিনা`র দেয়া আপোসরফামূলক রূপরেখা মেনে নিতে পারেননি খালেদা জিয়া। স্পষ্ট ভাষাতেই বলেছিলেন, শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন তিনি মেনে নেবেন না। তাঁর সেই মনোভাবই পরে বিএনপি এবং ২০ দলীয় জোটের বক্তব্য হিসেবে প্রচার করা হয়।
তবে খালেদা জিয়াও যে পুরোপুরি গো ধরে বসেছিলেন তা কিন্তু নয়। দু`দিন বাদেই ২১ অক্টোবর পাল্টা রূপরেখা দেন তিনি। ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায় সরকারের ২০ উপদেষ্টার মধ্য থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাঁচজন করে নাম দেবে। তারাই হবেন নির্বাচনকালীন সরকারের উপদেষ্টা। ঐকমত্যের ভিত্তিতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন হবেন ওই সরকারের প্রধান। সেদিন খালেদা জিয়া তাঁর বক্তব্যে সচেতনভাবেই `নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার` গঠনের কথা বলেননি। কাজেই এটা বলার কোনো সুযোগ নেই যে, খালেদা জিয়া বা বিএনপি চার বছর পর তত্ত্বাবধায়কের দাবি থেকে সরে এসেছে। বরং দুই বছর আগেই তারা বুঝিয়ে দিয়েছিলো তত্ত্বাবধায়ক নয় সমঝোতার ভিত্তিতে যে কোনো একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনই তাদের মূল দাবি।
এই যে দুই প্রধান নিজেদের অবস্থান থেকে কিছুটা সরে গিয়ে সর্বদলীয় কিংবা সমঝোতার নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার রূপরেখা দিয়েছিলেন তা কিন্তু মেনে নেননি তাঁরা। এর কারণটাও কারও অজানা নয়। পরমতসহিঞ্চুতার অভাব আর পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থেকে জন্ম নেয়া অবিশ্বাসই দেশের প্রধান দুই দলকে রাজনৈতিকভাবে একটি সরল রেখায় দাঁড়াতে দিচ্ছে না। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের ফল নাকচ করেছিলো বিএনপি। ১০ উপদেষ্টাকে তারা নিরপেক্ষ মনে করেনি। একইভাবে ২০০১ সালের নির্বাচনের ফল নাকচ করে আওয়ামী লীগ। তারাও ওই সময়ের উপদেষ্টাদের নিরপেক্ষ মনে করতে পারেনি।
এ কথা স্বীকার করতেই হবে, জ্বালাও পোড়াওয়ের রাজনীতিতে সরকার নত না হওয়ায় এবং ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার প্রায় দেড় বছর পার করে দেয়ায় অনেকটা হতাশ হয়ে পড়েছে বিএনপি`র শীর্ষ নেতৃত্ব। সম্প্রতি দল পুনর্গঠন করে শিগগিরই অহিংস আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণাও এসেছে কয়েক দফায়। কিন্তু তাতে খুব একটা আগ্রহ বোধ করেনি সাধারণ মানুষ। আর সরকারতো বুঝেই গেছে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল বিএনপি`র পক্ষে সহসাই বড় ধরনের সরকারবিরোধী আন্দোলনে যাওয়া সম্ভব না। এ কারণেই হয়তো পুরোনো আপোসরফার বিষয়টি নতুন করে ঘুরপাক খাচ্ছিলো বিএনপি`র থিংক ট্যাঙ্কে। তা না হলে একইদিনে গুরুত্বপূর্ণ দুইটি স্থান থেকে প্রায় একই ধরনের বক্তব্য কেন আসবে? শনিবার সকালেই সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি`র এখনকার মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন সরকারকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানান। আর সন্ধ্যায় খোদ খালেদা জিয়া বললেন, তত্ত্বাবধায়ক নয় যে কোনো নামে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চান তিনি। স্পষ্টতই বিএনপি এখন নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিটিকেই সামনে নিয়ে আসতে চাইছে। যে নির্বাচনকে বিএনপি`র ভাষায় বলতে হবে সুষ্ঠু, অবাধ ও সব দলের জন্য গ্রহণযোগ্য। এটি অবশ্য সব মহলেরই চাওয়া। কারণ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে আর যাই বলা যাক, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন বলা যায় না। তাই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবির সঙ্গে বিএনপি`র নতুন জোর `প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন`।
প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের অবস্থানে বিএনপি হয়তো নতুন করে ভাবছে। সেক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তে যে কোনো নামে নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থার দাবি রাজনীতির ভবিষ্যত গতিপথকে কোন দিকে নিয়ে যাবে- তা এখনই বলার সময় হয়নি। কারণ প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন হলেও একটি নির্বাচন কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার তার অধীনে করে ফেলেছে। সেই সরকার দেড় বছর পার করে দেয়ার পরও যখন বিরোধী শিবির সরকারকে কোনো বেকায়দায় ফেলতে পারেনি তখন আওয়ামী লীগের শীর্ষ মহলে আত্মতুষ্টির সঙ্গে আত্মবিশ্বাস জন্ম নেয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অন্যদিকে, রাজনৈতিক জয় পরাজয়ের হিসেব নিকেশে বিএনপি আসলে কতটা ছাড় দেবে তা নিশ্চিত করে বলা চলে না। তাই এখনই এই সিদ্ধান্তে আসাটা ঠিক হবে না যে, খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নিরপেক্ষ সরকারের মধ্যে অর্থগত কোনো তফাৎ প্রায় খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। হয়তো গঠনগত কোনো পার্থক্য আসতে পারে।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, এসএটিভি
[email protected]
এইচআর/এমএস