বিজিবি সদস্য অপহরণ এবং সরকারের দায়


প্রকাশিত: ০৫:২৫ এএম, ২৪ জুন ২০১৫

মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী- বিজিপির হাতে ছয়দিন ধরে আটক বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিজিবির সদস্য নায়েক আব্দুর রাজ্জাককে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সরকারের গৃহীত কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে না। বিভিন্ন সময় একেকজন একেক রকম কথা বলে জনগণকে বরং বিভ্রান্তই করছেন। বিষয়টি নিয়ে সরকারের বক্তব্য ব্রিফিং বা সংসদে দেওয়া বিবৃতির মাধ্যমে পরিষ্কার করা যেত। সরকার দেশের জনগণের উদ্বিগ্নতার কথা বিবেচনায়ই নেয়নি। আর বিষয়টি দক্ষতার সাথে সামলাতে পারছেনা বলেই মনে হচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সরকারের কৌশল ও দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার মধ্য দিয়ে দক্ষতা ফুটে ওঠে। যেটা সরকার দেখাতে পারেনি।

গত ১৭ জুন টেকনাফ সীমান্তে নাফ নদীতে বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করে গোলাগুলির পর বিজিবির নায়েক রাজ্জাককে ধরে নিয়ে যায় বিজিপি। এরপরদিন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল বলেছিলেন বিষয়টি ভুল বোঝাবুঝি। কোনো খোঁজ খবর না নিয়েই বা বিষয়টি সম্পর্কে না জেনেই বোধ করি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী একথা বলেছিলেন।  

গত ২২জুন সোমবার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলছেন, আব্দুর রাজ্জাককে যে কোনো সময় ফিরিয়ে আনা যাবে। “তাকে ফিরিয়ে এনে পরিবারকে না দেওয়া পর্যন্ত উদ্বিগ্ন সরকার।” তিনি বলেন,“পতাকা বৈঠকের পর মিয়ানমার তাকে ফেরত পাঠাতে সম্মত হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও কূটনৈতিকভাবে যোগাযোগ করছে। আশা করি,যে কোনো সময় তাকে ফিরিয়ে আনা যাবে।”

পরদিন ২৩ জুন মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, একটি পতাকা বৈঠক হলেই এ সমস্যা মিটে যাবে। তিনি বলেন, মিয়ানমার অতিরিক্ত করছে, অতিরিক্ত চাইছে। সেটাও তাদেরকে খুব ভদ্র ভাষায় জানিয়ে দওয়া হয়েছে।

২২ জুন বিজিবির টেকনাফ ৪২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুজার আল জাহিদ জানান, নায়েক রাজ্জাককে ফিরে পাওয়ার জন্য বাংলাদেশকে শর্ত দিয়েছে মিয়ানমার। তারা বলেছে, ওই বিজিবি সদস্যকে ফিরিয়ে নিতে হলে অবৈধভাবে বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে সাগর থেকে উদ্ধার ৭১৭ জনের ম্যধে ৫৫৫ জনকেও বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতে হবে।

এই সংবাদ প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আব্দুল আজিজের বরাত দিয়ে বিজিবির পক্ষে সংবাদ মাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে জানানো হয়, নায়েক রাজ্জাককে ব্যক্তিগত অস্ত্রসহ নিঃশর্তভাবে সম্মানের সঙ্গে ফেরত দেওয়া হবে। রাজ্জাককে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর এটাই বাহিনী প্রধানের প্রথম দেওয়া কোনো বক্তব্য। তিনি মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসের ডিফেন্স আ্যটাশে বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মাহবুবের সঙ্গে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠকের সূত্র ধরে জাতিকে এই তথ্য দিয়েছেন।

২৩ জুন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিজিবির মহাপরিচালক জানান সন্ধ্যার কিছু আগে তারা বিজিপির কাছ থেকে পতাকা বৈঠকে বসার একটি চিঠি পেয়েছেন। তিনি আশা করছেন চলতি সপ্তাহে রাজ্জাককে ফেরত আনা যাবে।

দেখা যাচ্ছে বিষয়টি  নিয়ে মন্ত্রী একেক দিন একেক কথা বলছেন। বিজিবির স্থানীয় ব্যাটালিয়ান কমাণ্ডার বলছেন, মিয়ানমার শর্ত দিয়েছে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে হবে আর বিজিবির মহাপরিচালক বললেন কোনো শর্তই দেওয়া হয়নি। পরদিন আবার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বললেন, শর্ত দিয়ে বাড়াবাড়ি করেছে মিয়ানমার। সমন্বয়হীনতা এখানে স্পষ্ট।  উচিত ছিল পুরো বিষয়টি যে কোনো একটি সংস্থা থেকে সংবাদ মাধ্যমকে ব্রিফ করে আপডেট জানানো। তাহলে বিভ্রান্তির সুযোগ থাকতো না।

যে ঘটনাটি নিয়ে দেশের ১৬ কোটি মানুষ উদ্বিগ্ন। ১৬ কোটি মানুষের মান সম্মানের প্রশ্ন জড়িত সেই ইস্যু নিয়ে সরকারের ভেতর কী ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তা দৃশ্যমান নয়। ঘটনার ৬ দিন পর মন্ত্রী বলছেন, মিয়ানমার যে বাড়াবাড়ি করছে তা তাদের ভদ্রভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

রাজ্জাকে ধরে নেওয়ার উদ্দেশ্য-বিধেয় সরকারের মন্ত্রীদের বোঝা উচিত ছিল অপহরণের সঙ্গেই সঙ্গেই। প্রথমত মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী জোর করে বিজিবির সদস্যকে নিয়ে গেছে। এবং আর একজন সদস্যকে গুলি করেছে। পরেরদিন যখন পতাকা বৈঠকে তারা যোগ দেয়নি, তখনই বাংলাদেশের কর্তা ব্যক্তিদের বোঝার কথা মিয়ানমার জল ঘোলা করবে। এরপর যখন মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি সদস্য রাজ্জাককে রক্তাক্ত অবস্থায় হাতকড়া পরিয়ে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখার ছবি প্রকাশ করেছে তাতে বিষয়টা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মিয়ানমারের উদ্দেশ্য খারাপা। তাই কূটনৈতিকভাবে হোক কিংবা শক্তি প্রয়োগ করে হোক অথবা পতাকা বৈঠকে বসতে বাধ্য করে হোক-  এর জবাব দ্রুত দেওয়া উচিত ছিল। কারণ দায়িত্ব পালনের সময় অপহরণ করে একজনকে নিয়ে যাওয়া এবং হেফাজতে নিয়ে আহত করার ছবি দিয়ে তারা প্রমাণ করেছে এটা অনৈতিকতো বটেই, প্রচলিত সকল আন্তর্জাতিক আইনেরও পরিপন্থী। তবে তাৎক্ষণিকভাবে যদি বিজিবি একটা জবাব দিতে পারত তাহলে যেদিন রাজ্জাককে অপহরণ করা হয়েছে সেদিনই বা পরদিন সকালেই ফেরৎ দিতে বাধ্য হতো বিজিপি। বিজিপি গুলি করেছে বিজিবিও পাল্টা এ্যাকশনে যেতে পারত।

মিয়ানমারের বাংলাদেশের মানুষের মর্যাদার ওপর এই আঘাতের জবাব যদি তাৎক্ষনিকভাবে দেওয়া যেতো হয়তো বিষয়টি এতদূর গড়াতো না। আন্তর্জাতিক আইনে সীমান্তে টহলে কোনো বাহিনী গুলি করতে পারে না। গুলি করলে পাল্টা গুলি করা আইনসিদ্ধ।

তবে যেহেতু দেরী করেই ফেলেছে তাই এখন বিষয়টি কূটনৈতিকভাবেই সমাধান করতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান সঠিক। মিয়ানমার উজবুকের মতো অভিবাসী রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার যে শর্ত জুড়ে দিয়েছে তা কোনোভাবেই মানা উচিৎ না।

গত ২৯ মে মিয়ানমারের নৌবাহিনী তাদের জলসীমায় মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে যাওয়া একটি জাহাজ থেকে ৭২৭ জনকে উদ্ধার করে। এরমধ্যে ৫৫৫ জনকে বাংলাদেশি দাবি করে মিয়ানমার তাদেরকে ফেরৎ দিতে চাইছে। এর আগেও এরকম ১৮৭ জনকে ফেরৎ এনে দেখা গেছে তাদের মধ্যে অনেক রোহিঙ্গা আছে। এবার বাংলাদেশ যাচাই-বাছাই না করে কাউকে নিতেই রাজি নয়। মিয়ানমারের গণমাধ্যমও বলছে উদ্ধার হওয়াদের অনেকেই রোহিঙ্গা। এছাড়াও ইস্যু সম্পূর্ণই দুটো আলাদা। একটির সাথে কোনোভাবেই আরেকটির সম্পর্ক নেই। বিষয়টা অনেকটা অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়ের মতোই ঠেকছে। বিজিবি সদস্যদের  ধরে নিয়ে যাবে আর বিনিময়ে তাদের রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশি বলে স্বীকার করে নিতে হবে। একবার সরকার এই জাতীয় মুক্তিপণে রাজি হলে মিয়ানমার বারবার এ ধরনের সুযোগ নেওয়ার অপচেষ্টা করবে। এবং মিয়ানমার আন্তর্জাতিক মহলে তাদের দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে যে উদ্ধারকৃত সাগর ভাসা রোহিঙ্গারা তাদের নাগরিক নয়, তারা বাংলাদেশি।

স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শুরুতে বিষয়টা ভুল বোঝাবুঝি বলে যে রকম ভুল করেছিলেন এবার আর তা করেননি। তিনি সর্বশেষ ২৩ জুন মঙ্গলবার বলেছেন, “মিয়ানমার সাগরে উদ্ধার হওয়া নাগরিকদের সঙ্গে রাজ্জাকের বিষয়টি জুড়ে দিয়েছিল। আমরা বারবার বলেছি, শতভাগ যাচাই-বাছাই ছাড়া আনব না। আমাদের নাগরিক যারা, তাদের অবশ্যই আনব।”

সরকার বা বিজিবিকে এটা এখন মাথায় রাখতে হবে আগামী কিছুদিন মিয়ানমারের সীমান্তে এরকম ঘটনা আরো ঘটতে পারে। এজন্য বিজিবিকেও সতর্ক থাকতে হবে। দৃশ্যত কোনো কারণ ছাড়াই মিয়ানমার বাংলাদেশকে বিরক্ত করতে উস্কানি দিতে পারে। হতে পারে সেটা চায়নার ইন্ধনে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদারে উদ্বিগ্ন চায়নার পরামর্শে এরকম ঘটনা ঘটানো অস্বাভাবিক নয়। আবার রোহিঙ্গা ইস্যুতে মায়ানমার বাংলাদেশকে চাপে রাখতেও এটা করতে পারে।  মাদক, বিশেষ করে ইয়াবা পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশের কঠোর অবস্থানের কারণে মিয়ানমারের দুর্নীতিবাজ সীমান্তরক্ষীরাও বিজিবিকে ‘শিক্ষা’ দিতে এই ঘটনা  ঘটাতে  পারে। শেষের কারণটি আপাতত গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে এ কারণে যে মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (যাদের অধীনে বিজিপি) রাজ্জাককে ফেরত দিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুরোধ প্রত্যাখান করেছে।

 ঠিক কী কারণে মিয়ানমার এবার আন্তর্জাতিক আইন-কানুন, বিধি-বিধান উপেক্ষা করলো সেটা হয়তো আরো কিছুদির পর জানা যাবে। তবে যে কারণেই তারা এমন আচরণ করুক না কেন তাতে বাংলাদেশের মানুষকে অমর্যাদা করা হয়েছে। সরকারের দায়িত্ব হলো সেটির যথাযথ জবাব দেওয়া। এর আগেও ২০১৪ সালের ২৮ মে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের নাইক্ষ্যংছড়িতে কোনো কারণ ছাড়াই মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান বিজিবির নায়েক এম মিজানুর রহমান।

আমরা যদি আরো পেছনে, ২০০০ সালে ফেরত যাই,  তখন দেখতে পাই এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছিল মিয়ানমারের সীমান্তে। নাফ নদীতে অবৈধভাবে বাঁধ নির্মাণে আপত্তি জানিয়েও কাজ না হওয়ায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল সীমান্তরক্ষীরা। সেখানে মিয়ানমার তাদের সৈন্য সমাবেশও ঘটিয়েছিল। সেই যুদ্ধে বাংলাদেশের কারো প্রাণহানি না ঘটলেও মিয়ানমারের অনেক সেনা নিহত হয়েছিল।

আমরা কোনো রক্তপাত চাই না। প্রতিবেশিদের সাথে সুসম্পর্কের ভিত্তিতেই এগিয়ে যেতে চাই। মিয়ানমারকেও এটা বুঝতে হবে।



এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।