সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয়

প্রভাষ আমিন
প্রভাষ আমিন প্রভাষ আমিন , হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ
প্রকাশিত: ০৬:১৯ এএম, ০৩ অক্টোবর ২০১৭

রোহিঙ্গা সমস্যা নাটকীয় অগ্রগতি হয়েছে। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চির দপ্তরের মন্ত্রী কিউ টিন্ট সোয়ে বাংলাদেশ সফরে এসে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক শেষে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হবে।

গত ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তাণ্ডব শুরুর পর বাংলাদেশে রোহিঙ্গহাদের যে ঢল নামে তা কমে এলেও বন্ধ হয়নি। টেকনাফে যখন এখনও রোহিঙ্গা আসছে, তখন মিয়ানমারের মন্ত্রীর এই আশ্বাসে আস্থা রাখা কঠিন। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে, এটা অবশ্যই বাংলাদেশের কূটনৈতিক বিজয়। যাদের তারা নাগরিক বলেই স্বীকার করে না, তাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হওয়াটা শুধু কূটনৈতিক নয়, বাংলাদেশের নৈতিক বিজয়ও। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের ঘাড়ে চেপে বসা এই সমস্যার স্থায়ী ও বাস্তবসম্মত সমাধান প্রয়োজন।

আমি খুব আশাবাদী মানুষ। সবকিছুতেই একটা না একটা ইতিবাচক কিছু খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু বছরের পর বছর মিয়ানমারের অমানবিক আচরণ দেখতে দেখতে তাদের আশ্বাসে আস্থা রাখতে ভয় হচ্ছে। ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পায়। একবার চুন খেয়ে মুখ পুড়লে, পরে দই দেখলেও খেতে মন চায় না।

এটা অস্বীকার করার জো নেই, বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতার কারণেই রোহিঙ্গা ইস্যু এখন আন্তর্জাতিক মহলের নজর কেড়েছে। প্রথমবারের মত এই ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা হয়েছে। বিশ্বের প্রায় সব মানবাধিকার সংগঠন মিয়ানমারের আচরণের নিন্দা করেছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞকে গণহত্যা ও জাতিগত নিধন হিসেবে স্বীকার করেছে। বাংলাদেশ খুব সাফল্যের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক রোহিঙ্গা ইস্যুকে আন্তর্জাতিক ইস্যু বানিয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারের মন্ত্রীর এই সফরকে আমার কাছে কেন জানি ফাঁদ মনে হচ্ছে। মিয়ানমার আবার আন্তর্জাতিক ইস্যুকে দ্বিপাক্ষিক বানিয়ে ফেলতে চাইছে না তো?

রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চাই, বাংলাদেশে এসে এই ঘোষণা দিয়ে মিয়ানমারের মন্ত্রী আসলে বিশ্বকে একটা নতুন বার্তা দিলেন। কেউ কিছু বললেই মিয়ানমার এখন বলবে, আমরা সমস্যা সমাধানে আন্তরিক। বাংলাদেশের সাথে আলোচনা হচ্ছে। আমরা যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ করছি। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবো। এরপর তো আসলে মিয়ানমারকে আর বলার কিছু থাকবে না। কিন্তু মিয়ানমারের মন্ত্রী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ঘোষণা শুনে আমার মনে প্রথম যে প্রশ্নটি এসেছে, তা হলো, কবে নেবেন, কয় জন নেবেন? বাংলাদেশে এখন কমবেশি ১০ লাখ রোহিঙ্গা আছে।

এদের মধ্যে অনেকে আছেন ৩০ বছর ধরে। তবে একটা বড় অংশ এসেছে গত ২৫ আগস্টের পর। মিয়ানমারকে আমি বিশ্বাস করি না, কারণ তারা এর আগে একাধিকবার কথা দিয়ে কথা রাখেনি। আর এবার ২৫ আগস্টের পর থেকে তারা একের পর এক মিথ্যাচার করে যাচ্ছে। প্রথম কথা হলো, তারা তো সমস্যাটা স্বীকারই করতে চাচ্ছে না। মিয়ানমার আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থাকে সেখানে যেতে দেয়নি। তো এই মিয়ানমার এখন ভালোয় ভালোয় রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে, এটা আমার বিশ্বাস হয় না। আর মিয়ানমারের আন্তরিকতা নিয়ে আমার সবচেয়ে বড় সংশয়, কারণ তাদের মন্ত্রী বাংলাদেশে এলেও টেকনাফ যাননি। টেকনাফ না গেলে তিনি কিভাবে বুঝবেন, তাদের সেনাবাহিনী কতটা নিষ্ঠুর?

যে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের কথা বলা হয়েছে, তা হতে পারে কালক্ষেপণের এক বড় অস্ত্র। তারচেয়ে বড় কথা হলো, এই ওয়ার্কিং গ্রুপে বাংলাদেশ-মিয়ানমার ছাড়া আর কেউ থাকবে না। জাতিসংঘকে এই প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত রাখা উচিত ছিল। অতীত অভিজ্ঞতা বলে, এই ওয়ার্কিং গ্রুপ মাসের পর মাস কাজ করবে, এমনকি তা বছরও পেরিয়ে যেতে পারে। তারচেয়ে বড় শঙ্কা হলো, মিয়ানমার কয় জন রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেবে? অং সান সু চি তার বক্তৃতায় বলেছেন, তারা যাচাই বাছাই করে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে। কিন্তু যাচাই বাছাইয়ের প্রক্রিয়াটা কী হবে? মিয়ানমার যেহেতু রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়নি, তাই তাদের মিয়ানমারের পরিচয় নিশ্চিত করার মত খুব বেশি কাগজপত্র নেই। কারো কারো কাছে জমির দলিল বা অনেক পুরোনো পরিচয়পত্র আছে। তাও সবার কাছে নেই।

বাংলাদেশ তাদের বায়েমেট্রিক রেজিস্ট্রশেন করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু সে সংখ্যা এখনও হাজারের ঘরে। পুরো ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আসলে কখনোই রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় আনা সম্ভব নয়। তা ছাড়া রোহিঙ্গাদের অনেকেই ক্যাম্প ছেড়ে ছড়িয়ে পড়েছেন দেশের বিভিন্নস্থানে। আর মিয়ানমার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না দিলে তাদের অনেকেই ফিরে যেতে চাইবেন না। এখন মিয়ানমার যদি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের নামে সময় নষ্ট করতে থাকে, ততদিনে বিশ্বের নজর সরে যাবে। এই মুহূর্তে মিয়ারনমার যে চাপটা অনুভব করছে, ছয় মাস বা একবছর নিশ্চয়ই তা করবে না।

গণহত্যা চলার সময়ই তাদের গলা যতটা বড় ছিল, আর ছয় মাস পরে রাখাইন পরিস্থিতি সত্যি সত্যি শান্ত হলে; মিয়ানমারের গলাবাজির সামনে দাঁড়ানোই কঠিন হবে। আচ্ছা ধরে নিচ্ছি, ওয়ার্কিং গ্রুপ খুব ভালো কাজ করলো। একবছর পর মিয়ানমার যাচাই বাছাই করে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে সম্মত হলো। তখন কিন্তু তারা জোর গলায় বিশ্বকে বলবে, দেখো আমরা এ-ক লা-খ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিচ্ছি। তখন কিন্তু অং সান সু চির নামে ধন্য ধন্য পড়ে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশের ঘাড়ে তখনও থেকে যাবে আরো ৯ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা। তাদের নিয়ে বাংলাদেশ কী করবে? সমস্যাটা সত্যি সত্যি জটিল এবং দীর্ঘমেয়াদী। তাই এর সমাধানেও প্রয়োজন ছিল বহুমাত্রিক উদ্যাগ। এখনও সুযোগ থাকলে ওয়ার্কিং গ্রুপে জাতিসংঘকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানাচ্ছি।

আগেই বলেছি, আমি খুব আশাবাদী মানুষ। আর আমি এও জানি, এই সমস্যার শান্তিপূর্ণ, কূটনৈতিক সমাধানের কোনো বিকল্প নেই। তাই সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পেলেও, আশা করি সেই মেঘের আড়ালেই হাসবে সম্ভাবনার নতুন সূর্য।

২ অক্টোবর, ২০১৭
[email protected]

এইচআর/পিআর

যে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের কথা বলা হয়েছে, তা হতে পারে কালক্ষেপণের এক বড় অস্ত্র। তারচেয়ে বড় কথা হলো, এই ওয়ার্কিং গ্রুপে বাংলাদেশ-মিয়ানমার ছাড়া আর কেউ থাকবে না। জাতিসংঘকে এই প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত রাখা উচিত ছিল

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।