রোহিঙ্গা : বিশ্বের সবচেয়ে অত্যাচারিত এক জনগোষ্ঠি

তানজীনা ইয়াসমিন
তানজীনা ইয়াসমিন তানজীনা ইয়াসমিন , কলামিস্ট, গবেষক
প্রকাশিত: ০৪:২৫ এএম, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭

 

তখন বয়স ৭/৮ হবে। স্কুল ছুটিতে সপরিবারে ফরেস্ট অফিসার একমাত্র খালুর বাসা চিটাগং বেড়াতে গেছি । প্রতিদিন নতুন নতুন আনন্দ । হঠাৎ একদিন উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে জানতে পারলাম বিদেশে যাচ্ছি! কি না সেই বিদেশে নৌকা করে যেতে হয়। তখন যা শুনি তাতেই মাস্ক ছবির জিম ক্যারির মত চক্ষু বিস্ফারিত করে হা হয়ে থাকার বয়স, কথায় কথায় সাসপেন্স আর থ্রিলে পিলে চমকানোর বয়স। তাই রাত কাটেনা, কখন কিভাবে সেই “ বিদেশ ” যাব। পরদিন দেখলাম কোন এক পুলিশ ফাঁড়ি টাইপ জায়গা থেকে কোন পারমিশন নিয়ে আমরা নাফ নদী দিয়ে বড় এক নৌকা করে জীবনের প্রথম বিদেশ ভ্রমণ যাচ্ছি । সে দেশের নাম বার্মা, আজকের মিয়ানমার।

নাফ নদীর মাঝ বরাবর এক দিক নির্দেশনা পানির উপর মাথা জাগিয়ে জানান দিচ্ছে, “বিদায় বাংলাদেশ” অন্য পিঠে “ স্বাগতম বার্মা” । কূলে পৌঁছে কাদা মাটির টিলা মতন পেরিয়ে রাখাইন রাজ্যের এক বাজারে গেলাম। কারণ, আমাদের মুরুব্বীদের উদ্দেশ্য ছিল শুধুই শপিং করা। কাঁচের জিনিস আর কি হাবিজাবি। বাচ্চারা মায়েদের শপিং আর সিরিয়াস দাওয়াতের জায়গায় পেইন বিশেষ। এই সার্থকতা প্রমাণে যথেষ্টই ঘ্যান ঘ্যান করে সবার পিত্তি জালালাম। - এটা কি বিদেশে? বাংলাদেশের চেয়েও গরীব! বিদেশ মানে তো আমেরিকা। বিদেশ মানে হল বেহেশত! আর এরা দেখি সবাই লুঙ্গি পরে ঘোরে, মেয়েরা গালে মুখে মাটি মেখে হেটে বেড়াচ্ছে। ছিঃ ফেইসপ্যাক দিয়ে কেউ বাইরে বের হয়! এরা এমন কেন? একমাত্র মুগ্ধতা ছিল রিক্সা।

আমাদের দেশের চেয়ে ভিন্নতর, রিক্সাচালকের পাশে একজন আর উল্টা দিকে পিঠ ফিরিয়ে দুইজন বসার খুব প্রশস্ত সিট। অস্থির করে মারছিলাম রিক্সায় উঠবো। বলাবাহুল্য অল্প সময়ের ভেতর এন্তার বাজার করে ফেরার ব্যস্ততায় মুরুব্বীগণ আমার এহেন আহ্লাদে কর্ণপাত করেননি । আমিই শুধু ভুলভাল ডাকে রিক্সা ডেকে ডেকে ভগ্ন মনোরথে ফেরার নৌকা চড়লাম। আরো পরে আমার শ্বশুরমশাইয়ের মুখে শুনেছিলাম, মগের মুল্লুকে বাঙালিরা গিয়ে ওদের “ঠইগ্যা লই আইতো” । সেই হিসেবে ধারণা ছিল ওরা সবাই আমাদের চেয়ে সরলতর। অনেক বড় হয়েই জানলাম সেখানে বাস করে বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। এই স্বীকৃতি জাতিসংঘও ২০১৩ তে দিয়েছে ।

ধর্মভিত্তিক এই আগ্রাসনে আজ শুনি আরাকানের গ্যাস খনির লোভে চায়না, ভারত সবাই এই নির্মূলায়নে মিয়ানমার আর্মির পাশে। রোহিঙ্গাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ নেই, সরকারি চাকরিতে কোটা দূরে থাকে, কোন অধিকারই নেই। রাজধানীতে যাবার অধিকারও নেই। এমনকি আরাকান রাজ্যেও তাদের চলাফেরা সীমাবদ্ধ । সেই গন্ডিতেও এদের ওপর জোর জুলুম এতোটাই স্বাভাবিক ঘ্টনা যে এদের মেয়েরা যখন তখন ধর্ষণের ভয়ে নাকি সবসময় অন্তঃসত্ত্বা হয়ে থাকে। আশাকরি যারা আঙ্গুল তোলেন এত অনিশ্চিত জীবনে এত বাচ্চা কেন, এর একটা যুক্তিগ্রাহ্য জবাব পাবেন। একাত্তুরে ৯ মাসে আমরা মেধাশূন্য হয়ে গিয়েছিলাম। আর তারা ৬০ বছর ধরে জাতিগত নির্মূলের শিকার। তায় আবার শিক্ষাসহ বেসিক সুবিধা থেকে শুরু থেকেই বঞ্চিত। `৭১ এ ৯ মাসে পশ্চিম বঙ্গ সরকার বাংলাদেশি উদ্বাস্তুদের চাপে বাধ্য হয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করতে। আর আমরা সেই ১৯৮২ থেকে কেবল ধারণ করেই যাচ্ছি। সময়ের দাবি, মানবতার দাবি মেটাচ্ছি- কিন্তু দারিদ্র আর অনিশ্চিত জীবনের বাই প্রডাক্ট হিসেবে সব ধরনের নিষিদ্ধ প্রাণঘাতি নেশাদ্রব্য, অস্ত্র ভান্ডার আর জঙ্গিবাদের বসত পাকা করে নিজভূমিকে চূড়ান্ত অরক্ষিত করছি। এ অবস্থাতেও মানবতাকে সবার ওপরে প্রাধান্য দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সময়োপযোগী পদক্ষেপ খুব উপযুক্ত সময়েই নিয়েছেন । তবে অন্য পক্ষের কথায় এটা খুব ভাল গেইম প্ল্যান হয়েছে। আর সব অতি অতি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু আমাদের নিত্য নিয়মে এই কড়া মানবতার ভারী লেবাসে চাপা পরে গেছে।

প্রসঙ্গ উঠছে বিশ্ববরেণ্য অভিবাসীদের নাম- স্টিভ জব্স থেকে আইনস্টাইনসহ বিশ্বের চালচিত্র পাল্টে দেয়া অনেক প্রাতঃস্মরণীয়দের। এখন একজন রোহিঙ্গা থেকে কি এই আশা করতে পারি? পেরেছি কোনদিন বিহারী রিফুইজিদের কাছ থেকে? এই দুই রিফুউজিদের মূল পার্থক্য হলো রোহিঙ্গারা নিজভূম হতে প্রাণভয়ে পালিয়ে আমাদের দেশকে আকঁড়ে ধরতে এসেছে, তাদের জন্য আজো তাদের ফেলে আসা মাতৃভূমিতে জাহান্নামের আগুন, যাতে সজ্ঞানে কেউ ঝাঁপ দিতে পারেনা। আর বিহারীরা তাদের ফেলে আসা পাকিস্তানকে আজীবন বুকে লালন করেছে, ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের ভেতরে থেকে বাংলাদেশের সর্বাত্মক বেইমানি করেছে । তবুও এর এনাম হিসেবে স্থিতিশীল অবস্থায়ও পাকিস্তানি সরকার তাদের ফিরিয়ে নেবার কথা কোনদিন মুখেও নেয়নি। নিজের দেশে সর্বাধিক মাইগ্রেট করা জেলা কোনটি বলেন তো? না পদ্মার ভাঙ্গনের কবলে পড়া পদ্মা পাড়ের কোন জেলা না। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কালজয়ী “লাল সালু “ মনে পড়ে? উষর এক অঞ্চল, যেখানে শ্মশ্রু উদগমনের আগে সবাই ধর্মীয় শিক্ষায় দিক্ষিত হয়? সেই উষর অঞ্চল হল নোয়াখালী।

উষর সেই অঞ্চলে নারিকেল-সুপারি ছাড়া তেমন কিছুই হয় না বলে টিকে থাকার আশায় তারা আজীবন মাইগ্রেট করে। অন্যের ভূমিতে স্বীয় বুদ্ধিমত্তা দিয়ে জায়গা করে নিতে হয় , সকল প্রতিকূলতা জয় করে। তাই বলা হয়, নোয়াখালীরা চাঁদেও আছে, মঙ্গল গ্রহেও আছে। আমার ক্ষুদ্র জীবনে তাই আমার নিজের এই জেলার লোকদের বাস্তব জ্ঞানহীন, প্রতিকূলতা মোকাবেলায় অক্ষম প্রায় দেখিইনি। ঠিক এই সূত্রেই আমাদের দেশের মত যারা বাইরে পড়তে বা ভাগ্যান্বেষণে যান তারা দেশে থাকার সময়ের চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষা গবেষণায় সাফল্যের সাক্ষর রাখেন। কারণ, ঐ, প্রতিকূলতা আর অসম প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য নিজেকে নিজের দ্বিগুণ প্রমাণ করা, অনেকগুণ ছাড়িয়ে যাওয়া। নচেৎ, আমাদের মত নাতিশীতোষ্ণ মন্ডল, উর্বল ভূমির লোকেরা প্রচলিত সূত্রেই অলস হয়। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েও দেখেছি একবারে সুযোগ না পেয়ে ২য় বছরে বা অন্য বিভাগ থেকে মাইগ্রেট করে আসা শিক্ষার্থীরা আমাদের মত একবারে চান্স পাওয়াদের চেয়ে অনেক ভাল রেজাল্ট করতো।

প্রথমদিকের স্থানগুলি বেশিরভাগ তাদেরি দখলে থাকতো। কারণ তাদের এই বিভাগে সুযোগ পাবার প্রতি উদগ্রতা ছিল, এই পেইন তারা টের পেয়েছে যা খুব সহজে সুযোগ পেয়ে যেটা আমরা টের পাইনি। এখন এই সূত্র স্টিভ জবস, আইনস্টাইনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, রোহিঙ্গাদের জন্য নয়। তারা নিজ দেশেও এই সুযোগবঞ্চিত ছিল, আমাদের মতো জনবহুল, অনিয়মতান্ত্রিক এক দেশেও তারা বঞ্চিতই আছে। উপরন্ত বাপ দাদার ভিটা মাটি বা পেশার কোনটাই এখানে না থাকায় পেট চালাতে যে কোন পেশা আঁকড়ে ধরতেই তারা বাধ্য । সেই সুযোগেই তাদের অপব্যবহার করছে যুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মের দেশদ্রোহী অপরাধী বা আধুনিক রাজাকারগণ। সুতরাং রোহিঙ্গাদের অবশ্যই ফিরে যেতে হবে। তার আগে নিজ ভূমে প্রাথমিক নাগরিক অধিকার তাদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে। গোটা বিশ্বের বিবেকবান দেশগুলো অন্তত এই দফায় চাপ সৃষ্টি করছে, সোচ্চার হচ্ছে । এই তীব্র চাপ বলবত থাকুক। দেশে বিদেশে যারা জীবনের কোন পর্যায়ে সংখ্যালঘু বা অভিবাসী হয়েছেন তারা হয়তো কিছুটা হলেও তাদের যন্ত্রণা অনুধাবন করতে পারেন, সবটা না। তারা বিশ্বের সবচেয়ে অত্যাচারিত এক জনগোষ্ঠি। তাই অনুগ্রহ করে জবস, গায়ক আব্দুর রশীদ ( মধু খৈ খৈ বিষ খাবাইলা) এর উদাহরণ টানবেন না । কারণ , জব্স এর পটভূমি ছিল ভিন্ন, আর গায়ক জেলে আব্দুর রশীদ এক্সেপশনাল। এক্সেপশন কখনো সার্বজনীন উদাহরণ হতে পারেনা । হুজুগে সামাজিক মাধ্যমে ফলোয়ার বানানোর কথা না ভেবে দেশের, দেশের অধিবাসীদের এবং মিয়ানমার সীমানা আর মালাক্কা প্রণালী দিয়ে ছড়িয়ে যাওয়া এই দাবানলের হুমকির মুখে সমগ্র বিশ্বের পরিণতির কথা ভেবে লিখুন। যেন দীর্ঘকালীন এই বর্বতার আশু অবসান হয়, ভবিষ্যতে আর কোথাও এমন অন্যায় আগ্রাসন কোন দেশ, জাতি, ধর্মের ওপর হানা দিতে না পারে।

লেখক : কলামিস্ট; প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপান।
[email protected]

এইচআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।