শহর ঢাকা : কী নিচ্ছেন আর কী দিচ্ছেন?

মাসুদা ভাট্টি
মাসুদা ভাট্টি মাসুদা ভাট্টি , সাংবাদিক, কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৪:৪৭ এএম, ০৬ ডিসেম্বর ২০১৭

ঢাকা শহরের উত্তরাংশের সদ্য প্রয়াত মেয়রকে নিয়ে অনেকেই নানাবিধ প্রশ্ন তুলছেন কিন্তু একথা একবাক্যে সকলেই স্বীকার করছেন যে, এই শহরকে তিনি একটি সুন্দর ও স্বাভাবিক আবাসস্থল হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যাতে এই শহরকে একটুখানি ভিন্নতর করার প্রয়াস ছিল, যা এ শহরবাসীকে একটু হলেও আপ্লুত করেছিল। যে কারণে তার মৃত্যুতে মানুষ শোকগ্রস্ত হয়েছে এবং রাজনীতি ভুলে তার এই প্রয়াণে ব্যথিত হয়েছে। এই শহরকে নিয়ে স্বপ্ন দেখানো মানুষটি চলে গেছেন কিন্তু এই শহরবাসীর সামনে একটি প্রশ্ন তিনি তার অজ্ঞাতেই রেখে গিয়েছেন। আর সে প্রশ্নটি হলো, এই শহরকে আপনি আসলে কতোটা ভালোবাসেন?

কেন এখন এই প্রশ্ন জরুরি তা কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে ব্যাখ্যা করতে চাই। এক বিদেশি বন্ধুর সঙ্গে সান্ধ্যভোজে বসেছিলাম একটি রেস্তোরাঁয়। বেশ উঁচুতে খোলায় জায়গায় যার অবস্থান। সেদিন ছিল শুক্রবার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন। উঁচু জায়গা থেকে ঢাকা শহরকে দেখার অভিজ্ঞতা অন্যরকম, বিশেষ করে রাতের বেলা। আমাদেরও সেটা মনে হচ্ছিলো। হঠাৎই বন্ধুটি আমাকে বললেন, “একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছো, আজ রাস্তা অন্য দিনের তুলনায় বেশ ফাঁকা। কিন্তু এখনও লোকে এতো জোরে হর্ন বাজাচ্ছে কেন?” প্রথমত এই শহরের বাসিন্দা হিসেবে আমার শ্রবণেন্দ্রেয় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার কারণে আমি এটা ধরতেই পারিনি, যদি বিদেশি বন্ধুটি না বলতেন। সত্যিইতো, ফাঁকা রাস্তাতেও কেন এতো কেন আওয়াজ করতে হবে? কে কাকে কোত্থেকে সরে গিয়ে তাদের জন্য রাস্তা করে দিতে বলছে?

হর্ন মানেতো এক ধরনের হুমকি, উপস্থিতি জানান দেওয়ার সকল পদ্ধতি ব্যর্থ হলে তবেই হর্ন দিয়ে বলতে হয় যে, এবার যদি সরে না দাঁড়াও তাহলে অসুবিধে আছে!! ঢাকা শহরে এই হুমকিটিই স্বাভাবিক হয়ে গেছে এবং আমরাও তাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ঢাকা শহর শুধু নয় দেশের সর্বত্রই যেখানে যেখানে মোটরযান চলাচল করে সেখানেই এই ভয়াবহ শব্দদূষণের দৌরাত্ম্য। এখন নিজেকেই প্রশ্ন করুন, এটাতো কোনো মেয়রের পক্ষেই বন্ধ করা সম্ভব নয়, যদি না আমরা নিজেরাই সেটি করি। অনেকেই হয়তো বলবেন যে, সমাজের যে শ্রেণিটি গাড়ি চালাচ্ছে তারা আসলে এই শব্দদূষণ বিষয়টিই বোঝে না। সমাজবিদদের এই কথা মানতেই হবে। কিন্তু গাড়ির ভেতর চালকের পেছনে যারা বসে থাকেন তারা যদি চালককে এই শিক্ষা দেন কিংবা চালক যখন গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ নেয় তখনই যদি তাকে এই শব্দদূষণ বিষয়ে শেখানো হয় তাহলে তার নিশ্চয়ই একটি প্রভাব পড়বে?

আমরা জানি যে, হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বেশ কড়া অবস্থান নেওয়ায় তার দৌরাত্ম্য অনেকটাই কমেছে। তবে এখনও ঢাকা থেকে বাইরে বেরুলেই ব্যক্তিগত যানবাহন থেকে হাইড্রোলিক হর্নের আওয়াজ শোনা যায়। তাতে যে সামনের গাড়িটির চালক তাদেরকে পথ ছেড়ে দেয় তা নয়, কারণ সামনের গাড়ির চালকও জানে যে, যারা এরকম হর্ন লাগিয়েছে তারা ক্ষমতাবান হতেও পারেন, নাও হতে পারেন, আর ক্ষমতাবান হলেই তাদেরকে পথ ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারটিও এখন আর আগের মতো নেই। সবচেয়ে বড় কথা সামনের গাড়ির চালকটিই বা কী করবেন? তার সামনেও যে বিশাল গাড়িবহর, চাইলেই কি তিনি পেছনের গাড়িটির জন্য পথ ছেড়ে দিতে পারবেন? পারবেন না। একথা পেছনের গাড়ির চালক যিনি হর্ন দিচ্ছেন তিনিও জানেন, কিন্তু তিনি মনের আনন্দে হর্ন বাজিয়ে শব্দদূষণ করেই যাবেন, এটাতেই তার আনন্দ।

যে সান্ধ্যভোজের কথা বলছিলাম সেখানেই হঠাৎ মাথায় এলো কথাটা, এ শহরকে আমরা যথেষ্ট ভালোবাসিতো? নিজের ভেতর থেকেই প্রশ্নটির উত্তর এলো, আসলে বাসি না। এর কারণ সম্পর্কে এ লেখার শেষে উল্লেখ করতে চাই। তার আগে আরো কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলে নেয়া যাক। প্রায়ই বাড়ির কাছাকাছি কোথাও যাওয়ার থাকলে হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করি। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক শহরের এ পাশে বেশ যত্নে ফুটপাথ তৈরি করেছেন। যদিও এই ফুটপাথ মোটেও জনগণের ব্যবহারের জন্য সুখকর নয়। উঁচু-নিচু, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাস্তা থেকে অফিস বা বাড়িতে ঢোকার জন্য যে জায়গাটুকু রাখা হয়েছে সেখানে অনেক সময়ই পার্ক করে রাখা হয় গাড়ি। ফলে পথচারীর পক্ষে নিরবচ্ছিন্ন বা নির্বিঘ্নে হাঁটা সম্ভব হয় না।

যদি আপনি এরকম থেমে থাকা কোনো গাড়ির চালককে গিয়ে বলেন যে, এটাতো হাঁটার রাস্তা, আপনি এখানে পার্ক করে বসে আছেন কেন? হয় গাড়ির চালক উত্তর দেবেন না, না হয় এমন উত্তর দেবেন যে আপনার পিত্তি জ্বলে যাবে সে কথা শুনে। ফলে নিশ্চিত বচসা শুরু হবে, আর তাতে আপনি কাউকে পাশে পাবেন সে ভরসা নেই, কারণ সবারই তাড়া আছে বাড়ি বা কাজে ফেরার। অতএব আপনি ভাঙা মন নিয়ে, তিক্ততা নিয়েই আপনার গন্তব্যের দিকে এগুতে থাকবেন। আপনি একটু অন্যমনস্ক হয়েছেন কি আপনার জীবনকে বিপদগ্রস্ত করে ফেলবেন। কারণ, রাস্তায় অসংখ্য গাড়ি গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ফাঁকফোকর গলে বেরুনোর কোনো উপায় নেই, তাই মোটরসাইকেলগুলি নিশ্চিন্তে উঠে পড়বে ফুটপাথের ওপর। তারা আপনাকে হয় ধাক্কা দেবে না হয় আপনাকে তাদের জন্য রাস্তা ছেড়ে দিতে হবে।

যদি কোনোদিন আপনি ঘুরে দাঁড়িয়ে এর প্রতিবাদ করেন, কোনো মোটরসাইকেল আরোহীকে থামান তাহলে একত্রিত হয়ে যাবে আরো মোটরসাইকেল আরোহী এবং সবাই এককাট্টা হয়ে আপনার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। কয়েকদিন আগে একজন বিদেশি ভদ্রলোকের ছবি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল, তিনি একটি মোটরসাইকেল আরোহীকে থামিয়েছেন ফুটপাথ দিয়ে চালাচ্ছিলো বলে। অনেককেই দেখা গেলো মোবাইল বের করে এই দৃশ্যের ছবি তুলছেন, কিন্তু সেই বিদেশির পক্ষে এগিয়ে এলেন না। কী ভয়ানক ও কুৎসিত দৃশ্য!!

স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, মাত্র আধ দশকেই ঢাকা শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। এর আগে আমরা দেখেছি শহরের যত্রতত্র বর্জ্য পড়ে আছে, কাক-কুকুরের লড়াই চলছে। প্রখ্যাত চিত্রকর রফিকুন্নবী’র টোকাই এ শহরের এই বর্জ্য ও কাকের ওপর ভিত্তি করেই টিকে ছিল এতোদিন। অনেকদিন তার টোকাই চরিত্র নিয়ে কার্টুন দেখিনি, হয়তো বর্জ্য ব্যবস্থাপনার এই অভাবনীয় সাফল্য তার টোকাই চরিত্র ও কার্টুনকে ভিন্ন ধারায় নিয়ে গেছে। কিন্তু রাস্তার দু’পাশে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, চলন্ত গাড়ি থেকে ছুঁড়ে দেয়া ময়লা আর পথচারীর ফেলে রাখা বর্জ্যে ঢাকা শহর এখনও ছয়লাব হয়ে আছে। হয়তো সেগুলো পচনশীল নয় বলে দুর্গন্ধ আমাদের নাকে পৌঁছে না, কিন্তু প্ল্যাস্টিকসহ অন্য হাজারো ধরনের ময়লা দিয়ে এ শহরকে নোংরা করায় আপনারও যে অংশগ্রহণ আছে তা কি আপনি অস্বীকার করতে পারবেন?

টেলিভিশনে বা গণমাধ্যমে এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রায়শঃই ক্যাম্পেইন চলে, কিন্তু তাতে পরিস্থিতির খুব বেশি হেরফের হয় বলে মনে হয় না। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আরো ফিরিস্তি আছে কিন্তু কী লাভ হবে তা দিয়ে সেটা নিয়েই ভাবছি এখন। আরেকটি ছোট্ট অভিজ্ঞতা দিয়েই ফিরিস্তি শেষ করবো। সরকার শহরের উত্তরাংশে একটি বহুতল বিশিষ্ট পার্কিং তৈরি করে দিয়েছে। দুঃখজনক সত্য হলো, এই পার্কিং-এ আমি কোনো গাড়ি পার্ক করতে দেখিনি, কিন্তু রাস্তার পাশে অসংখ্য গাড়ি পার্ক করা রয়েছে। গাড়ির মালিক পার্কিং ফি পরিশোধে অক্ষম বলে ভাবতে পারছিনে কিন্তু তিনি সেটা করবেন না বা তার চালককেও সেটা শেখাবেন না। অথচ নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি পার্ক করা হলে শহরের বহুল আলোচিত ট্রাফিক জ্যাম সম্পূর্ণ কমে যাবে তা মনে করার কারণ না থাকলেও খানিকটা যে কমতেই পারে, তা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে।

এবার শেষ করি, কেন আমার মনে হয়েছে এই শহরকে আমরা কেউই ভালোবাসি না, সেকথাটি দিয়ে। সেদিনের সান্ধ্যভোজে বিদেশি বন্ধুটিও বললেন য, এই শহরের বেশিরভাগ বাসিন্দাই আসেন বা এসেছেন শহরের বাইরে থেকে, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে, অর্থনৈতিক কারণে কিংবা চাকুরির প্রয়োজনে। ফলে এই শহর থেকে সকলেই কেবল নিতে চাইছেন বা নিচ্ছেন, কেউই এই শহরকে কিছু দিতে চাইছেন না বা দিচ্ছেন না। সরকারকে বা দায়িত্বশীলদের গাল দিয়েই নিজের দায়িত্ব শেষ করছেন, কিন্তু এই শহরের প্রতি তার নিজেরও যে একটি দায়িত্ব আছে এবং প্রত্যেকেই যদি সে দায়িত্বটুকু সর্বার্থে না হোক কিছুটা হলেও পালন করি তাহলে এই শহরের চেহারাটা বদলে যেতো ধীরে ধীরে।

এই শহরকে আমরা আজীবন আমাদের ‘টেম্পোরারি’ বা ‘অস্থায়ী নিবাস’ হিসেবে ভেবে যাচ্ছি কিন্তু এই শহরেই যে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বেড়ে উঠছে সেকথা আমরা বেমালুম ভুলে বসে আছি। ফলে শহরের প্রতি আমাদের ভালোবাসা নেই কারোরই (যদি কেউ এই শহরকে তার নিজের গ্রামের মতোই ভালোবেসে থাকেন, তাহলে তার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী), আর নতুন প্রজন্ম যারা এই শহরেই জন্মেছে তারা আসলে পুরোনো প্রজন্মের কাছ থেকে শেখেননি কী করে একটা শহরকে ভালোবাসতে হয়, তার যত্ন নিতে হয়। ভালোবাসাও যে শেখার মতো, রীতিমতো একটি প্রশিক্ষণ গ্রহণের বিষয় সেটি আমরা ভুলে গেছি, সেটা মানুষের ক্ষেত্রে যেমন, তেমনই যে শহরে আমরা বাস করছি তার ক্ষেত্রেও।

ঢাকা ৫ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার ২০১৭
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, আমাদের অর্থনীতি।
[email protected]

এইচআর/আইআই

‘এই শহরকে আমরা আজীবন আমাদের ‘টেম্পোরারি’ বা ‘অস্থায়ী নিবাস’ হিসেবে ভেবে যাচ্ছি কিন্তু এই শহরেই যে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বেড়ে উঠছে সেকথা আমরা বেমালুম ভুলে বসে আছি। ফলে শহরের প্রতি আমাদের ভালোবাসা নেই কারোরই।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।