আনিসুল হক : বেঁচে থাকবেন মানুষের ভালোবাসায়
মৃত্যু অনিবার্য। তবু মৃত্যু নিয়ে আমাদের কত বিচিত্র রকমের ভাবনা, কত বিচিত্র রকমের অনুভব-অনুভূতি! মৃত্যু নিয়ে আমাদের কল্পনারও কোনো শেষ নেই। সব ভাবনা-চিন্তা-কল্পনা ছাপিয়ে মৃত্যু নিয়ে এটিই বোধ হয় জীবিত মানুষের কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয় ভাষণ : ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’।
মরণশীল মানবের এই আকুতি কোন ভাবেই চিরন্তন সেই অমোঘ ও অনিবার্যতাকে স্পর্শ করতে পারে না। অন্তত শারীরিকভাবে তো কোনোক্রমেই নয়। তবে, শারীরিক মৃত্যুর পরেও অনন্তকাল মানুষ ভবিষ্যৎ মানবের মাঝে বেঁচে থাকতে পারেন- কেউ কেউ বেঁচে থাকেন। বেঁচে থাকেন তার কর্মে, বেঁচে থাকেন তার সৃজনশীলতার নানা বর্ণ-গন্ধ-গানে। বেঁচে থাকেন তার চিন্তা ও দর্শনের মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাহিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। শেষ পর্যন্ত কেউ কেউ এমনি করেই মানবের মাঝে বেঁচে থাকেন। এখনো অনেকেই আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন, শারীরিক ভাবে মরণের পরেও তারা অমরত্ব লাভ করে আছেন। তারা বেঁচে আছেন তাদের কর্ম, দর্শন ও সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে। আমাদের মাঝে আলো ছড়িয়ে- আমাদের আলোকিত করে। আমরা জীবিতরা তাদেরকে ভুলতে পারিনি। জীবন যাপনের নানা অনুষঙ্গে আমরা তাদের স্মরণ করি। তারা মৃত্যুঞ্জয়ী।
কোন কোন মৃত্যু ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’ হলেও তা আমাদের স্বাভাবিক চলার গতিকে ক্ষণিকের জন্য হলেও স্তব্ধ করে দেয়। কোন কোন মৃত্যু আমাদেরকে থমকে দেয়, আমাদের ভাবিয়ে তুলে। কোন কোন মৃত্যু আমাদেরকে ভাবনার অথৈ পাথারে ভাসিয়ে দেয়। কোন কোন মৃত্যু আমাদের সম্মুখের সহস্র দৃশ্যমানতাকে কেমন যেন শূন্যও করে তোলে। কোন কোন মৃত্যু এক অনির্বচনীয় বেদনায় আপ্লুত ও আচ্ছন্ন করে রাখে দীর্ঘ সময় ধরে। মৃত্যুর এই বেদনা অনিঃশেষ। মৃত্যুর এই অনিঃশেষ বেদনা তখনই হৃদয়কে আরো বেশি আচ্ছন্ন করে যখন সেই মৃত্যু হয় কোন কর্মঠ, স্বপ্নবাজ এবং মানবকল্যাণে নিবেদিত দূরদর্শী চিন্তকের। শুধু চিন্তাই নয়- কর্মের মাধ্যমে যিনি তার চিন্তাকে মানবকল্যাণের নিমিত্তে প্রয়োগের জন্য সর্বদা সচেষ্ট।
যে কোন পরিকল্পনা ব্যক্তিত্বের দাপুটে কারিশমায় কার্যকর করতে সক্ষম এমন মানুষের সহসা অনুপস্থিতিই যেখানে আমাদের ব্যথিত করে- মৃত্যু সেখানে আমাদেরকে শোকে মূহ্যমান করবে এটাই স্বাভাবিক। ঢাকা সিটি করপোরেশনের (উত্তর) মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যু উপরে ব্যক্ত সবগুলো বাক্যের সত্যতা নিয়ে আমাদের সম্মুখে কী রূঢ়ভাবে দণ্ডায়মান তা গত কয়দিনে আমরা সকলেই কম-বেশি উপলব্ধি করেছি। আনিসুল হক তার পরিকল্পনা মত নাগরিকের সকল সুবিধা নিশ্চিত করতে পারেননি একথা সত্য। কিন্তু সবচেয়ে বড় সত্য হলো সাধারণ নাগরিকের সহজাত সুবিধাসমূহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তিনি অসাধারণ নাগরিকদের প্রচণ্ড শক্তির বিরুদ্ধে প্রবল সংগ্রামটি করেছেন- অনেকটা একাই এই সংগ্রাম করেছেন। এ সংগ্রামে তিনি পরাজিত হননি। অনেকের মধ্যেই তার মত সাহসের খুবই অভাব আছে। কিন্তু আনিসুল হকের সে সংগ্রামের সবটাই জনসমক্ষে আসেনি- ‘মিডিয়া কভারেজ’ পায়নি।
আনিসুল হক একজন আধুনিক মানুষ ছিলেন- আধুনিক নাগরিকও ছিলেন। ঢাকার মানুষের জন্য একটি আধুনিক ‘সিটি’ কল্পনা করতেন তিনি। তার মৃত্যুর পর নানাভাবে আনিসুল হকের স্বপ্নের কথা আমরা একের পর এক জানতে পারছি আর জানতে পারছি ঢাকাকে নিয়ে তার স্বপ্নমাখা বিভিন্ন উদ্যোগের কথাও। আমরা নগরের পরিচ্ছন্নতাকর্মী থেকে শুরু করে নগর পরিকল্পনাবিদ পর্যন্ত সকলের মুখে আজ একথা শুনছি। মেয়র হয়েও পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সঙ্গে বসে চা-খাওয়া তথা সাধারণ মানুষের সাথে তার অসাধারণ সম্পর্কের কথা শুনে আজ আমাদের মনে হচ্ছে যে, আনিসুল হকই পারতেন নগরবাসীকে এক আধুনিক ও পরিচ্ছন্ন নগরী উপহার দিতে। কারণ, যাদের হাতে নগরী পরিচ্ছন্ন রাখার ভার তাদের অবহেলিত জীবনে তিনিই এনে দিয়েছিলেন প্রশান্তির সুবাতাস।
বেতন-ভাতা-বোনাস ও চাকুরির নিশ্চয়তা প্রদানের মাধ্যমে স্বল্প-আয়ের কর্মীদেরকে তিনি উজ্জীবিত করেছিলেন। কর্মীদের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টিও একটি মহৎ নেতৃত্বগুণ। আনিসুল হকের স্বভাবের ভেতরই নিহিত ছিল সেই গুণ। নিন্ম-আয়ের মানুষের বসবাসের জন্য গৃহায়ণ প্রকল্পও প্রস্তুত করেছিলেন তিনি। দীর্ঘদিন মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন আনিসুল হক। ৩০ নভেম্বর ২০১৭ সন্ধ্যার পর টেলিভিশনের পর্দায় স্ক্রল নিউজে সহসা প্রচার হতে থাকা আনিসুল হকের মৃত্যুর খবর আমাদের ক্রমশ ভারাক্রান্ত করে তুলেছে। আমরা ভারাক্রান্ত হয়ে চলেছি যতই তার সম্পর্কে খবরের পর খবর শুনেছি ততই। আনিসুল হক সমকালীন বাংলাদেশের এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। আমরা তার মত খুব কম বাঙালিকে পেয়েছি যিনি স্পষ্টভাবে মনের কথা ব্যক্ত করতে পারতেন। যে কোন বক্তব্য প্রকাশে তার দেহভঙ্গি ও চোখের ভাষার অপরূপ শৈলী দর্শকের মধ্যে এক অনাবিল মুগ্ধতা সৃষ্টি করতো।
তার সহাস্য ও চৌকস বক্তব্য শ্রোতাকে আকর্ষণ করতো মুগ্ধতায়- নিবিড়তায়। তিনি ছিলেন প্রত্যুৎপন্নমতি মেধা সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব- যে কোন পরিস্থিতিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে অকাট্য যুক্তিসহ বক্তব্য উপস্থাপনে তার তুলনা ছিলেন কেবল তিনিই। এককথায় তার মত চৌকস বা স্মার্ট ব্যক্তিত্ব আমাদের সমাজে খুব একটা দেখা যায় না। তাই আনিসুল হক অন্তত দুটি দিক থেকে তরুণ সমাজের আদর্শ ব্যক্তিত্বে পরিণত। এক. যে কোন বক্তব্য প্রকাশে যথাযথ দেহভঙ্গির প্রয়োগ এবং দুই. আনিসুল হকের উদ্দীপনা। আমরা দেখেছি ‘হেরে যাওয়া’কে তিনি জীবনে প্রশ্রয় দেন নাই। তিনি আমাদের তরুণ প্রজন্মকে সংঘবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সবসময়ই। ‘পরিবর্তন’-এর জন্য সংঘবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই বার্তা সর্বদাই পৌঁছাতে চেয়েছেন তিনি। তাই এমন এক দৃঢ় ব্যক্তিত্বকে হারিয়ে আমরা আমাদের সম্মুখে ব্যাপক এক শূন্যতাকে অনুভব করছি। সেই শূন্যতা আমাদেরকে হতাশ করছে, তাই আজ তাকে হারিয়ে এদেশের অনেকেই কাঁদছেন।
শৈশব-কৈশোরে সিনেমার অনেক অনেক নায়ককে ছাপিয়ে গিয়ে আনিসুল হকই হয়ে উঠেছিলেন আমাদের ‘হিরো’। তাকে আমরা চিনেছি প্রথমত টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব হিসেবে- পরে ব্যবসায়ী এবং সর্বশেষ মেয়র হিসেবে। কেউ কেউ ভিন্নভাবে চিনেন তাকে। আমরা যে যেভাবেই তাকে চিনি না কেন আজ এক পরিচয়েই তিনি আমাদের সকলের সম্মুখে উপস্থিত- মৃত্যু তাকে ছিনিয়ে নিয়েছে। তার সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয়ের অবকাশ ঘটেনি কখনো। কিন্তু তার মৃত্যুর খবর পড়ে, খবর শোনে যতই আনিসুল হক সম্পর্কে বুঝতে যাই যতই তার কর্মের গভীরে যাই ততই যেন তিনি উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন। মানুষকে কাঁদিয়ে তোলা এই মৃত্যু আনিসুল হককে আরো যেন উজ্জ্বল করে তুলেছে। চৌকস ব্যক্তিত্বের অধিকারী, তরুণ প্রজন্মের প্রেরণার উৎস আনিসুল হকের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার স্বপ্ন যেন শেষ না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে তারই প্রিয় ঢাকাবাসীকেই। তাহলেই আনিসুল হক বেঁচে থাকবেন। আনিসুল হকের জন্য শোককে শক্তিতে পরিণত করে আমাদের প্রতি তার ভালোবাসাকে সম্মান জানাতে পারি নিশ্চয়ই। এমন স্বপ্নবাজ ও উদ্যমী মানুষকে প্রকৃত ভালোবাসার মধ্য দিইে বাঁচিয়ে রাখতে হবেই।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/আরআইপি