শ্রীনিবাসনীয় চিন্তা এবং ধোনির ধাক্কা
খুচরো কিছু বাংলা শব্দ তিনি বলতে পারেন। মাইক্রোফোন হাতে থাকলে হয়তো রোববার রাতে বলেই ফেলতেন; ‘কী খবর, কেমন আছো ঢাকা?’ গ্যালারি থেকে একটাই উত্তর আসতে পারতো; ‘ভাল। এরকম একটা ঐতিহাসিক রাতে আমরা জেগে আছি।’
প্রশ্ন এলো না। কারণ, বছরে সাত কোটি রুপির বিনিময়ে রবি শাস্ত্রী এখন মাইক্রোফোন ছেড়ে ভারতীয় ড্রেসিংরুমে। এবং সেখান থেকেই গ্যালারির চিৎকার-চেঁচামেচি সবই শুনলেন। টিম বাসে যেতে যেতে হয়তো দেখলেন, সত্যিই ঢাকা জেগে আছে। আনন্দ-উল্লাসে মেতে আছে। কারণ, ভারতের বিপক্ষে তিন ম্যাচ সিরিজ যে রোববার রাতেই ২-০ করে ফেললো বাংলাদেশ। মাস তিনেক আগে মেলবোর্নের ইয়ারা নদীর তীরে যে বাংলাদেশের সামনে ইতিহাস হাতছানি দিয়ে মিলিয়ে গিয়েছিল ‘বিতর্কিত আম্পায়ারিং’-এর কারণে বুড়িগঙ্গা পাড়ে সেই বাংলাদেশ ঠিকই ইতিহাস গড়লো। এবং ঠিক সেই ভারতকে হারিয়ে। যে ভারতের টিম ডিরেক্টর রবি শাস্ত্রী। অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি। মেলবোর্নেও তাঁরাই ছিলেন।
হাঁ, মেলবোর্নে সেদিন আরো একজন ছিলেন। ভারতের জয়, বাংলাদেশের পরাজয় সব কিছু ছাপিয়ে সেদিন তিনি শিরোনাম হয়ে গিয়েছিলেন। বিতর্কিত আম্পায়ারিং, আর আইসিসি-র ভূমিকা নিয়ে সেদিন তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন খোদ আইসিসি-র প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসে! ইয়ারা পাড়ে ঝড় উঠেছিল তাঁর বক্তব্য নিয়ে। তোলপাড় হয়েছিল ক্রিকেট বিশ্বে। সেরকম একটা ঘূর্ণিপিচে আইসিসি প্রেসিডেন্টকে হিট উইকেট ঘোষণা দিয়ে আইসিসি-র বাইশগজে আবির্ভাব হয়েছিলো এক ভারতীয়র। অর্থের মাপকাঠিতে যিনি ক্রিকেটকে মাপতে চান। ক্রিকেট বিশ্বকে শাসন করতে চান। তাঁর সেই স্বৈরাচারি শাসন আর আচরণের প্রতিবাদ করে যে ভদ্রলোক আইসিসি-র প্রেসিডেন্টের পদ ছেড়েছিলেন, তিনিও রোববার মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে হাজির ছিলেন। তিনিও দেখলেন; বাইশ গজে কিভাবে ভারতকে দুমড়ে-মুচড়ে দিলো বাংলাদেশ।
ভদ্রলোকের কাছে খুব জানতে ইচ্ছে করছিলো; চেন্নাই থেকে এন শ্রীনিবাসন নামের কোনো ব্যক্তির মুঠোফোন থেকে ‘সরি’ লেখা ক্ষুদে বার্তা পেয়েছেন কি না? পরোক্ষণেই মনে হলো; এতোটা ভদ্রতা দেখানোর মানসিকতা যদি তাঁর থাকবে, তাহলে আইসিসি-র গঠনতন্ত্রকে দুমড়ে-মুচড়ে নির্লজ্জের মতো বিশ্বকাপ ফাইনালে ৯৩ হাজার ১শ ১৩ জন দর্শকের দুয়ো ধ্বনির মধ্যে তিনি ট্রফি দিতে মাঠে নামতেন না!
২৯ মার্চ ২০১৫ রাতে ন্যায় বিচার পাননি সেই সময়ের আইসিসি প্রেসিডেন্ট আ.হ.ম. মুস্তফা কামাল। কিন্তু ২১ জুন রাতে তিনি দেখলেন ক্রিকেটীয় ন্যায় বিচার। যেখানে বাংলাদেশ স্কোর লাইনটা ২-০ করে ফেললো। সিরিজ জিতলো। মুস্তফা কামাল মাঠে বসেই স্কোর লাইনটা দেখলেন।
শ্রীনিবাসন কি টেলিভিশনে মুস্তাফিজ নামের ঊনিশ বছর বয়সী এক বাংলাদেশী বোলারের ভারত বধের দৃশ্য দেখেছেন? ইচ্ছা থাকলেও জানার উপায় নেই। বাংলাদেশ-ভারত সিরিজ কাভার করতে শ্রীনিবাসনের দক্ষিণ ভারতের কোনো সাংবাদিকও যে ঢাকায় আসেননি! আসবেন কেন? ভারত তো ভেবেছিল, কোলকাতা থেকে ঢাকায় নামবে, খেলবে আর সিরিজ জিতে ফিরে যাবে। কিন্তু ঢাকায় যে এরকম ক্রিকেটীয় নিম্মচাপে লণ্ডভণ্ড হবে ভারত, শ্রীনিবাসন কেন, কোনো ভারতীয়-ই হয়তো ভাবতে পারেননি। ভারতকে ভাসিয়ে দেয়ার নিম্মচাপটা তৈরি করলেন সমুদ্রকুল ঘেঁষা সুন্দরবনের কাছ থেকে উঠে আসা মুস্তাফিজ নামের এক তরুণ বাঁহাতি পেসার। যার বোলিং নিয়ে এখন রীতিমতো গবেষণা হচ্ছে ভারতীয় টিমে। শাস্ত্রী-ধোনি মিলেও যার বোলিঙের কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছেন না! ধোনি যেমন সংবাদ সম্মেলনে বলেই গেলেন; ‘ওর স্লোয়ারগুলো মারাত্মক। একই অ্যাকশনে গতির হেরফের করছে। কাটার গুলো খেলা কঠিন হচ্ছে। ওর স্লোয়ারগুলো বোঝা কঠিন হয়ে যাচ্ছে কারণ, একই ভাবে তা উইকেট কিপারের কাছে ক্যারি করছে।’
ওয়ানডে ইতিহাসে প্রথম দুই ম্যাচে এগার উইকেট নিয়ে ইতিহাস গড়লেন মুস্তাফিজ। সেই ইতিহাস যন্ত্রণা বাড়িয়ে দিলো ভারতীয়দের। মুস্তাফিজের বোলিঙেই এফোঁড় ওফোঁড় ভারত। ভারতীয় দলটাও যেন খানিকটা শোকস্তব্ধ!
না হয়ে উপায় কি? শ্রীনিবাসনীয় মানসিকতায় আক্রান্ত গোটা ভারতীয় ক্রিকেট মহল বাংলাদেশকে ‘ছোট দল’-ই মনে করেছে। টেলিভিশন বিজ্ঞাপন পর্যন্ত বানানো হয়েছে ‘বাচ্চাদের দল বলে!’ বাচ্চারা এখন আর বাচ্চা নেই শব্দগুলোকে নিছক বিজ্ঞাপনের ভাষা মনে করেছিল ভারত। শাস্ত্রীর জমানায় এখন ভারতীয় দলে কোনো মনোবিদও নেই। যেটা এক সময় ছিল। জন রাইটের সময় স্যান্ডি গর্ডন নামের একজন মনোবিদ ছিলেন ভারতীয় দলে। তিনি একটা কথা বলতেন,‘ছোটদের বিরুদ্ধে নামার সময়ও যেন একইরকম অ্যাড্রিনালিন নিষ্ক্রমণ হয়।’
ধোনিদের শরীরের ভাষা দেখে সেটা মনে হয়নি। বরং মুস্তাফিজকে ধাক্কা দিয়ে এমএস ধোনি বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তাঁরা সবল আর বাংলাদেশ দুর্বল। ধোনির এই চিন্তা শ্রীনিবাসনীয় চিন্তা আর মানসিকতা। ক্রিকেটের শাস্ত্রীয় চিন্তা সেটা হতেই পারে না!
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘ইনজুরি টাইম’ ‘এক্সট্রা টাইম’ ব্যাপক পাঠক প্রিয়তা পেয়েছে। তিনি কাজ করেছেন দেশের নেতৃস্থানীয় বিভিন্ন দৈনিকে, টেলিভিশন এবং দেশি-বিদেশি রেডিওতে।
এইচআর/পিআর