বিএনপির ভারতনীতি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক সফর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ওলটপালট ঘটিয়ে দিয়েছে। আগের সপ্তাহে এই কলামে লিখেছি, এই সফর বাংলাদেশের রাজনীতির ভারসাম্যটাই নষ্ট করে দিয়েছে। ছোটখাটো বাম দলগুলোকে বাদ দিলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন আর ভারতবিরোধী শক্তি নেই বললেই চলে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতবিরোধী অংশের নেতৃত্ব ছিল বিএনপির হাতে। কিন্তু সেই বিএনপিই এবার সারেন্ডার করেছে। মোদি আসার আগে থেকেই বিএনপি বারবার বলার চেষ্টা করেছে, বিএনপি কখনো ভারতবিরোধী ছিল না, এখনও নেই, ভবিষ্যতেও ভারতবিরোধিতা করবে না। এই শর্তহীন আত্মসমর্পনের কারণ বুঝতে অসুবিধা হয় না। বিএনপি বুঝে গেছে, বৃহৎ প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক না রেখে রাজনীতিতে টিকে থাকা কঠিন। সাধারণ বিশ্বাস, ভারত পাশে ছিল বলেই আওয়ামী ৫ জানুয়ারির মত একটি প্রার্থীবিহীন, ভোটারবিহীন নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারছে। তাই বেগম জিয়া তথা বিএনপি ভারতের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের জন্য উঠে পড়ে লাগে।
বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদির সাথে বেগম জিয়ার সাক্ষাত নিশ্চিত করতে ব্যাপক তৎপরতা চালায় বিএনপি। বেগম জিয়া অভিযোগ করেছেন, তাঁর সাথে যাতে নরেন্দ্র মোদির সাক্ষাত না হয়, সে জন্য সরকার অনেক চেষ্টা করেছে। এই অভিযোগ সত্যি। নরেন্দ্র মোদি আসার আগের দিন দুপুরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাহমুদ আলী বলেছিলেন, বেগম জিয়ার সাথে নরন্দ্রে মোদির সাক্ষাত হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু তার কয়েক ঘণ্টা পরেই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব জয়শংকর ঘোষণা করেন নরেন্দ্র মোদির সাথে বেগম জিয়ার সাক্ষাত হবে। তার মানে সরকারের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে এবং নরেন্দ্র মোদির সাথে বেগম জিয়ার সাক্ষাত হয়েছে।
বিএনপি মুখে যতই বলুক তারা ভারতবিরোধী ছিল না, এখনও নেই, ভবিষ্যতেও হবে না; কিন্তু তাদের তৎপরতায় এটা বিশ্বাস করানো কঠিন। কারণ বিএনপির রাজনীতিটাই ভারতবিরোধিতা থেকে উৎসারিত। আওয়ামী লীগকে ভারতের দালাল হিসেবে চিহ্নিত করে, তারা ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে দেবে, এমন জুজুর ভয় দেখিয়েই বছরের পর বছর রাজনীতি করে এসেছে বিএনপি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে দেশে মসজিদে আজানের বদলে উলুধ্বনি শোনা যাবে, পার্বত্য শান্তি চুক্তি হলে ফেনী পর্যন্ত ভারত হয়ে যাবে- এসবই বিএনপির রাজনৈতিক পুঁজি। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরা বরাবরই আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। এ কারণে বিএনপি ক্ষমতায় এলেই নির্যাতনের শিকার হয় সংখ্যালঘুরা। তাই সামগ্রিক রাজনৈতিক চিন্তায় পরিবর্তন না এনে খালি মুখে বললেই রাজনীতির বদল হয়ে যাবে না। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকতে ভারতে যাওয়ার জন্য আনা ১০ ট্রাক অস্ত্র ধরা পড়ে। পরে জানা যায়, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়ই এ অস্ত্র পরিবহন করা হচ্ছিল। তাই ভারতকে মুখের কথায় সন্তুষ্ট করতে পারবে না বিএনপি। সত্যি সত্যি নিজেদের বদলাতে হবে।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইদানিং যে বিষয়টি বেশি আলোচিত হচ্ছে, তাহলো কোনো দলের সাথে সম্পর্ক নয়, জনগণের সাথে জনগণের সম্পর্কটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিকভাবেই আওয়ামী লীগের সাথে কংগ্রেসের সম্পর্ক ভালো। তাই বলে কি বিজেপির সাথে সম্পর্ক আওয়ামী লীগের সম্পর্ক খারাপ হবে? শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু, এই সূত্রে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি উল্লসিত হয়েছিল। কিন্তু সেই সূত্র খাটেনি। বিজেপি আওয়ামী লীগ-বিএনপি দেখেনি। তারা দেখেছে ভারতের স্বার্থ, আমাদের রাজনীতিবিদদের মধ্যে যেটা কম।
সাক্ষাতকালে বেগম খালেদা জিয়া মোদির কাছে বাংলাদেশে গণতন্ত্রহীনতার কথা বলেছেন। আর মোদি বলেছেন, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে তারা থাকবেন না। তার মানে ইঙ্গিত স্পষ্ট, বিএনপিকে জামাতের সঙ্গ ছাড়তে হবে। কিন্তু সাম্প্রতিক কথাবার্তায় মনে হচ্ছে, ভারতের সাথে সম্পর্ক এবং জামায়াতের সাথে সম্পর্ক নিয়ে দোটানায় আছে বিএনপি। আমার ধারণা, বিএনপি ভাবছে, জামায়াতকে ছাড়ার পরও যদি ভারত তাদের পুরোপুরি সহায়তা না করে, তাহলে তো এ কূল ও কূল দুই কূলই যাবে। বিএনপি আসলে দীর্ঘদিনের অবস্থান পাল্টাতে একটু দ্বিধায় ভুগছে। আমার ধারণা তারা লাভক্ষতির হিসাব করছে।
গত রোববার এক অনুষ্ঠানে বেগম খালেদা জিয়া ভারতের নাম উল্লেখ না করে ট্রানজিটের বিষয়টি ইঙ্গিত করে বলেছেন, বন্ধুত্ব ভালো। কিন্তু নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে বন্ধুত্ব কেউ চায় না। সমানে সমান হলে সেটাকে বন্ধুত্ব বলে। না হলে সেটা হয় দাসত্ব। তিনি বলেছেন, যমুনা সেতু দিয়ে যেতে বাংলাদেশের জনগণকে টোল দিতে হয়। কিন্তু অন্য অনেক দেশ সেতু ব্যবহার করে টাকা-পয়সা দেবে না, কিছু দেবে না। হেভি হেভি গাড়ি যাবে, টোল দেবে না। এ রাস্তা কি লোড নিতে পারবে? তিনি আরও বলেন, যাতায়াতে বাধা দিচ্ছি না। কিন্তু টাকা দিয়ে যাবে। বেগম খালেদা জিয়াকে অনেক ধন্যবাদ। ভারতের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনোভাবেই যেন আমরা আমাদের স্বার্থ ভুলে না যাই। আমি চাই, বাংলাদেশে ভারতের পক্ষ বা ভারত বিরোধী দল বা রাজনৈতিক শক্তি থাকবে না। বাংলাদেশের সব দল হবে প্রো বাংলাদেশী। ভারত আমাদের বড় প্রতিবেশী, তাদের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব থাকবে। কিন্তু সবকিছুর ওপরে যেন আমরা আমাদের স্বার্থটাই বুঝে নেই।
এইচআর/আরআই