রাষ্ট্রের উন্মুক্ত উদ্যানে ‘সেন্সিবল’ উক্তিগুলো
সোনালী ব্যাংক বেসিক ব্যাংক লুট হয়েছে, বাংলাদেশের রিজার্ভ থেকে একটা অংশ চলে গেছে দূর দেশে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো থেকে অর্থ আত্মসাতের যে প্লাবণ শুরু হয়েছে, তা যেন মহাপ্লাবণে রুপ নিচ্ছে ক্রমশ। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংকগুলো থেকে উবে যাচ্ছে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা একটুও ঘামছেন না। বরং আমাদের অর্থমন্ত্রী ব্যাংকের অনিয়ম-অব্যস্থাপনা স্বীকার করেন আবার বলেন ৪ হাজার কোটি টাকা এমন আর কি। ফার্মারস ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছেন চেতনার বন্যা বইয়ে দেয়া ছাত্রনেতা আর বুদ্ধিজীবীরা, তখনও কেউ কিছু বলে না। ইতিহাসের কথা বলে বলে একজন চেতনাধারী বুদ্ধিজীবী শেষপর্যন্ত ব্যাংক লুট করে নিয়ে গেলেন, চেয়ারম্যান (সাবেক আমলা, আওয়ামীলীগ নেতা) পদত্যাগ করে শুধু দায় মেটালেন আরেক সাবেক ছাত্রনেতা জনগণের অর্থ আত্মসাত করে লন্ডনে এসে বসে থাকলেন, তাতেও ঘাম ঝরে না আমাদের মন্ত্রণালয়গুলোর কিংবা প্রশাসনের অভিজ্ঞ আর দক্ষ মানুষগুলোর।
ব্যাংক খাতের চরম এই অব্যবস্থা-অনিয়ম বন্ধের দাবি সামনে রেখে সিপিবি বাসদ এবং বাম গণতান্ত্রিক মোর্চা বাংলাদেশ ব্যাংক ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেছে। একটা গণতান্ত্রিক দেশে ব্যাংক সেক্টরের এই অরাজকতা বন্ধের জন্যে যে কেউও যদি আন্দোলনে নামে, তাহলে এটা কি অযৌক্তিক আন্দোলন হতে পারে। একটা সুশৃঙ্খল আন্দোলনকে ব্যঙ্গ করার ক্ষমতা রাখতে পারে ব্যাংক লুটপাটকারী লুটেরারা, কারণ এরাতো লুণ্ঠক। তাদের পেশিতে শক্তি আছে, তাদের রাজনৈতিক একটা চেতনাও আছে, যে চেতনা আর পেশি দিয়ে এরা মোকাবেলা করার চেষ্টা করতে পারে প্রতিবাদকারীদের। কিন্তু যখন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী প্রতিবাদকারীদের বলেন ‘এরা ননসেন্স’, তখন মনে হয় কোন না কোনভাবে অর্থমন্ত্রী লুটেরাদের পক্ষই নিচ্ছেন। কেননা তার কথায় এটাই প্রতীয়মান হয় যে, যারা লুট করছে, তাদের সেন্স আছে, এই ‘সেন্সিবল’ দের যারা বিরুদ্ধাচরণ করছে তারা ‘ননসেন্স’। সিপিবি-বাসদ কিংবা বাম গণতান্ত্রিক মোর্চা বিশাল জনগণের কোন রাজনৈতিক সংগঠন নয় এটা হয়ত সত্যি। কিন্তু বাস্তবতা হলো বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যাদের পেশিতে শক্তি আছে কিংবা টেন্ডারে যারা বল প্রয়োগ করে, তারাই বড় সংগঠন। আর সে হিসেবে বড় সংগঠন এখন একটাই। রাস্তায় এখন অন্য কেউ কি দাঁড়াতে পারছে ?
অর্থমন্ত্রী সিপিবি-বাসদ-বাম মোর্চাকে ইঙ্গিত করে আরও বলেছেন, তাদের দু’চারজন নেতা আছে, তাদের একটা কিছু করেতো খেতে হবে সেজন্যেই আন্দোলন। অথচ অর্থমন্ত্রী হয়ত জানেন না সিপিবি একটা ঐতিহ্যবাহী সংগঠন। গণতান্ত্রিক আন্দোলন কিংবা সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনে এদের অবদান তিনি জানেন না। তিনি কি জানেন মুক্তিযুদ্ধে মুজাহিদুল সেলিমদের অবদানের কথা। তিনি কি জানেন আজকের সিপিবি প্রধানের নেতৃত্বে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যার প্রতিবাদে ঢাকায় মিছিল বেরিয়েছিলো। তার জানার অবশ্য কথাও না, কারণ মুক্তিযুদ্ধ হলো কৃষক-শ্রমিক আর ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে স্বাধীনতার জন্যে লড়ে যাবার এক রক্তাক্ত ইতিহাস। একটা কিছু করে খাবার আন্দোলন ছিলো না এটা। স্বাধীনতা এই মানুষগুলোরই রক্তের ফসল। অবশ্য তার জানার কথা না, কারণ আজকের আন্দোলনকারীরা স্বৈরশাসক এরশাদের মন্ত্রীও ছিলো না।
দুই.
দেশের চলমান এ অবস্থায় বাংলাদেশের আরেক মন্ত্রী যেন একটা ধাক্কা দিলেন গোটা রাষ্ট্রকে। দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীদের আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন কি অসহায় তিনি কিংবা তার সতীর্থ মন্ত্রীরা। তার এ কথাটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিচ্ছে। বিশেষত সরকারী মহলে। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ যে বার্তা পাবার, তাতো পেয়ে গেলাম। ‘মন্ত্রীরা চোর আমিও চোর’ শিক্ষামন্ত্রীর এ স্বীকারোক্তি কোন সরল-সহজ স্বীকারোক্তি নয়। এ তার অসহায়ত্ব। শিক্ষামন্ত্রীর এই উচ্চারণ কিন্তু দুর্নীতি আর দুর্বত্তায়নে গ্রাস করা বাংলাদেশের চিত্র। যে কথাটি উপরের লেভেল থেকে কেউ স্বীকার করছিলেন না এতদিন। মন্ত্রী তার মন্ত্রণালয়ের চরম অব্যবস্থাকে তুলে ধরেছেন। এমনিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘিরে অসংখ্য প্রশ্ন জনগণের কাছ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে। এবং সমস্ত দায়ভার মন্ত্রীর উপর চাপানো হচ্ছে স্বাভাবিকভাবেই।
হয়তো তাই চরমভাবে অসহায় জনাব নাহিদ এই সাহসটুকু করলেন। এবং সত্যি কথা হলো এতে করে তিনি কিছুটা হলেও হয়ত দায়মুক্ত হলেন বলে তিনি মনে করছেন। যদিও পরে তিনি তার বক্তব্যের একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বাস্তবতা হলো, এই উক্তি থেকে তার অসহায়ত্ব যেমন প্রকাশ পেয়েছে, ঠিক তেমনি অন্যদিকে তার মন্ত্রণালয় যে দুর্নীতি-ঘুষের আখড়া আর তার জন্যে তিনি যে এককভাবে দায়ী নন, তা তিনি জনগণের কাছে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। সেজন্যে জনগণের মাঝে এটা একধরনের সাহসিকতা হিসেবেই প্রকাশ পেয়েছে, যদিও আত্মশ্লাঘার পার্টি-পলিটিক্সের পিঠে একটা বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে শিক্ষামন্ত্রীর এই অসহায় উক্তি। তার পার্টির কর্মী-নেতারা ক্ষুব্ধ হয়েছেন, কিন্তু সাধারণ জনগণ সত্য কথা শুনেছেন।
আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে এ নিয়ে কঠোর আলোচনা-সমালোচনা থাকতেই পারে, কিন্তু পার্টির নেত্রী এখনও প্রকাশ্যে নাহিদের এই স্বীকারোক্তিতে কি উষ্মা প্রকাশ করেছেন? শুধুমাত্র মন্ত্রী ইঞ্জনিয়ার মোশাররফ শিক্ষামন্ত্রীর এ উক্তিকে পাগলের প্রলাপ বললেও আর কেউ প্রকাশ্যে কিছুই বলেন নি।
অসহায়ত্বে হোক (বেফাসভাবে নয়) আর যে কারণেই হোক আমার মনে হয় নুরুল ইসলাম নাহিদের মাধ্যমেই সরকারের উচ্চ পর্যায়ে একটা বার্তা পৌঁছিয়ে দিয়েছেন হয়তো পার্টি প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঘুষ-দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নে যে তার সায় নেই, বরং পার্টির কিছুটা বদনাম হলেও জনাব নাহিদের সাহসিকতাকে হয়তো তিনি পছন্দই করেছেন প্রকারান্তরে।
তিন.
নুরুল ইসলাম নাহিদের এ উক্তির পর বিশেষত তার পার্টির কর্মীরা এ নিয়ে চরম উষ্মা প্রকাশ করছেন। তারা অনেকেই তার কথায় হতাশ হয়েছেন, কারণ শিক্ষামন্ত্রী কিছুটা হলেও রাষ্ট্রের ‘ওপেন সিক্রেট’কে ওপেন করে দিয়েছেন সেজন্যে। তারা কেউ কেউ তাকে বাম কিংবা অনুপ্রবেশকারী ইত্যাদি বলে এ দায় দলের উপর থেকে সরিয়ে তার আগের ‘বামতত্ত্ব’কে দায়ী করছেন। কিন্তু কেন জানি তারা ভুলে যাচ্ছেন যে, তাদের পার্টির নেত্রীর পরে পার্টির সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান প্রেসিডিয়ামের মেম্বার তিনি। সে হিসেবে পার্টির প্রেসিডিয়াম মেম্বার হতে হলে পার্টির প্রতি বিশ্বস্ত এবং অনুগতই থাকতে হয়, থাকতে হয় নেত্রীর গুডবুকে, এবং মন্ত্রী হতে হলেও নেত্রীই তার ধারার বিশ্বস্ত মানুষকে পরিষদে নিজের সহযোগী হিসেবে নিয়োগ দেন।
সুতরাং এখানে তার ‘বামত্ব’ কি দায়ী হতে পারে ? যদিবা বামদের সমালোচনাই করতে হয়, তাহলে এটাই বলতে হবে, বাম ঘরানা একসময় অন্তত তাকে পার্টির প্রতি বিশ্বস্ত হতে শিখিয়েছিলো। তাই বাম থেকে মধ্যপন্থা অবলম্বন করার পরও আওয়ামী লীগ নেত্রী তাকে বিশ্বস্ত পার্টি নেতা হিসেবেই বেছে নিয়েছেন, যেমন নিয়েছেন তিনি মতিয়া চৌধুরী, আসাদুজ্জামান নূর কিংবা আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখদের। আর সেজন্যেই বলি শেখ হাসিনা কি এদের তার প্রেসিডিয়াম মেম্বার হিসেবে পদায়ন করে কিংবা মন্ত্রিসভায় নিয়ে ভুল করেছেন? পারবেন কি কেউ প্রধানমন্ত্রীকে চ্যালেঞ্জ করতে?
চার.
বছরের শেষে এ দুজন মন্ত্রী আলোচনায় উঠে এসেছেন আবারও। একজন গালি দিয়ে, অন্যজন সত্য প্রকাশ করে। একজন বামদের ‘কান্ডজ্ঞানহীন’ বলেছেন, অন্যজন ‘সহনীয় পর্যায়ে ঘুষ খাবার’ কথাটা উচ্চারণ করে নিজের দলেই বাম বলে নিন্দা কুড়াচ্ছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এ যেন এক বাম আতংক। সীমিত শক্তির এই দলগুলো নিয়ে কেন-ই বা সরকারের অভ্যন্তরে কিংবা দলের ভেতরে এই সংশয়-শংকা। একটা বৃহৎ শক্তির আওয়ামী লীগতো বাম আতংকে ভোগার কথা না। কারণ তাদের সামনে এখন অন্য চ্যালেঞ্জ। আসছে নির্বাচন, শিক্ষা মন্ত্রীর উল্লেখ করা দুর্নীতি-দর্বৃত্তায়ন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে রাষ্ট্রকে, মানুষের মাঝে আশার ঝিলিক দেখাতে হবে। শুধু জামায়াত নয়, সকল মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জনগণের আস্থা অর্জনইতো এখন প্রধান প্রয়োজন।
লেখক : লন্ডনপ্রবাসী কলামিস্ট।
এইচআর/আরআইপি