মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় নম্বর কাটা কতটা যৌক্তিক?

ডা. পলাশ বসু
ডা. পলাশ বসু ডা. পলাশ বসু , চিকিৎসক ও শিক্ষক
প্রকাশিত: ০৪:২৫ এএম, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বর্তমানে দেশের সকল সরকারি এবং বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা যে এমসিকিউ পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে তা মূলত শুরু হয়েছে ১৯৮৮-৮৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে নানা অভিজ্ঞতার আলোকে সে পদ্ধতিতে নানা পরিবর্তনও এসেছে।

পরিবর্তনের সে ধারায় আমরা দেখতে পাই নিয়ম তৈরি এবং তা প্রয়োজনে বদলের যৌক্তিক সিদ্ধান্তের নানা বিষয়। যেমন ২০১২ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মেডিকেল কলেজগুলোতে এসএসসি-এইচএসসিতে প্রাপ্ত জিপিএ’র ভিত্তিতে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। পরে অবশ্য নানা আলোচনা-সমালোচনার পরে সেটা বাতিল করে আবার আগের নিয়মে ১০০ নম্বরের এমসিকিউ পরীক্ষা নেয়া হয়েছিলো।

আবার ২০১৬ সালে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার মোট নম্বর ২০০ থেকে বাড়িয়ে ৩০০ করার চিন্তাভাবনা করা হয়েছিলো। পরবর্তীতে সে সিদ্ধান্ত থেকে মন্ত্রণালয় সরে আসে। আবার ৯০ দশকের একটা সময়ে লিখিত পরীক্ষার পরে ২০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হতো। মৌখিক পরীক্ষায় নানা প্রভাব বিস্তারের কারণে সেটা যৌক্তিকভাবেই পরবর্তীতে বাতিল করা হয়।

২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে আবেদন করার ন্যূনতম যোগ্যতা বাড়িয়ে মোট জিপিএ ৮ এর স্থলে ৯ করা হয়। এর কারণ হিসেবে অধিক সংখ্যক ছেলে-মেয়ের জিপিএ ৫ প্রাপ্তির কথা উল্লেখ করা হয়। জিপিএর সংখ্যাবৃদ্ধির ফলে এ সিদ্ধান্ত সঠিকই ছিলো। তবে, এবারের এসএসসির রেজাল্ট যদি এইচএসসিতেও অব্যাহত থাকে (জিপিএ ৫ প্রাপ্তির সংখ্যা কমে যাওয়া) তাহলে মনে হয় তা আবার কমিয়ে ৮ করতে হতে পারে। সেটা অবশ্য ভবিতব্যের ব্যাপার।

এ সকল বিষয়াবলী তুলে ধরার মাধ্যমে আমি দেখাতে চেয়েছি মেডিকেলে ভর্তি প্রক্রিয়া সময়ের সাথে সাথে নানাভাবে বদলেছে। এ বদলের উদ্দেশ্য হচ্ছে ইতিবাচকভাবে সময়ের সাথে সাথে পরীক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে এটাকে আরো গ্রহণযোগ্য এবং সময়োপযোগী করা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবারে অর্থাৎ ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস এবং বিডিএস কোর্সে প্রথম বর্ষের ভর্তির আবেদনে যারা প্রথমবার ভর্তির সুযোগ না পেয়ে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে তাদের প্রাপ্ত জিপিএ থেকে মোট ৫ নম্বর কেটে মেধাতালিকা প্রণয়ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা অত্যন্ত বৈষম্যমূলক মনে হয়েছে। যদিও এ নিয়ে রিটের প্রেক্ষিতে এখন আগামী ৩ অক্টোবর আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানি শেষে সিদ্ধান্ত আসবে যে এ নম্বর কাটা যৌক্তিক না অযৌক্তিক। আদালতের রায়ের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া এখন আর কোনো উপায় নেই । তবে মন্ত্রণালয় নিজে থেকে এ সিদ্ধান্ত যদি প্রত্যাহার করে তাহলে ভিন্ন কথা।

এদিকে যারা প্রথমবার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে সরকারি মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পেয়ে আবারো প্রথম সারির সরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ নিতে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছে তাদের জন্য আগের বছরে ৫ নম্বর কাটার সিদ্ধান্তকে বাড়িয়ে যে ৭.৫ করা হয়েছে সেটা অত্যন্ত যৌক্তিক। কিন্তু যারা প্রথমবার ভর্তির সুযোগ না পেয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে তাদের প্রাপ্ত নম্বর থেকে ৫ নম্বর কেটে নেয়ার সিদ্ধান্ত অত্যন্ত অমানবিক। দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দেয়া কি অপরাধ? অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এখন আর ছেলে-মেয়েদেরকে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ দেয় না। এর কারণও অত্যন্ত অযৌক্তিক। কারণ হিসেবে বলা হয়ে থাকে দ্বিতীয়বার যারা পরীক্ষা দেয় তারা প্রস্তুতিতে অনেক এগিয়ে থাকে। সে তুলনায় প্রথমবার যারা পরীক্ষা দেয় তারা অনেক পিছিয়ে থাকে।

এটা হয়ত সত্য। কিন্তু তার চেয়েও বড় সত্য হচ্ছে, যে ছেলে বা মেয়েটি তার পেশাগত জীবনে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখে সেটাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য সে তো আরো একটা বছর নিরন্তর চেষ্টা করে তবেই তো ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। কোনো রকম দয়া দাক্ষিণ্য তো তাকে দেখানো হয় না। দ্বিতীয়বার একটা ছেলে-মেয়েকে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ দিয়ে তার জীবনের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে উৎসাহিত করাকে এখন যদি কেউ মনে করেন ”দয়া দাক্ষিণ্য” তাহলে বলার কিছু নেই। ব্যক্তির সে চিন্তাকে শ্রদ্ধা জানাই।

তবে, রাষ্ট্রের চিন্তা এমন একমুখি, কঠোর এবং বৈষম্যমূলক হওয়ার সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না। কারণ রাষ্ট্রতো ঘোষণা দিয়েছে যে সে তার সকল নাগরিকের সাথে সমান আচরণ করবে। কোনোরকম বৈষম্য করবে না। কিন্তু এখানে মনে হচ্ছে তার ব্যত্যয় হচ্ছে। তাই, সদাশয় কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারটা নিয়ে আবারো ভেবে দেখতে পারেন। সেটাই বরং যৌক্তিক হবে।

পারিবারিক নানা দুর্ঘটনা, অনাকাঙ্খিত অনেক ঝামেলার কারণে প্রতি বছরই কিছু ছেলে-মেয়ে দেখা যায় যে ভর্তি পরীক্ষার আগে যথাযথ প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এমনকি পরীক্ষার আগের দিন বা সকালে প্রিয় মানুষের মৃত্যু বা দুর্ঘটনার সংবাদ যখন আসে তখন স্বাভাবিকভাবেই সে মুষড়ে পড়ে। তার কি পরীক্ষা দেয়ার মন মানসিকতা কিছু আর অবশিষ্ট থাকে তখন? অথচ এমন ঘটনার পেছনে তাদের তো কোনো দায় ছিলো না। তাই অন্তত তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও ( যদি এমন একজনও থেকে থাকে তাহলেও) দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ কোনো রকম বৈষম্য না করেই বহাল রাখা উচিত।

এ লেখা পড়ে কেউ কেউ হয়ত মনে করতে পারেন আমি দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে সরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছি বলেই হয়ত বা দ্বিতীয়বার মেডিকেলে যারা ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছে তাদের প্রাপ্ত নম্বর থেকে ৫ নম্বর না কেটে নেয়ার জন্য সুপারিশ করছি। বিনয়ের সাথে তাদের জন্য বলছি আমি প্রথমবারেই চান্স পেয়েছিলাম।

তাহলে হয়ত মনে প্রশ্ন জাগছে, কেন তবে আমি দ্বিতীয়বার যারা পরীক্ষা দিয়েছে তাদের জন্য কলম ধরছি। উত্তর হচ্ছে, আমার যেসব বন্ধু দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলো তাদের অনেকে আজ কৃতিত্বের সাথে এমবিবিএস পাস করে অতঃপর নানা রকম ডিগ্রি নিয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে অত্যন্ত সুনামের সাথে কাজ করে চলেছে। তারা দেশের সেবা করছে অত্যন্ত যোগ্যতার সাথেই। আমাদের দেশের প্রথিতযশা এমন অনেক চিকিৎসকই আছেন যারা হয়ত দ্বিতীয়বারে মেডিকেলে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছেন। ফলে কে প্রথমবার আর কে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেয়েছিলো সেটা নিয়ে আজ আর আমাদের কারো ভাবার সময় নেই।

আমার সে বন্ধুদের কথা যখন মনে হয় তখনই আমার মনে হয় শুধু মেডিকেল নয় বরং সব প্রতিষ্ঠানেই দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ দিয়ে একটা ছেলে বা মেয়ের স্বপ্নপূরণের সুযোগ উন্মুক্ত রাখা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সে সুযোগ কোনোভাবে বন্ধ তো নয়ই বরং সেটাকে কোনোরকম বৈষম্যমূলক নিয়মের বেড়াজালে না ফেলে স্বাভাবিকভাবেই অব্যাহত রাখা উচিত। সেটা করলে ক্ষতি কি?

লেখক : চিকিৎসক ও শিক্ষক, সহযোগী অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ।

এইচআর/এমএস

‘যারা প্রথমবার ভর্তির সুযোগ না পেয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে তাদের প্রাপ্ত নম্বর থেকে ৫ নম্বর কেটে নেয়ার সিদ্ধান্ত অত্যন্ত অমানবিক।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।