একাত্তরের চেতনার প্রতীক প্রিয়ভাষিণী

রাজীব মীর
রাজীব মীর রাজীব মীর , লেখক
প্রকাশিত: ১০:৩৩ এএম, ০৮ মার্চ ২০১৮

মুক্তিযোদ্ধা-ভাস্কর-অধিকারকর্মী ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী।এদেশের মানুষের কাছে আজন্ম শ্রদ্ধেয়, অনুকরণীয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মর্মস্পর্শী নির্যাতন নিপীড়নের শিকার এ মহীয়সী নারী আর নেই। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্মম নিষ্পেষণে মুক্তিকামী জনগণকে নিদারুণ দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছিলো। বুকের রক্ত আর নারীর শরীর নিয়ে তারা যাচ্ছেতাই ব্যবহার করেছিলো। ধর্ষণ, গণধর্ষণ এর মত পাপাচারের নিকৃষ্টতায় পাকি বাহিনী বাঙালী নারীদের ক্ষত-বিক্ষত করেছিলো। মৃত্যুর মুখে নিপতিত হয়েছিলো অসংখ্য নারী-পুরুষ।

বেয়নেটের তীব্র আঘাত উপেক্ষা করে মুক্তিবাহিনীর দামাল ছেলেরা বুক ভরা সাহস নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো পশ্চিম পাকিস্তানী দানবদের বিরুদ্ধে। নয়মাস দুঃখ যন্ত্রণা বেদনার ধারাবাহিকতা শেষে অবশেষে বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হলো। স্বাধীন দেশে মানুষের বিজয়োল্লাসের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামে সুন্দর একটা রাষ্ট্র গঠিত হলো। কিন্তু এই উল্লাসের নিচে চাপা পড়ে গেলো ইজ্জত-সম্মাণ হারানো হাজারো মা বোনের আকুতি এবং আর্তি।

দেশ স্বাধীন হলে মুক্তিযোদ্ধারা স্বীকৃতি পেলো। অত্যাচারিত নারীরা নাম পেলো বীরাঙ্গনা। বৈষম্য শেষ হলো না। বীরাঙ্গনা নামের মধ্য দিয়ে তারা আর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেলো না। নিগৃহীত একাত্তরের মহীয়সী নারীগণও লোক লজ্জার ভয়ে স্বীকৃতির দাবিতে এগিয়ে আসলেন না বরং পরিবার-সমাজের কটূক্তির ভয়ে কুণ্ঠিত হয়ে রইলেন।

দীর্ঘ সময় পর একজন নীরবতার কুন্ডলি ভেঙে বেরিয়ে আসলেন। আত্মপরিচয় যখন সম্মানের তখন লুকিয়ে থাকার মানে হয় না, তিনি উপলব্ধি করলেন। নিজের যুদ্ধ-স্মৃতি ও কষ্টের কথা, পাকবাহিনীর ধর্ষণ ও অত্যাচারের নির্মমতা নিয়ে তার নিজের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। স্বাধীন দেশে এরকম অসংখ্য নির্যাতিত নারীর প্রতীক হিসেবে আমাদের সামনে হাজির হলেন ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী।

সমাজের কূপমন্ডুকতা ও স্বাধীন দেশের মানুষের করুণ মানসিকতা প্রশ্নবিদ্ধ করে একাত্তরকে জিইয়ে তুললেন নতুন অবয়বে। সাহসের প্রাচীর টপকালেন আপন আলোয়। বাংলাদেশ তার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান এর নতুন ইতিহাস অবলোকন করলো। হাজার হাজার নারীর মধ্যে সাহস সঞ্চার হলো। শক্তির প্রাচুর্যে একা নারীও যে নিঃসঙ্গ নয়, সেটা প্রমাণিত হলো।

মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন হয়েছিলো ঠিক, মানুষের মন স্বাধীন হয়নি। আর না হলে দেশের জন্য ত্যাগ শিকার করা সেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা নারীরা কেন মুখ খুলতে পারল না আজও। ত্যাগের ইতিাস তো এক-দুজন নারীর নয়। আমরা চিনতে পারলাম কয়জনকে। কতজন আমাদের দ্বারা সম্মানিত হলেন, সেগুলো বড় এক প্রশ্ন বটে। কিন্তু আশার কথা হলো ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী পরিবারের সাথে যুদ্ধ করে প্রকাশ্যে এলেন। সমাজ এর কটূক্তি উপেক্ষা করে কথা বললেন। আমরা জানলাম এক বীর মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগ ও অসংখ্য নাম না জানা নারীর প্রতি বীভৎসতার বয়ান।

jagonews24

অবশেষে বাংলাদেশ অসংখ্য বীরঙ্গনার খোঁজ পেলো, ঘোষণাও করলো কারও কারও নাম। যুদ্ধের বয়ান থামেনি। ইতিহাস বিকৃত হয়েছে, ঠিকও হয়েছে। প্রিয়ভাষিণী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করেছে। এটা তার লড়াই, তার অধিকার। সেটা তিনি অর্জন করে বুঝিয়ে দিয়েছেন-, অধিকার কেউ কাউকে দেয় না, অর্জন করতে হয়।

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধাদের দান। আমরা সেই দান নিয়ে অহংকার করি, বেঁচে থাকি। সাহসের সংগ্রামে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নারীর প্রতি অবদমন যে কত নিষ্ঠুর, সে ইতিহাস আরও লজ্জার। প্রিয়ভাষিণী তাই মুক্তির বারতা, আমাদের নতুন ইতিহাস। সে ইতিহাসকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে দেশ তাকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করেছে।

প্রতিনিয়ত দেশের স্বাধীনতার অনুভূতি তার কাজের মধ্যে দিয়ে তিনি ছড়িয়েছেন, বিস্তার ঘটিয়েছেন। ভাস্কর হিসেবে তার সামান্য বস্তুতে অসামান্য বিষয় প্রকাশের প্রয়াস, অসাধারণ। ঘাস ফুল লতা পাতা ডাল শিকড় ইত্যাদি নির্জীব বস্তুতে তিনি শিল্প প্রয়োগ করে আমাদের অনুভূতিকে আলোড়িত করেছেন। নীরব সংস্কৃতিকে সরব করার তার যে স্বাধীনতা প্রয়াস, সেটা একজন ভাস্কর কত নিপুণভাবে করতে পারে বাংলাদেশ তার কাজের মধ্য দিয়ে সেটা অনুভব করেছে।

শিল্প সাধনা ও সমৃদ্ধ বাংলা সংস্কৃতি বিনির্মাণে তার ব্যক্তিগত অবদানও অনস্বীকার্য। অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাতিঘর হিসেবে নিজেকে সাজানো ও নির্মাণ করার তার নিরত সংগ্রাম শিল্পের পর্যায়ে অভূতপূর্ব এক নিদর্শন। হাজার নারীর শক্তি, কথা বলার অনুপ্রেরণা- ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী। শোষণ-বঞ্চনা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে তার একার লড়াই ও পথচলা, একাত্তরের মূল চেতনা। সে চেতনার আলো সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দেশ এগিযে যাবে জ্ঞানে, মানুষ পাবে হতাশার মধ্যে দিশা- এটা তার জীবনেরই শিক্ষা।

একাত্তরের চেতনার প্রতীক প্রিয়ভাষিণী-কে ভালো না বাসতে পারা পশ্চাৎপদতা এবং অন্যায়। মুক্তির আলোয় উদ্ভাসিত হতেই এরকম একজন সর্বজনীন ‘মা’ পাওয়া জাতির জন্য ভাগ্যের। দেহ বিদায় কষ্টের, আমরা শোকাহত, বেদনাহত। কিন্তু তাঁর কাজের যে দ্যুতি তা অন্ধকার দূর করবে প্রতিনিয়ত- এটা আমাদের আনন্দ ও বিশ্বাস । প্রিয় মা, তোমাকে ভালোবাসি।

লেখক : কবি।

এইচআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।