বাংলাওয়াশ এবং দেশাত্মবোধক পরিতৃপ্তি


প্রকাশিত: ০৭:২০ এএম, ৩০ জুন ২০১৫

‘বাংলাওয়াশ’- শব্দটার মাঝে বাঙালি এখন অন্যরকম এক পরিতৃপ্তি খুঁজে পায়। যাকে বলা যেতে পারে দেশাত্মবোধক পরিতৃপ্তি। পাকিস্তানকে বাংলাওয়াশ করার পর ভারতকেও বাংলাওয়াশ করার সম্ভাবনা জাগিয়েছিল বাংলাদেশ। শেষ পর্যন্ত হয়নি। কিন্তু যা হয়েছে, তা হলো, এই শব্দটা এখন ক্রিকেট বিশ্বে এক ধরনের মায়াবী বিভ্রমেরও জন্ম দিচ্ছে!

বাংলাদেশ কোনো দলকে হোয়াইটওয়াশ করলে যদি তা বাংলাওয়াশ হয়; তাহলে লংকানরা করলে কী হবে? লংকানওয়াশ! ক্যারিবীয়দের কাছে কেউ ধবধবে সাদা হয়ে গেলে সেটা কি ‘ব্ল্যাকওয়াশ’ হবে? ভারতীয়রা করলে তাকে কি বলা হবে ‘ব্রাউনওয়াশ!’ এই সব শব্দ এখন সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যরকম এক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিচ্ছে। কেউ কেউ এসবের মাঝে এক ধরনের উগ্রজাতীয়তাবাদ খুঁজে পাচ্ছেন। ক্রিকেট নামক খেলাটা থেকে আর্ন্তজাতিকতা হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করা হচ্ছে।

বিবর্তনের পথ ধরে ক্রিকেটে নতুন নতুন শব্দ ঢুকে পড়েছে আগেই। ইংলিশ আর অস্ট্রেলিয়ানরা ক্রিকেটের মাঝে ছাইভষ্মও খুঁজে পেয়েছেন! বর্ণবাদের অবসানের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সাউথ আফ্রিকানদের কাছে হোয়াইটওয়াশ শব্দটা সবচেয়ে বেশি স্পর্শকাতর। শব্দটা অনেক বেশি অ্যালার্জেটিক! সাউথ আফ্রিকানদের কাছে এখনো ‘ধবধবে সাদা’ বলে তেমন কিছু নেই। কারণ, বর্ণবৈষম্যের অবসান হলেও সেই শেকড়টা পুরোপুরি তুলে ফেলা গেছে সমাজ থেকে সেটা মনে করেন না দক্ষিণ আফ্রিকান সামজবিজ্ঞানী এবং লেখক অশ্বিন দেশাই। তার মতে, সাউথ আফ্রিকায় এখনো ক্রিকেটে ধবধবে সাদা বলে কিছু হতে নেই! কারণ, বর্ণবৈষম্য নীতির শেকড় এতো গভীরে গেছে যে ‘সাদা’ শব্দটার উল্টো পিঠেই ‘কালো’!

সেই সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেলবে বাংলাদেশ। খেলবে দুটো টি-টোয়েন্টি। আর দুটো টেস্ট। টেস্টে সাউথ আফ্রিকাকে বাংলাওয়াশের কথা অতিউগ্র বাংলাদেশ সমর্থকও ভাবছেন না। কিন্তু টি-টোয়েন্টি আর ওয়ানডে নিয়ে সেটা ভাবার লোকের অভাব নেই। কারণ, পাকিস্তানের পর ভারতের বিপক্ষেও বাংলাদেশের সাফল্য। তবে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের সিরিজ জয়ের সাফল্য নিয়ে পাকিস্তানের সাবেক ফাস্ট বোলার সরফরাজ নেওয়াজ যে ‘তত্ত্ব’ অাবিষ্কার করেছেন তাকে আদি দৈবিক টিপস হিসেবে দেখতে পারেন আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগের কর্মকর্তারা। শুধু তাই নয়, ক্রিকেট বিশ্ব মুখিয়ে থাকতে পারে, সরফরাজের এই তত্ত্বের সঠিক প্রয়োগ আগামী আগস্ট-সেপ্টেম্বরে জিম্বাবুয়েতে হয় কি-না, সেটা দেখার জন্য।

সফরাজের থিওরি অনুযায়ী বাংলাদেশের কাছে ভারত হেরেছে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি থেকে পাকিস্তানকে বাইরে রাখার জন্য! কারণ, ভারতকে হারিয়ে বাংলাদেশ র‌্যাংকিংয়ে সাতে পৌঁছে গেছে। ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে র‌্যাংকিংয়ের র্শীষে থাকা আটটা দলের খেলার কথা ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে। পাকিস্তান আছে আপাত নয়ে।

র‌্যাংকিংয়ের উন্নতি ঘটানোর সুযোগ তাদের আছে শ্রীলংকার বিপক্ষে সিরিজ জিতে। কিন্তু তারপরও কেন জিম্বাবুয়ে-ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে জুলাই আগস্টে ত্রিদেশীয় সিরিজ! কারণটা একদম পরিষ্কার। বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে পাকিস্তান এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলার পথ খোঁজা। কিন্তু সেই পথ বন্ধ করে দিতে পারে বাংলাদেশ সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে একটা ওয়ানডে জিতে।

কিন্তু পাকিস্তান ওয়েস্ট ইন্ডিজ যে পথে হাঁটছে সেটা শুধু চ্যাম্পিয়নস ট্রফিকে ঘিরে নয়। আগামী বিশ্বকাপেও সরাসরি খেলার সুযোগ পাবে সেরা আট দল। সে অংকটাও মাথায় তাদের। বাংলাদেশের জন্য এই ত্রিদেশীয় সিরিজ উদ্বেগের কোনো কারণ কি-না সেটা বোঝা যাবে কয়েকদিন পর। তবে ক্রিকেট বিশ্বের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হচ্ছে ক্রিকেট প্লেয়িং দেশগুলোর মধ্যে অস্বাস্থ্যকর প্রতিদ্বন্দ্বিতার অবাধ লাইসেন্স! র‌্যাংকিংয়ের উন্নতি ঘটাতে, নিজেদের রেটিং পয়েন্ট বাড়াতে যে যার মতো টুর্নামেন্ট আয়োজন করছে!

পাকিস্তান যদি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচ জেতে, তাহলে সরফরাজ নেওয়াজ কী বলবেন? তিনি কি মানবেন ওই ফলাফল অন্যরকম কোনো উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য! নাকি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি থেকে পাকিস্তান ছিটকে গেলে তিনি আরো জোরে বলা শুরু করবেন, সব ষড়যন্ত্র!

সরফরাজ নেওয়াজ যেভাবে ষড়যন্ত্র খুঁজে বেড়াচ্ছেন সেটা তার স্বাভাবগত। কিন্তু বছর দেড়েক আগে আইসিসির পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় যারা বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ পাওয়া যাবে বলে জোরালো গলায় ‘বিগ থ্রি’-কে সমর্থন করেছিলেন তারা ষড়যন্ত্রের আঁচ একটু একটু করে টের পেতে শুরু করেছেন!

এখন না হয় পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ উদ্বেগের আগুন জ্বেলে দিতে জিম্বাবুয়েতে ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট খেলতে যাচ্ছে। আগামীতে সেই আগুন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর সেই আগুন নেভানোর একমাত্র ফায়ার সর্ভিস হতে পারে পারফরম্যান্স।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাওয়াশ নয়, সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে একটা জয় হতে পারে বাংলাদেশের জন্য অনেক স্বস্তির। অনেক পরিতৃপ্তির। তা নাহলে জিম্বাবুয়েতে ত্রিদেশীয় সিরিজ আতংকের সাইরেন হয়ে বাজতে থাকবে বাংলাদেশের কানে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘ইনজুরি টাইম’ ‘এক্সট্রা টাইম’ ব্যাপক পাঠক প্রিয়তা পেয়েছে। তিনি কাজ করেছেন দেশের নেতৃস্থানীয় বিভিন্ন দৈনিকে, টেলিভিশন এবং দেশি-বিদেশি রেডিওতে।

এইচআর/বিএ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।