উন্নয়নের সাথে আরো কিছু চাই
বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে, বিশ্ব ব্যাংক এমন একটা তথ্য দেয়ার পর থেকে এক ধরনের উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে অনেকের মাঝে। এটি অবশ্যই এক ধরনের আশা জাগানিয়া খবর, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, আমরা রাতারাতি ধনিক শ্রেণিতে রূপান্তরিত হয়েছি। বিশ্বব্যাংকের এইর্যাং কিং-এ বাংলাদেশ একটু বিলম্বেই প্রবেশ করেছে বলতে হবে। এমনকি ভুটানও এই তালিকায় আছে আনেক আগে থেকেই।
উন্নয়নের পথে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চয়ই একটি দেশের একমাত্র লক্ষ্য নয়। তবে প্রবৃদ্ধ অবশ্যই প্রয়োজন, অন্তত বাংলাদেশের জন্য। বিগত অর্থ বছরে ৬.৫১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। কারণ এই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, যখন বিশ্ব অর্থনীতিতে চলছে মন্দা আর দেশ ছিল বিরোধী রাজনৈতিক জোটের সহিংস ও ধংসাত্মক তৎপরতায়। এতে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়েছে, হরতাল, অবরোধ আর পেট্রল বোমার সহিংসতা না থাকলে প্রবৃদ্ধি আরো বেশি হতে পারতো।
মানুষের গড় আয় বাড়ছে, দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। আগামি পাঁচ বছরে সাত শতাংশের উপর প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ধরে এগিয়ে যাবার পরিকল্পনাও আছে। এবং এসবই সম্ভব। কিন্তু যত সহজে এসব ভবিতব্য নির্ধারণ করা হচ্ছে, তা অত সহজে অর্জন করা হয়তো যাবে না। আর নিম্ন মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার এই খবরে, যে প্রশ্নটি বেশি উচ্চারিত সেটি হলো, সাধারণ মানুষ এই উন্নয়নের ছোঁয়া কতটুকু পাচ্ছে? আর এর সাথেই জড়িয়ে আছে, আয়ের বণ্টনের প্রশ্নটি। প্রতি বছরই বাজেট হোক, আর পরিকল্পনা কমিশনের লক্ষ্যমাত্রা হোক, বলা হয় সবকিছু্রই শেষ লক্ষ্য মানুষের জীবন-মানের উন্নয়ন।
যখন আমরা কথা বলছি জাতীয় উন্নয়ন নিয়ে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে, দেশ মধ্যম আয়ের পথে হাঁটছে ইত্যাদি নিয়ে, তখন যে বিষয়টি বারবার সামনে আসছে, তা হলো সমাজে বিরাজমান চরম আয় বৈষম্যের কথা। আমরা কি পারছি দরিদ্র জনগোষ্ঠির জন্য মানুষের যা মৌলিক চাহিদা তার নিশ্চয়তা দিতে? যদি চাই যে আগামিতে তা আমরা দিব, তাহলে দেখার বিষয় সেজন্য সঠিক নীতি, প্রতিষ্ঠান এবং অর্থায়ন আমাদের হাতে আছে কিনা।
অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে চেষ্টা আছে শেখ হাসিনার সরকারের এতে কোনো দ্বিমত নেই। আর সেজন্য আমরা দেখছি পদ্মাসেতু এবং যোগাযোগ খাতসহ সামগ্রিক অবকাঠামো ক্ষেত্রে কাজের গতি আনার জন্য বেশ কিছু সিদ্ধান্ত এখন বাস্তবায়নের পথে। তবে এখানে অর্থায়ন একটি বড় বিষয়। পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সাথে যা ঘটেছে তা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত ছিল না। নিজে নিজে এত বড় প্রকল্প করতে গিয়ে বাজেটে যে চাপ পড়েছে, তা শেষ পর্যন্ত এই প্রকল্পের ব্যয়কে কোথায় নিয়ে যায় তা দেখার বিষয়। তবে একথাতো সত্য অবকাঠামো দরকার, কারণ এর উপর ভর করেই ছোটে অর্থনীতির চাকা। তাই তহবিল সংকটে যেন কোনো বড় প্রকল্প আটকে না যায়, সেদিকে সরকারের দৃষ্টি থাকবে বলেই মনে হচ্ছে।
অবকাঠামো খাতে বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য বেসরকারি খাতকে যুক্ত করতে পিপিপি (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ) এর জন্য প্রায় অর্ধযুগের প্রচেষ্টা কোনো সুফলতা দেখেনি। বেসরকারি খাত অবকাঠামো ক্ষেত্রে বিনিয়োগের তেমন উৎসাহ দেখায়নি।
আমাদের অর্থনীতির আরেকটি মাথা ব্যথার কারণ হল জাতীয় সড়ক। রাজধানীর যানজটের কথা নাইবা বললাম, কিন্তু দেখছি ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের কাজ এক যুগেও শেষ হচ্ছে না, তেমনি শেষ হচ্ছে না ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের কাজ। তবে আশার আলো দেখাচ্ছে, কালিয়াকৈরের হাইটেক পার্ক, যার বাস্তবায়ন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পথে একটি বড় মাইল ফলক হয়ে থাকবে। যদি দ্রুত শিল্পায়ন চাই, উন্নয়ন চাই তবেতো শুধু অবকাঠামোর দিকে চাইলে হবে না, চাইতে হবে পরিবেশের দিকেও। আমাদের নদী, খাল বিলসহ জলাশয়গুলো যেভাবে দূষণে জর্জরিত, যেভাবে দখলে পর্যুদস্ত, সেদিকে দৃষ্টি না পড়লে হঠাৎ একদিন দেখা যাবে, আমাদের রাস্তাঘাট আছে ঠিকই, কিন্তু আমরা এগুতে পারছি না। আমরা জিডিপি’র অগ্রগতিতে খুশি হতে চাইলে নজর দিতে হবে মানবাধিকারের দিকে, শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের দিকে যা এদেশে সবসময় অবহেলিত বা উপেক্ষার বিষয়।
উন্নয়নের কথা বলছি, কিন্তু আমাদের মানুষ কি তার পছন্দমতো জীবন-যাপন করতে পারছে? এই প্রশ্নও এখন সামনে আসবে। ব্যক্তি মানুষের চাওয়া পাওয়ার গুরুত্ব দেয়ার সময় সামনে আসছে। সামনে আসবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়নে সত্যিকারভাবে আমরা কি করছি বা করতে পারছি, বা করতে চাই।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন চাই, একই সাথে চাই সুশাসনের ছোঁয়া। আর তাই মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার যে স্বপ্ন আমরা দেখছি, তার জন্য নীতি নির্ধারকদের, রাষ্ট্র পরিচালকদের, তাদের হয়ে যারা কাজ করছেন, সুবিধা ভোগ করছেন, তাদের আচরণ কতটা মানুষের কল্যাণধর্মী তার নিশ্চয়তাও নিশ্চিত করার দাবি উত্থাপিত হবে।
এইচআর/এমএস