লাস ভেগাসের হত্যাকাণ্ড এবং আমেরিকার বন্দুক খেলা

ফারুক যোশী
ফারুক যোশী ফারুক যোশী , প্রবাসী সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৪:০৭ এএম, ০৫ অক্টোবর ২০১৭

কমিউনিস্ট নেতা জসিম উদ্দিন মন্ডল মারা গেছেন। যে কজন গণমানুষের নেতা স্বশিক্ষিত হয়ে জনতার পাশে দাঁড়িয়ে আজীবন সংগ্রাম করেছেন, সেই অল্প সংখ্যক মানুষদের একজন ছিলেন তিনি। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে সাম্প্রদায়িতকা বিরোধী সংগ্রাম আর সর্বহারা মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে জীবন বাজি রাখতে ১৭ বছর যিনি কাটিয়েছেন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে, যিনি পড়েছেন-শিখেছেন এবং শিক্ষা দিয়ে গেছেন আমাদের। সেই জননেতার একটা উক্তি ফেসবুকে দিয়েছেন যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগের এক নেতা, আমার অনুজপ্রতিম বন্ধু।

জসিম মন্ডল বক্তৃতায় বলতেন ‘ভায়েরা শোনে রাখেন, দোয়া-দরুদ পড়ে, আবেদন-নিবেদন করে, পীর সাহেবের পানি পড়া খেয়ে, গলায় তাবিজ বেঁধে, প্রেম পিরীতি করে, কোন শালার অবস্থা এক ইঞ্চিও পরিবর্তন হইবে না- ধনী লোক গরীব লোকরে না ঠকাইলে, মালিকরা শ্রমিকদের না ঠকালে, পয়সা কম না দিলে, কোন শালা বড়লোক হইতে পারিবে না-। ইহার নাম বিজ্ঞান, ইহার নাম অংক, ইহা আপনাকে বুঝিতেই হইবে, তা না হইলে জোড়াতালি দিয়া, আবেদন-নিবেদন করিয়া আপনার অবস্থার এক চুলও পরিবর্তন হইবে না, লিখিয়া রাখিতে পারেন.....।’

২) এই উক্তিটি আমিও যখন আমার ফেসবুকের স্ট্যাটাসে শেয়ার করেছি, সে দিনটাতেই আমেরিকার লাস ভেগাসে চিত্রিত হয়েছে পৃথিবীর আরেক নৃশংস অধ্যায়। গত রোববার রাতে বিলাস বহুল হোটেলের বত্রিশ তলা থেকে একের পর এক গুলি করেছে আমেরিকান একজন খুনি স্টীফেন। একে একে খুন করেছে ৫৯ জন তরুণ-তরুণী আর বন্ধু-সজন। ৫ শতাধিক মানুষ কাতরাচ্ছে এখন হাসপাতালগুলোতে। লাস ভেগাসের জন্যে সে এক ভয়াল রাত। আমেরিকার নৃশংসতার ধারাবাহিকতায় আরেক নতুন সংযোজন। নতুন সংযোজন বললাম এজন্যে যে, আমেরিকায় এটা কোন নতুন বিষয় নয়। এভাবেই মাঝে মাঝে আমেরিকা গর্জে উঠে। মানুষ মরে, হত্যাকাণ্ড সংঘঠিত হয় একের পর এক। কিন্তু আমেরিকা তার জায়গায় স্থির-অটল।

আমেরিকায় এরকম অস্বাভাবিক মৃত্যু প্রতিদিন ঘটে। এরকম নৃশংসতা আমেরিকার রাস্তায় প্রতিদিনের। প্রতিদিন ৩০ জন আমেরিকান এভাবেই বিভিন্ন জায়গায় খুন হন। লাইসেন্সধারী কিংবা লাইসেন্সবিহীন বন্দুকের অবাধ বেচা-কেনায় এ মৃত্যু আমেরিকার প্রাত্যহিক ব্যাপার। দেখা যাচ্ছে প্রতি বছর ১১ হাজার মানুষ খুন হয় শুধুমাত্র এরকম বন্দুকের অবাধ বেচা-কেনার কারণেই। অর্থাৎ প্রতি চৌদ্দ সপ্তাহে আমেরিকায় বিচ্ছিন্নভাবে একেকটা ৯/১১ সংঘঠিত হয়। পৃথিবীর কোন জায়গায় মানবতার (!) সামন্যতম ব্যত্যয় দেখলে আমেরিকার মানবতার হাপিত্যেশ উঠে। বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের মানবতা নিয়ে তারা এত বেশি উদগ্রীব যে, তারা ভুলেই যায় তাদের দেশেরই অস্ত্র বেচা-কেনার আইনের কারণে বছরে প্রায় চারটা ৯/১১ ঘটায় তারা নিজেরাই।

অনেকেরই মনে আছে, সেই ২০১২ সালের ১৪ ডিসেম্বরের ঘটনা। ২০ বছরের স্যান্ডি হোক সেই একই কায়দায় ঘটিয়েছিলো আরেক নৃশংস ঘটনা। একটা স্কুলের ৬ থেকে ৭ বছরের ২০ জন শিশুকে একে একে গুলি করে হত্যা করে সে, আরও হত্যা করে স্কুলের শিক্ষকসহ ছয়জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে। এই হত্যাযজ্ঞ ঘটানোর আগে সে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলো তার মা-কেও। স্যান্ডি হোকের এই নৃশংসতার পর বন্দুক কিংবা গান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে হৈ চৈ পড়েছিলো যুক্তরাষ্ট্রে। ‘গান কন্ট্রোল’ আর ‘গান রাইট’ এর চুলাচুলিতে শেষ পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয় নি। না, পারে নি ওবামা প্রশাসনও।

আর কিভাবেই ঠেক্কা দেবে আমেরিকা, কেন-ই বা নিয়ন্ত্রণ করবে গান ? পুরোপুরি হিসাব না থাকলেও দেখা যাচ্ছে আমেরিকার জনগণের কাছে আছে ২৭০ মিলিয়ন থেকে ৩১০ মিলিয়নের মতো ব্যক্তিগত বন্দুক। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখার কথা বলে তারা তাদের হাতে রেখেছে এই বন্দুকগুলো। এত মিলিয়ন গানের বিপরীতে কে কাকে নিরাপত্তা দেবে, সে ব্যাখ্যায় না গিয়ে আমরা একটাবার যদি কল্পনা করি, তাহলে দেখবো কত বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন ডলারের গান ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে বন্ধুক ব্যবসায়ীরা অর্থাৎ আমেরিকার প্রশাসন কত মিলিয়ন ডলার তার রাজস্ব ভাণ্ডারে নিয়ে আসছে রক্তের এই খেলা তার দেশের অভ্যন্তরে জিইয়ে রেখে প্রতি মাস কিংবা বছরের পর বছর। পৃথিবীর দেশে দেশে তাদের সে ব্যবসার কথা এখানে না-ই বা উল্লেখিত হলো।

৩) জসিম মন্ডলের এই কথাটাই সঠিক ‘ইাহার নাম বিজ্ঞান, ইহার নাম অংক’। বিজ্ঞান কিংবা অংক’র সূত্রগুলো বদলে না। বিজ্ঞানের ব্যাখ্যায় রদবদল হয়, বিভিন্ন জনের কাছে। সেরকমই দেশে দেশে এই অংক রদবদল হচ্ছে। তৃতীয় বিশ্ব কিংবা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সম্পদের পাহাড় গড়তে মানুষকে শোষণ করতে হয়, নিঃস্ব করতে হয়, ঠকাতে হয়। আর উন্নত দেশগুলোতে মানুষের অর্থগুলো নিজের ব্যাংকে নিয়ে আসতে সরকারই বৈধতা দেয়। এর জন্যে কায়দা করে জনগণের নিরাপত্তার কথা বলে ৩১০ মিলিয়ন বন্দুকের অবাধ বাণিজ্যটাও নিশ্চিত করে তারা। অর্থাৎ প্রকারান্তরে খুন-খারাবিরও যেন লাইসেন্স দেয়। সেজন্যেই স্যান্ডি হোকের নৃশংসতার পরও আমেরিকা জেগে উঠে নি। ‘গান কন্ট্রোল’ মানবাধিকার গ্রুপের কথায় কর্ণপাতই করে নি আমেরিকা। স্টিফেন প্যাডকের ৫৯ জনের প্রাণ নেয়ার পরও কিংবা হোটেল রুমে ২৩টা আগ্নেয়াস্ত্র পাবার পরও তাদের গান-সংস্কৃতির কোন পরিবর্তন কি হতে পারে এ প্রশ্নটি উঠে আসছে এবারও আমেরিকায়।

এবারও আগ্নেয়াস্ত্র কিংবা গান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ছয় বছর আগে এরকমই একটা বন্দুক আক্রমণ থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া সাবেক কংগ্রেস-নারী গাব্রিয়েল গিফোর্ড লাস ভেগাসের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমেরিকায় গান নিয়ে কঠোর নীতিমালা প্রণয়নের জন্যে আহ্বান জানিয়েছেন। আমেরিকার গণমাধ্যমে তার স্বামীসহ তাদের দেয়া যৌথ বিবৃতিতে তার স্বামী বলেছেন, হোয়াইট হাউসের শুধু ‘চিন্তা আর প্রার্থনাটা’ই এখন শুধুমাত্র সমাধান নয়। কিন্তু পাত্তাই দিতে চাচ্ছে না হোয়াইট হাউস।

হোয়াইট হাউস প্রেস সেক্রেটারি সারা হাকাবি হোয়াইট হাউসের প্রেস ব্রিফিং এ বলে দিয়েছেন, ‘গান কন্ট্রল নিয়ে বিতর্কের সময় এখন নয়’। এ ব্যাপারে কোন কিছুই বলেন নি দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট গণমাধ্যমে দুলে দুলে তার শোক জানিয়েছেন, প্রার্থনা করেছেন। বলেছেন স্টিফেন প্যাডক একজন মানসিক রোগী। স্টিফেনের এ আক্রমণের দায় নিয়ে আইসিস‘র স্বীকারোক্তিতে হাস্যরসের সৃষ্টি হবে তাই হয়তো ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের আওতায় ফেলে দেয়া যায়নি এ হত্যাযজ্ঞকে।

৪) সারা পৃথিবীতেই হত্যাকাণ্ড যেন একটা ব্যবসার নাম। যেখানেই নৃশংসতা জীবন্ত হয়, রক্ত আর চিৎকারে পৃথিবী হা-হুতাশ করে উঠে, সেখানেই উচ্চারিত হতে থাকে মানবতার নৃশংস পতনের কথা আর সেখানেই উঠে আসে হাজার হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্যেরও কথা। সাম্প্রতিক মিয়ানমারের হত্যাযজ্ঞ সে ব্যাপারটাই দেখিয়ে দিলো। চীন-ভারত থেকে শুরু করে পশ্চিমা বিশ্ব যেন তাকিয়ে দেখলো এবং তারপর হাজার হাজার কোটি টাকার ত্রাণ-বাণিজ্য ধরিয়ে দিলো। মানবতার গান গাইতে থাকলো। কিন্তু যা হবার তা হলো। একটা জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার সুনিপুণ প্রক্রিয়ার সফলতা তারা নিশ্চিত করে ফেললো। খুন করলো দশ হাজারেরও বেশি মানুষ। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো মানবতকামী বিশ্ব, এই নৃশংসতার মধ্যি দিয়েই আগামীর ব্যবসা-বাণিজ্যের সামরিক ঘাঁটির যেন এক আধার বানিয়ে ফেললো তারা ঠিকই।

৫) লাস ভেগাসের হত্যাকাণ্ডের পর সেখানেও আমেরিকান অস্ত্র বাণিজ্যেরই কথাই প্রাধান্য পাবে। নৃশংসতা বন্ধ করার কোন উদ্যোগ নেই। ৫৯ জন মানুষের মরণে কি মারণাস্ত্রের অভ্যন্তরীণ ব্যবসা বন্ধ করতে হবে ? হোয়াইট হাউসতো সে কথাই জানিয়ে দিলো।

লেখক : লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক।

এইচআর/আরআইপি

‘স্টিফেনের এ আক্রমণের দায় নিয়ে আইসিস‘র স্বীকারোক্তিতে হাস্যরসের সৃষ্টি হবে তাই হয়তো ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের আওতায় ফেলে দেয়া যায়নি এ হত্যাযজ্ঞকে।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।