ইয়াবায় রোহিঙ্গা ফ্রি তামাশায় ডিসকাউন্ট
রোহিঙ্গা নিয়ে আন্তর্জাতিক জনমত বাড়লেও নিদারুণ তামাশার শিকার বাংলাদেশ। বন্ধুত্বের স্খলন লুকানো নয়, স্পষ্ট। বিশ্বস্ত পড়শি ভারতও নেই পাশে। নিয়েছে মিয়ানমারের পক্ষ। সাথে চীন-রাশিয়াও। তারা একদিকে মিয়ানমারকে সমর্থন করছে, আরেকদিকে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ পাঠাচ্ছে। তামাশার কী ছড়াছড়ি! আবার মিয়ানমারও তামাশায় কম যাচ্ছে না। চাল পাঠাচ্ছে। মসলা-পাতির বিশাল বিশাল চালান আসছে ফরমাল-ইনফরমাল দু’ভাবেই। আর ইয়াবার স্রোত তো রয়েছেই। এর বাইরে বিনা ডিও-তে সমানে পাঠাচ্ছে রোহিঙ্গাদের।
রোহিঙ্গা বা মিয়ানমার ইস্যুতে ভারতের হিসাব বেশ গভীরে। রোহিঙ্গা নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগের মাঝেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মিয়ানমার সফর করছেন। কথা দিয়েছেন সু চির পাশে থাকার। এর আগে, ২৫ মে আগস্ট রাখাইন রাজ্যের বেশ কটি পুলিশ ফাঁড়িতে সন্দেহভাজন রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার অজুহাতে এই নিধনে নামার পেছনের রহস্য এরইমধ্যে কিছু কিছু প্রকাশও পেয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিবৃতিতে জানানো হয়, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ভারত সবসময় মিয়ানমারের পাশে থাকবে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে ভারত ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরিতে উন্মুখ। ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে বিদ্রোহী তৎপরতায় লিপ্ত যোদ্ধাদের অনেকেই মিয়ানমারের জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। ওদের দমাতে মিয়ানমার সেনাদের সহযোগিতা ভারতের জরুরি। এছাড়া, মিয়ানমারে ভারত কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্পেও যুক্ত। রাখাইন রাজ্যেই চলছে ভারতের একটি বন্দর এবং নদীপথ প্রকল্পের কাজ। ভারতের মিজোরাম এবং রাখাইন রাজ্যের মধ্যে একটি সড়কও নির্মাণ হবে।
বাংলাদেশের অসাধারণ মানবিকতায় দুর্বলতাই যেন কব্জা করেছে বন্ধুরা। ঠ্যালা সামলানোর গোটা দায় যেন এখন ঘনবসতির এই ছোট বন্ধুটিরই। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সুচি পরিস্কার ভাষায় বলে দিয়েছেন, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে কোন সমস্যা নেই। কোন রোহিঙ্গা দেশ ছেড়ে কোথাও যাচ্ছে না। পরে একটু ঘুরিয়ে বলেছেন, রাখাইন ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রতরা মিয়ানমারের নাগরিক নয়। এই শরণার্থীদের ফেরত না নেয়ার ব্যাপারটা জল বৎ তরলং সত্যের মতো। সেই আয়োজনে কমতি নেই মিয়ানমারের। বিশ্বদরবারে তার সমর্থকও অনেক।
নিপীড়ন চললেও আগে কখনও মিয়ানমার এমন গণহত্যা চালায়নি। রোহিঙ্গাদের ঘর-বাড়ি জ্বালায়নি এভাবে। এবার বাংলাদেশে আসা এমন কোনও রোহিঙ্গা পরিবার নেই, যাদের পরিবারের এক বা একাধিক সদস্যকে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী হত্যা করেনি, ধর্ষণ করেনি।
সীমান্তে মাইনও পুঁতেছে। এ অবস্থায় একজন রোহিঙ্গাও ফিরে যেতে রাজি হবে ওই মৃত্যুপুরীতে? জোর করে পাঠানোও আর সহজ নয়। এই পরিস্থিতিটা মগরা পরিকল্পিতভাবেই পয়দা করেছে। এরপরও যাচাই- বাছাইতে বড় জোর হাজার পাঁচেক রোহিঙ্গা মিয়ানমারের নাগরিক প্রমাণ হতে পারে। নাগরিকত্ব বাতিলের পর এক ধরনের কার্ড দেওয়া হয়েছিল তাদের। এদ্দুরই সম্বল। এই হাজার পাঁচেককে ফিরিয়ে নিয়ে মিয়ানমার বিশ্ব সম্প্রদায়কে বলতে পারবে, তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিয়েছে। এভাবে জয়ের পথই খুঁজছে ঠকরা।
এই ঠগ বা বিষ বাংলাদেশ কতোটা হজম করতে পারবে? যতো রোহিঙ্গা আসবে সবাইকে আশ্রয় দেয়া হবে, ভরন-পোষণ দেয়া হবে- এমনতর সাহসী কথা বলা হলেও বাস্তবতা কঠিন। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দ্রুত মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে না পারলে কক্সবাজারসহ দেশে বড় মানবিক বিপর্যয় ঘটবে-এমন শঙ্কার সাথে একমত হয়েছে জাতিসংঘও। অদূর ভবিষ্যতে কক্সবাজারের উখিয়া-কুতুপালং এলাকায় রোগব্যাধির মহামারী এবং দাঙ্গার শঙ্কাও করা হয়েছে প্রতিবেদনে। চলতি সপ্তাহে জাতিসংঘের দেয়া একটি প্রতিবেদনে পাওয়া গেছে এ শঙ্কার কথা। প্রতিবেদনটি বাংলাদেশসহ একাধিক দেশের পররাষ্ট্র দপ্তরকে পাঠিয়েছে জাতিসংঘ।
'রোহিঙ্গা রিফিউজি ইস্যু : হিউম্যানিটারিয়ান রেসপন্স' শিরোনামের জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে এখনও শরণার্থী আসা বন্ধ হচ্ছে না। এর কারণ রাখাইনে জাতিগত নিধনযজ্ঞের মতো কর্মকাণ্ড চলছেই। এর ফলে এখনও প্রতিদিনই রোহিঙ্গারা দল বেঁধে ঢুকছে বাংলাদেশে । ২৫ আগস্টের পর থেকে যেসব রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে এসেছে, তারা খুবই কম সহায়-সম্বল নিয়ে আসতে পেরেছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে আসা সঞ্চয়ের বেশিরভাগই বাংলাদেশে আসতে এবং এখানে বাঁশ ও পলিথিন কিনে আশ্রয় তৈরিতে ব্যবহার হয়েছে। তাদের এখন দরকার খাদ্যসহ জীবন বাঁচানোর প্রয়োজনীয় মানবিক সহায়তা। তা মিলছেও। কিন্তু ঘটছে উল্টো ঘটনাও।
রাখাইনে মগদের গণহত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দৃঢ় ভূমিকা বিশ্বকে নতুন করে নাড়া দেয়ায় রোহিঙ্গা ইস্যুকে বিশ্বসভায় নিয়ে যাওয়ার একটি চমৎকার সুযোগ আসে। কিন্তু আমরা কি নিতে পেরেছি চান্সটি। প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে সুনির্দিষ্ট পাঁচ দফা প্রস্তাবসহ জোরালো বক্তব্য রাখলেও ভারত পিঠই দেখালো। চীন-রাশিয়াও নিলো সু চিদের পক্ষ। পরে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার নামে বাংলাদেশকে ঘোলা জল খাওয়ালো মিয়ানমার। এখন করছে নানা বাহানায় সময়ক্ষেপণ। ১৯৯২ সালের চুক্তি মোতাবেক এখন রোহিঙ্গাদের বাকি কুচিকুচির সুযোগই নিশ্চিত হলো।
মিয়ানমারের সঙ্গে ১৯৭৮ সালের চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ‘যাচাই-বাছাই’র প্রসঙ্গ ছিল না। তা ছিল ১৯৯২ সালের চুক্তিতে। তখন ক্ষমতায় বিএনপি। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান। আর চুক্তির পেছনে ছিল তখনকার অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব বর্তমান পররাষ্ট্র মন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর অবদান। চুক্তিতে বলা ছিল, বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফেরত নেবে, যদি তারা মিয়ানমারের নাগরিক হয় তা ‘যাচাই- বাছাই’ করে। যাচাই-বাছাইয়ের মালিক-মহাজন মিয়ানমার। আর ফেরত নেওয়া হবে স্বেচ্ছামূলকভাবে। অর্থাৎ কেউ যেতে না চাইলে জোর করে পাঠানো যাবে না। মিয়ানমার এখনো তা-ই চাইলো। পেলেও। হাসিনার সরকার বিরান্নব্বইয়ের খালেদা সরকারের করা সেই চুক্তি অনুসরণেরই সম্মতি দিল। এদিকে, সেই বিএনপি এটাকে বলছে ‘ভাওতাবাজি’। আবার বলছেও না যে, প্রথম ‘ভাওতাবাজি’টা তারাই করেছিল।
সু চির মন্ত্রী টিন্ট সোয়ের ঢাকা সফরের দিন (২ অক্টোবর) বাংলাদেশে ঢুকেছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। অথচ মিয়ানমার আন্তর্জাতিক বিশ্বকে দেখালো, তারা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তরিক। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বললেন, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়েছে। মিয়ানমার যা বলতে চায়, তা বললেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তা জানলো আন্তর্জাতিক বিশ্বও। জানলো না সেদিনও হাজার হাজার রোহিঙ্গা আসার খবর। হত্যা, বাড়ি-ঘর জ্বালানো অব্যাহত রাখার তথ্য। বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও এসব কথা সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়নি।
এছাড়া, সু চির মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর জাতিসংঘে দেওয়া পাঁচ দফাও আনা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া সেভ জোনের দাবিও আলোচনার বিষয় হলো না। মিয়ানমার ১৯৮২-তে আইন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করেছে। বঞ্চিত করেছে ভোটাধিকারসহ সকল রকম রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে। এরা যে মিয়ানমারের নাগরিক, এমন কোনও বৈধ কাগজপত্র রোহিঙ্গাদের কাছে নেই। কী দাঁড়ালো অর্থটা? যাচাই-বাছাইতে কি প্রমাণ হবে এরা মিয়ানমারের নাগরিক? বাংলাদেশের কাছেও প্রমাণ নেই, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। জাতিসংঘ বা ইউএনএইচসিআর জানলে কি হবে?
একদিকে বিশ্বরাজনীতি আর কূটনীতির নানা কূটচাল। আরেকদিকে স্থানীয় ও জাতীয় নানা কারসাজি। নাফ নদী পেরিয়ে আছড়েপড়া এই রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর ঢেউকে 'মানবিক' বিবেচনার আড়ালে ভিন্ন রাজনীতি-কূটনীতির অভিযোগ রয়েছে। যার যেভাবে সুবিধা তা করে ছাড়ছে। নিরুপায় জীবন এই বিপন্নদের। এই বিপন্নদের নিয়েও চলছে নোংরাবাণিজ্য। যেন একটা উৎসব। মাছ ধরা, লাকড়ি খোঁজার কাজ বাদ দিয়ে রোহিঙ্গা ধরায় নেমেছে অনেকে। শরণার্থী পারাপার, পথে আটকে দিয়ে বাড়তি টাকা-গহনা হাতাতে বুক কাঁপছে না মানুষ নামের স্থানীয় কিছু জীবের।
মাতৃভূমিতে নিগৃহীতের পর এখন আশ্রিত দেশে পীড়ন-উৎপীড়ন। পদে পদে পড়ছে অসাধু চক্রের ফাঁদে। অসহায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার ছুঁতায় বন-পাহাড় দখল, গাছগাছালি কেটে সাফা করে ফেলা হচ্ছে। এই নোংরা কামাই-রোজগার একধরনের বৈধতাও পেয়ে গেছে এরইমধ্যে। এই আশ্রিতরাই একদিন এ দেশের ভিটামাটিকে আফগান, ইরাক, লিবিয়ার মতো পোঁড়া মাটি বানাবে না-তা কে জানে? রোহিঙ্গারা এখন এ দেশের ভাত খাচ্ছে, ক’দিন পর যে আমাদের হাত ভাঙবে না, তা-ও বলা যায় না। স্মরণে রাখতে হবে, এরা একাত্তরে সরাসরি পাকিস্তানিদের সাহায্য করেছিল বাঙালিদের উপর বর্বরতা চালাতে!
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/আইআই