অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২:১১ পিএম, ১০ জানুয়ারি ২০১৮

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ

১০ জানুয়ারি বাঙালির জীবনে চিরস্মরণীয় এক অনন্য-ঐতিহাসিক দিন। এদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে বাঙালি বিজয়ের পরিপূর্ণতা অর্জন করেছিল। আমার কাছে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সব দিনের সেরা মনে হয় ১০ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন দিবস। কারণ, স্বাধীন দেশের একটি পরিপূর্ণ সরকার সেই দিনটিতেই প্রকৃতপক্ষে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন শুরু করেছিল। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর দেশ শৃঙ্খলমুক্ত হলে ও প্রশাসনিক কার্যভার গ্রহণের জন্য অর্থাত রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য কোনো সরকার স্বদেশের মাটিতে ছিল না। একটি আমবাগানে যে প্রবাসী সরকার গঠিত হয়েছিল, দীর্ঘ আট মাস যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁরা স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন সাত দিন পর। মধ্যবর্তী এই সাতটি দিন ছিল সংকটময় ও দুর্যোগময় ও অন্ধকারাচ্ছন্ন।

পাকিস্তানের কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে ৮ জানুয়ারি পি আই এর একটি বিশেষ বিমানে বঙ্গবন্ধু লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছান। সেখানে পৌঁছে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন ‘‘বাংলার মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীনতার অপরিসীম ও অনাবিল আনন্দ অনুভব করছি। এই মুক্তসংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। আমার জনগণ যখন আমাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছে, তখন আমি রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে একটি নির্জন ও পরিত্যক্ত সেলে বন্দিজীবন কাটাচ্ছি’। তিনি বাংলার জনগণের কাছে ফিরে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে বলেছিলেন ‘‘আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে রাজি নই। আমি আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই’’।

সকাল থেকেই লাখ লাখ মানুষ জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে দশ দিক মুখরিত করে মিছিল নিয়ে বিমানবন্দর অভিমুখে যাচ্ছে। কোটি কোটি হৃদয় রুদ্ধবাক মুহূর্ত গুনছে, প্রতি নিঃশ্বাসে অধীর আগ্রহে কালক্ষেপণ করছে কখন কখন আসবেন প্রিয় নেতা? কী দিয়ে তারা বরণ করে নেবে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে, বাঙালির হৃদয়ের শ্রেষ্ঠ গর্বকে। লাখো বাঙালি বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায়। বিমানের দরজা খুলতেই হাত নেড়ে জনতার অভিবাদন ও ভালোবাসার জবাব দিলেন শেখ মুজিব। বিমানের সিঁড়ি লাগোয়া হুইল চেয়ারে তাঁর জনক শেখ লুৎফর রহমান। ক্রন্দনরত পিতা পুত্রের আলিঙ্গন।

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ফুপিয়ে কাঁদছেন তাঁর প্রিয় মুজিব ভাইয়ের বুকে মাথা রেখে। জনতা তাঁকে একনজর দেখার জন্য ব্যগ্র। শারীরিকভারে তিনি বন্দী ছিলেন কিন্তু তাঁর স্বপ্ন ও সাধকে বাস্তবায়ন করতে বাংলার জনগণ তাঁরই অনুপ্রেরণায় স্বাধনিতার সংগ্রামে উদ্ধুদ্ধ হয়েছিলেন। সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতিকালে লাখ লাখ মানুয়ের সমাবেশে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে ভারতবাসীর উদ্দেশে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু বক্তৃতায় বলেন, ‘‘আমার জন্য এটা পরম সন্তোষের মুহূর্ত। বাংলাদেশে যাবার পথে আমি আপনাদের মহতী দেশের ঐতিহাসিক রাজধানীতে যাত্রাবিরতির সিদ্ধান্ত নিয়েছি এ কারণে যে আমাদের জনগণের সবচেয়ে বড় বন্ধু ভারতের জনগণ এবং আপনাদের মহীয়সী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী যিনি কেবল মানুষের নন মানবতার ও নেতা। তাঁর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকারের কাছে এর মাধ্যমে আমি আমার ন্যূনতম ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারব। অবশেষে মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের, অপ্রকৃতিস্থতার বিরুদ্ধে প্রকৃতিস্থতার, ভীরুতার বিরুদ্ধে সাহসিকতার, অবিচারের বিরুদ্ধে সুবিচারের এবয় অশুভর বিরুদ্ধে শুভর বিজয় হয়েছে’’।

এরপর অবসান ঘটে আমাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার। স্বাধীন বাংলাদেশে রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর ১০ জানুয়ারির ভাষণটি ছিল আবেগপূর্ণ ও স্মৃতিচারণা, দীর্ঘ ইতিহাস বর্ণনা। অবাক করা ব্যাপার হলো, ৪৬ বছর আগে এ দিনটিতে দেওয়া ভাষণে তিনি দুটি নীতিনির্ধারণী ঘোষণা দিয়েছিলেন, ভবিষ্যৎদ্রষ্টা শেখ মুজিব সেদিন রেসককোর্স তথা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘোষণা করেছিলেন, সোনার বাংলায় দুর্নীতির সুযোগ থাকবে না। তাঁর কন্যা জননেন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪৬ বছর পর সত্যিই দুর্নীতি মুক্ত বাংলাদেশ গড়তে পেরেছেন। রাজাকার-আলবদরদের বিচার হবে। তাঁর এ বক্তব্যের প্রতিধ্বনি ও আজ বাস্তাবায়ন হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে। এমনটা হবে না ই বা কেন?

আগস্টের শুরুতে জুলফিকার আলী ভুট্টো ঘোষণা দেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ও অন্যান্য অপরাধের জন্য বিশেষ সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের বিচার করা হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তি তাঁর পক্ষে কৌঁসুলি নিয়োগের সুযোগ পাবেন এবং তিনি হবেন পাকিস্তানের নাগরিক। সরকার চালিয়ে যাচ্ছে কূটনৈতিক যুদ্ধ, অন্যদিকে বাঙালিরা প্রশিক্ষণ নিয়ে রয়েছে যুদ্ধের মাঠে। তিনি জানতেন না গণহত্যা কিংবা ভারতে লাখ লাখ শরণার্থীর বিষয়ে। বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের উপস্থিতি আর সোভিয়েত রাশিয়ার পাল্টা জবাব তা ও জানতেন না তিনি শুধু জানতেন মৃত্যুর রায় হয়ে গেছে।

কারা কর্তৃপক্ষকে ফাঁসির সব রকম ব্যবস্থা নিয়ে রাখতে বলা হয়েছিল যাতে ওই আদেশ সংবলিত বিশেষ টেলিগ্রামটি পৌঁছানো মাত্রই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই টেলিগ্রাম পৌঁছানোর আগেই বাংলার রুখে দাঁড়ানো সংগ্রামী জনতা পর্যুদস্ত করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে এবং রেসর্কোস ময়দানে আত্মসমর্পণ দলিলে সই করেন পাকিস্তানি জেনারেল এ কে নিয়াজী। কারাগার থেকে সামরিক প্রহরায় শেখ মুজিবকে রাওয়ালপিন্ডির বাইরের এক বাংলোয় আটকে রাখা হয়। ২৭ ডিসেম্বর জুলফিকার আলী ভুট্টো তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন।

পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ২১ দিন পর ভুট্টো মুজিবকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বাহাত্তর সালের ৭ জানুয়ারি সন্ধ্যাবেলা শেখ মুজিবকে বলা হলো ইসলামাবাদ বিমানবন্দরে বিমান অপেক্ষা করছে। তবে বাংলাদেশে সরাসরি নয়, কৌশলগত কারণে মুজিবকে বহনকারী বিমান প্রথমে লন্ডনে যায়। পরদিন স্থানীয় সময় সাড়ে ছয়টার দিকে হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছায় বিশেষ বিমানটি। ব্রিটেনে সংবাদ সম্মেলনে শেখ মুজিব বলেন বাংলাদেশ একটি অপরিবর্তনীয় বাস্তবতা।

এবারের ১০ ই জানুয়ারি আমাদের কাছে অত্যান্ত তাৎপর্য্যপূর্ণ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য স্মারক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাঙালিরা যেমন এতে আনন্দিত তেমনি ইউনেস্কোও সম্মানিত। জাতির জনকের কন্যা তার পিতার পথ অনুসরণ করে দেশকে আজ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছেন। এ দেশের উন্নয়নে এবং মানুষের সার্বিক সামাজিক উন্নয়নে জননেত্রী মানবতার মাতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বারবার ক্ষমতায় বসানোর অঙ্গীকার করতে হবে।

নিশ্চিৎ মৃত্যু মেনে নিয়ে যে পিতা বাঙালিদের এনে দিলেন স্বাধীন পতাকা জন্ম দিলেন বিশ্বের মানচিত্রে একটি স্বাধীন দেশ। সেই চার বছরের শিশু দেশটির পিতাকেই বেঈমান মুশতাকরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যা করে দখল করে নিল বাংলার মানুষের ভাগ্য লেখার কলমটি। স্বাধীন দেশটি পিছনের দিকে চলতে লাগলো। ক্ষমতা ধীরে ধীরে চলে গেল রাজাকার, আলবদরদের হাতে। রাজাকারদের গাড়িতে পত পত করে উড়তে লাগল আমার পিতার জন্ম দেয়া দেশের পতাকা। সেই জায়গা থেকে দেশকে বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সততা নিষ্ঠা ভালবাসা আর সুযোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিনত করেছেন।

জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ঐ দিনের বঙ্গবন্ধুর প্রতি তখনকার মানুষের যে অকৃত্রিম ভালোবাসা ছিল বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে এসে জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি ঐ আস্থা এবং ভালোবাসা থাকুক আজীবন এটাই হোক ১০ জানুয়ারিতে আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : প্রো ভাইস চ্যান্সেলর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/আরআইপি

‘নিশ্চিৎ মৃত্যু মেনে নিয়ে যে পিতা বাঙালিদের এনে দিলেন স্বাধীন পতাকা জন্ম দিলেন বিশ্বের মানচিত্রে একটি স্বাধীন দেশ। সেই চার বছরের শিশু দেশটির পিতাকেই বেঈমান মুশতাকরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যা করে দখল করে নিল বাংলার মানুষের ভাগ্য লেখার কলমটি। স্বাধীন দেশটি পিছনের দিকে চলতে লাগলো।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।