রাজনদের হত্যা আমাদের অপরাধী করে না!
`এই ক` তুই চোর, তোর নাম ক`…লগে কারা আছিলো…?` ভিডিওচিত্রটিতে এ ধরনের আরো প্রশ্ন শোনা যাচ্ছিলো। সঙ্গ চলছিলো বেধড়ক মারধোর। কত আর বয়স হবে? ১৩ কি ১৪ বছর! কেবলই পা পড়েছে কৈশোরে। দুরন্তপনায় আর মেতে ওঠা হলো না সিলেটের শহরতলীতে বেড়ে ওঠা রাজনের। স্তম্ভিত হয়ে পড়ছিলাম প্রায় ২৮ মিনিটের ভিডিওচিত্র দেখে।
এইটুকু কিশোর শরীরে বর্বরতার কোনো মাত্রাই যেন বাদ রাখা হয়নি। একনাগাড়ে প্রায় ১৬ মিনিট দেখা গেছে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রোল দিয়ে পেটানোর দৃশ্য। নখে, মাথায় ও পেটে আঘাত করা হয়েছে রোল দিয়ে। এক সময়তো বাঁ হাত ও ডান পা ধরে মোচড়াতেও শুরু করে নির্যাতনকারীরা। মানুষের নিষ্ঠুরতা কোন পর্যায়ে গেলে হাতের বাঁধন খুলে রশি লাগিয়ে হাঁটিয়ে দেখা হয় হাড়গোড় ঠিক আছে কিনা। যখন দেখা গেলো ওই কিশোর শরীরে আঘাত সইবার আরো সামর্থ্য অবশিষ্ট আছে তখন ফের শুরু হয় নির্যাতন। চলতে থাকে যতক্ষণ না নিস্তেজ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রাজন।
একি মানুষের ব্যক্তিগত পশুত্বের বহিঃপ্রকাশ নাকি সামগ্রিকভাবে সামাজিক অবক্ষয়? নাকি তারও বেশি কিছু? হবে নাই বা কেন? একদিকে একটি কিশোরের মৃত্যু যন্ত্রণা, অন্যদিকে একদল মানুষের আদিম উল্লাস। মৃত্যুর আগে কিশোরটি যখন আর সইতে পারছিলো না, তখন পানির জন্য তার সেকি আকুতি! বিনিময়ে যেন আরো মূল্যবোধহীন পশুর দল। পশুর দলই যখন বলছি, তখন মূল্যবোধ শব্দটিই আসার কথা নয়। `পানি নাই, ঘাম খা।` যেন হত্যার নেশায় মত্ত মধ্যযুগীয় কিছু দানব।
এই যে দল বেধে একটি নিরপরাধ কিশোরকে প্রায় খুঁচিয়ে খুচিয়ে হত্যা, এর কারণ কি? কোথায় গিয়ে ঠেকেছে আমাদের এই সমাজ-সংসার? কতটা মানসিক বৈকল্যে ভোগলে একটা সমাজ এমন নিষ্ঠুরতা দেখাতে পারে? দেখতে পারে? আমাদের সমাজে এটাতো নতুন কোনো ঘটনা নয়! চোর সন্দেহে, ডাকাত সন্দেহে এর আগেও বহুবার বহুজনকে হত্যা করা হয়েছে। হয়তো তাদের অনেকেই কিংবা কেউ কেউ প্রকৃত অপরাধী। তাই বলে সাধারণ মানুষ আইন হাতে তুলে নেবে! একি আইনের প্রতি শ্রদ্ধা হারানোর কারণে? আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়ার কারণে? তাই যদি হয়ে থাকে সেখানে কি একতরফা সরকারগুলোকে কিংবা আইনী ব্যবস্থাকে দায় দেয়া যাবে? কারণ যে মানুষগুলো সরকারে কিংবা আইনী ব্যবস্থায় আছেন তারাও তো প্রত্যেকে একেকটি ব্যক্তি। এই সমাজেরইতো প্রতিফলন তারা। তাহলে দায়ভারতো গোটা সমাজব্যবস্থার উপরই বর্তায়।
কতটা নিচে নামতে পারি আমরা- রাজনের ঘটনা তার একটি উদাহরণ মাত্র। একদল মানুষ উল্লাসের সঙ্গে পিটিয়ে মারলো একটি কিশোরকে। আর কিছু মানুষ সেই হত্যাকাণ্ডের ভিডিওচিত্র নিলো। ঘটনাটি ঘটলো বুধবার (৮ জুলাই ২০০১৫) সিলেট শহরতলির কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ডে। মুহুর্তেই তা ছড়িয়ে দেয়া হলো সারাবিশ্বে। অন্তর্জালে ছড়িয়ে দেয়া হলো একটি কিশোরের আর্তচিৎকারের সঙ্গে কিছু হায়েনার অট্টহাসি। সবকিছু করা হয়েছে সচেতনভাবেই। ভিডিওচিত্রটি যে নিচ্ছিলো তার কাছে নির্যাতনকারীরা জানতে চায় সবকিছু ঠিকঠাক ধারণ করা হচ্ছে কিনা। ওপাশ থেকে জবাব, `ফেসবুকে ছাড়ি দিছি, অখন সারা দুনিয়ার মানুষ দেখব ...।`
সত্যিই সারা দুনিয়ার মানুষ দেখছে। তারা দেখছে কিভাবে হত্যা করা হলো বাংলাদেশের কোনো এক কিশোরকে। তারা দেখছে কিভাবে হত্যা করা হলো মানবতাকে। গোটা বিশ্বই দেখছে যে দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলছে, সেই দেশেই অমানবিক হত্যার শিকার হচ্ছে নিরপরাধ কিশোর। একি বাঙালির জন্য কম লজ্জার? কম অপমানের?
হত্যাতেই শেষ হয়নি সবকিছু। শেষ দিকে নির্যাতনকারীদের একজন সঙ্গীর কাছে জানতে চায়, `কিতা করতাম?` অপর একজনকে বলতে শোনা যা, `মামায় যে কইছন, ওই কাম করি ছাড়ি দে!` রাজন মারা গেছে বুঝতে পেরে তার লাশ গুমের চেষ্টা করা হয়। সেটি করতে গিয়েই আসলে ধরা পড়ে নির্যাতনকারীরা। অবশ্য সবাই না- মাত্র একজন। তাতে অন্তত গুমের হাত থেকে বেঁচে গেছে রাজনের লাশ। অন্তত মৃতদেহটি ফিরে পেয়েছে তার দরিদ্র পরিবার।
বেশ কয়েক বছর ধরে এই আরেক সংস্কৃতি চালু হয়েছে বাংলাদেশে। যাকে বলা হচ্ছে `গুম-সংস্কৃতি`। এখানেও দায় এড়াবার উপায় নেই ব্যক্তি থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠান কিংবা সমাজব্যবস্থা- কারোরই। গুমতো এখন মোটামুটি রাজনৈতিক হাতিয়ারে রূপ নিয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে ব্যক্তিগত হাতিয়ারও বটে। অবশ্য রাজনৈতিক বক্তব্যটিই আসে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। পাল্টাপাল্টি অভিযোগই চলে। কিন্তু বন্ধ হয় না গুম-সংস্কৃতি। সেই আলোচনা অন্য কখনো করা যাবে।
আপাতত ফিরি রাজনের ঘটনায়। এটি আসলে একটি খণ্ডচিত্র মাত্র। এ দেশের শিশুরা প্রতিনিয়তই নির্যাতনের শিকার। বাংলাদেশসহ এশিয়ার দেশগুলোতে যে প্রচলিত ধারণা, বিশেষ করে শিশুদের সম্পর্কে, তা প্রায় অভিন্ন। অভিভাবকসহ সবাই শিশুদের ভাবেন পূর্ণাঙ্গ মানুষের ছোট সংস্করণ। শিশুরা কারও উপর কর্তৃত্ব করতে পারে না। তারা প্রতিবাদ করতে পারে না। বলা ভালো, তাদের ভয় দেখিয়ে সহজেই প্রতিবাদ করা থেকে বিরত রাখা যায়। সর্বোপরি শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থা সামাজিক কাঠামোর সঙ্গে প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি কখনোই। সে কারণেই হয়তো শিশু নির্যাতনকারীদের চিহ্নিত করে দ্রুত বিচারের আওতায় আনা যায় না। দ্রুত এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও দেখা যায় না খুব একটা। তাইতো শিশু নির্যাতন বন্ধ হয় না কখনোই। হয়তো নির্যাতনের হার কমেছে কিছুটা। কিন্তু এটাই সত্যি যে, শিশুরা প্রতিদিনই কোনো না কোনো নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তবে দিন বা বছরে আসলে কত শিশু নির্যাতিত হচ্ছে, সে বিষয়ে সরকারি কোনো তথ্য নেই। বিভিন্ন এনজিও এবং সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে কিছুটা চিত্র অবশ্য মেলে।
শিশুদের উপর নির্যাতনের চিত্র ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশের সবকয়টি সামাজিক স্তরে। এদেশে খুব কম বয়স থেকেই নিপীড়িত হচ্ছে শিশু। এই সমস্যার প্রকৃতি ও প্রকরণ এত জটিল যে সুস্পষ্ট শ্রেণীবিন্যাস করাও বেশ কঠিন। বাংলাদেশের শিশুরা প্রতিনিয়ত নিজেদের কর্মস্থলে, সামাজিক সুরক্ষালয়ে, স্কুলে এমনকি ঘরের ভেতরেও নির্যাতনের শিকার।
শিশু নির্যাতন কিংবা নিপীড়ন কিন্তু বহুযুগ আগে থেকেই প্রচলিত। একটা সময়তো একে আইনগতভাবে অপরাধ হিসেবেই ধরা হতো না। খুব বেশি আগের কথা না সেটি। ১৯৭৪ সালে শিশু আইন প্রণয়নের পরই কেবল শিশু নির্যাতন আইনত অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। তবে আইন প্রণয়নের অর্ধ শতক পরও তা কতটা কার্যকর হয়েছে- সেটাও দেখার বিষয়। শুধু আইন করলেই হবে না। তার যথাযথ প্রয়োগটাও জরুরি। সেজন্য সবার আগে দরকার মানসিকতার পরিবর্তন, প্রয়োজন পরিপক্কতা। সেটি ব্যক্তি, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র ব্যবস্থার সবখানেই। এটি যতদিন সম্ভব না হবে ততদিন শুধু শিশু নির্যাতনই নয়, চলতে থাকবে সব ধরনের অনিয়ম। রাজনদের মিছিলেও যোগ হতে থাকবে আরো নতুন নাম। যেদিন মানুষের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি আর পারিপার্শ্বিকতায় আমূল পরিবর্তন আসবে- সেদিন হয়তো সত্যিই বদলাবে সমাজব্যবস্থা।
পাদটীকা: কিছুদিন আগেই ঢাকার রাস্তায় একটি কুকুরকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় স্বেচ্ছাসেবি একটি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে অভিযুক্তদের আটক করে পুলিশ। অন্য অনেকের মতো আমিও সাধুবাদ জানাই ওই উদ্যোগকে। এই দেশেরই আরেকটি শহরে বাসস্ট্যান্ডে পিটিয়ে হত্যা করা হয় নিরপরাধ কিশোরকে। পৈশাচিক আনন্দে চলে নারকীয় উল্লাস। তার ভিডিওচিত্র ছড়িয়ে দেয়া হয় অন্তর্জালে। সেই পৈশাচিকতা দেখতে আমরাও হুমড়ি খেয়ে পড়ি। কেউ নির্লিপ্ত থাকি, কেউবা ঝড় তুলতে শুরু করি ফেসবুক, টুইটারে। কিন্তু হত্যাকারীর কিছুই হয় না। কিছুই হবে না হয়তো।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, এসএটিভি
[email protected]
এইচআর/পিআর