ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের জয়গান
আমার ক্যাডেট কলেজের বন্ধু আরশাদ। আমরা যখন অংক করেছি বা বাস্কেটবল খেলেছি, আরশাদকে তখন আপনি পাবেন ডেস্কের আড়ালে অথবা মাঠের এক কোণায়- হাতে একটা চ্যাপ্টা প্লাস্টিকের স্কেল। চোখ দুটো বন্ধ আর স্কেলের ওপর আঙুলগুলো চলছে।
একটু খেয়াল করলে দেখবেন, সাদা স্কেলের ওপর সাইন পেন দিয়ে দাগ কাটা। ঘটনা কী? আরশাদের কল্পনায় এ স্কেলটা হচ্ছে গিটার, আর দাগগুলো হচ্ছে কর্ড। ক্যাডেট কলেজে অফিসিয়াল অনুষ্ঠান বা স্টেজ প্রোগ্রাম ছাড়া গিটার প্র্যাকটিসের সুযোগ নেই বললেই চলে- তাই মিউজিক পাগল আরশাদ স্কেলটাকেই নিজের উদ্ভাবনীশক্তি দিয়ে গিটার বানিয়ে নিয়েছে।
আমাদের পুনর্মিলনীতে আইয়ুব বাচ্চু এসেছিলেন; স্টেজের পেছনে আরশাদকে গিটার প্লে করতে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, এই ছেলে, এরকম বাজানো শিখলে কীভাবে? পাস করার পর অবশ্যই যোগাযোগ রেখো আমার সঙ্গে- তোমার হবে। গিটার লিজেন্ড আইয়ুব বাচ্চুর কথায় টপ টপ করে চোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু ঝরেছিল আরশাদের, আশে পাশে থাকা আমাদের সবারও।
এই আরশাদের পরে আর মিউজিক করা হয়নি, সামাজিক আর পারিবারিক চাপে সে হয়েছে লইয়ার। একই কাহিনী গার্লস ক্যাডেট কলেজের বান্ধবী অনীতার। নজরুল সঙ্গীতের সময় ওর `খোল খোল খোল গো দুয়ার` শুনে একেবারে উত্থাল পাত্থাল প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। এত্ত সুন্দর কেউ গাইতে পারে? এত্ত সুন্দর!!!!!
উল্লেখ্য, এই অবস্থা আমার একার না, নয়টা বয়েজ ক্যাডেট কলেজের আন্তঃক্যাডেট কলেজ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া প্রায় সবারই। ওকে আমরা ডাকতাম আমাদের লতা মুঙ্গেশকার বলে।
গান গাওয়ার পাশাপাশি প্রচণ্ড মেধাবীও ছিল অনীতা। ভালো রেজাল্ট করে দেশের প্রথম সারির একটা সরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে আজ সে ডাক্তারি করছে, দেশের বাইরে।
এমন তো হওয়ার কথা ছিল না আরশাদ বা অনীতার! ওরা সমাজের চোখে আজ সফল- একজন নাম করা কর্পোরেট লইয়ার আর আরেকজন প্রবাসী ডাক্তার। কিন্তু চিন্তা করুন তো, ওদের প্রাণের ডাক শুনতে দেয়া হলে কেমন হতো? আমরা যে একজন জো সাত্রিয়ানি বা লতা মুঙ্গেশকার পেতাম না- এর কোনো গ্যারান্টি আছে?
এবার আমার কথা বলি ছোট্ট করে। আমার স্বপ্ন ছিল ক্রিকেটার হবার। লম্বা ছিলাম সেই ছোটবেলাতেই, পেস বল করতাম। খুলনা বড়মাঠে সেকেন্ড ডিভিশন খেলা ভাইয়াদের বল কুড়িয়ে দিতাম, মাঝে মাঝে নেট প্র্যাকটিস করতাম। সে সময়ে খুব নাম করা একজন প্লেয়ার ছিলেন ওখানে, খোকন ভাই। নেটে একবার উনার মিডল স্ট্যাম্প উড়িয়ে দেবার পর প্র্যাকটিস শেষে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন- খেলাটা ছাড়িস না খবরদার!
খুব স্বপ্ন ছিল বিকেএসপিতে পড়ার- পড়া হয়নি। ক্লাস সিক্সে ওঠার পর হাকিম স্যারের ক্যাডেট কোচিং, সেভেনে সোজা ক্যাডেট কলেজ। বাংলাদেশ জাতীয় দলের টিম সিকিউরিটি অফিসার হিসেবে ওদের সঙ্গে একই বাসে যাবার দুর্লভ সুযোগ পেয়েছি কয়েকবার। ওদেরকে দেখি, আর নিজের অজান্তেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে, জানেন?
ওপরের প্রত্যেকটা কাহিনী গলা টিপে স্বপ্নকে হত্যা করার, আকাশে উড়তে চাওয়া পাখির ডানা দুটো মুচড়ে ভেঙে দেবার। মানুষ খুনের জন্যে জেল জরিমানা ফাঁসি আছে, স্বপ্নহত্যার জন্যে আদালতও নেই, জেলও নেই।
আছে শুধু সমাজের তথাকত্থিত বাহবা- আপনি বিপদে পড়ামাত্র যে সমাজ ইঁদুরের গর্তে লুকোবে। যে সমাজের ভয়ে আমাদের বাবা-মায়েরা সন্তানের স্বপ্নকে গলাটিপে হত্যা করেন, আমি জানতে চাই সে সমাজ আসলে আমাদের ঠিক কোন উপকারে সত্যি সত্যি আসে। সমাজ কি আপনার মোবাইলের বিল দেয়? আপনি অসুস্থ হলে আপনার ওষুধ কেনার টাকা দেয়?
আরো বেসিক একটা প্রশ্ন করি- সমাজ বলতে আপনি আসলে কী বোঝেন? ঝকঝকে ফর্সা ছেলের সঙ্গে প্রেম অসামান্য মেধাবী একটি মেয়ের- যার গায়ের রঙ দুধে আলতা নয়, কিন্তু মনের রঙের ঔজ্জ্বল্য সূর্যকিরণের মতোই। ছেলে বিয়ে করতে চাইলো, মা দিলেন বাধা- `সারাজীবন স্বপ্ন দেখে এসেছি আমার নাতি-নাতনির গায়ের রঙ আমার ছেলের মতো হবে, শ্যামলা বউ ঘরে আনলে সারাজীবন আমার বুকের ভেতরে একটা আহাজারি থাকবে- আর বিয়ের দিন মানুষ বলবে কী?!`
যারা অনুষ্ঠান করে বিয়ে করেছেন তাদেরকে একটা ছোট প্রশ্ন- বিয়ের অনুষ্ঠানে স্টেজে বসে যত মানুষ আপনি দেখেছেন, একটু বলুন তো তাদের কতজনের সঙ্গে পরের মাসে আপনার দেখা হয়েছে? আরো ডিটেইলসে গিয়ে প্রশ্ন করি, এদের কতজনকে আপনি ভালোভাবে চেনেন? আপনার সংসার জীবনে এদের ইমপ্যাক্ট ঠিক কতটুকু?
Are these the people you call society? জীবনে একবার দেখা হওয়া মানুষগুলো কী বলবে না বলবে ওটা নিয়ে আপনি আপনার অনুভূতিকে নিজ হাতে জবাই করবেন? সিরিয়াসলি???!!
বিশ্বাস করুন বা না করুন, ঠিক এই কাজটা আমরা প্রতিনিয়ত করে চলেছি। আমাদের বাবা-মায়েরা তথাকথিত সমাজের চাপে ছেলে-মেয়ের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন নিজেদের সিদ্ধান্ত। তারা আমাদের ভালো চান এ নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই- but the road to hell is always paved with golden intentions.
অল্প কিছু তেজস্বী ছেলে-মেয়ে এ স্বপ্নহত্যার ষড়যন্ত্র থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারে। বেশিরভাগই পারে না, গুমরে গুমরে কাঁদে- মরার আগে প্রতিদিন একবার করে মরে। এদের দলে আমিও একজন- বিস্তারিত আর না-ই বা বলি।
আমাদের করণীয় কী তাহলে? জর্জ বার্ণার্ড শ এর একটা উক্তি উল্লেখ করি- The reasonable man adapts himself to the world: the unreasonable one persists in trying to adapt the world to himself. Therefore all progress depends on the unreasonable man
জ্বি, চতুর ব্যক্তিটি সমাজের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে চলে। আর বোকাসোকা, যুক্তিহীন ব্যক্তিটি গোঁ ধরে থাকে সমাজকে নিজের সঙ্গে মানিয়ে নেবার। সুতরাং, সমস্ত প্রগতি লুকিয়ে আছে ওই বোকাসোকা, গোঁ ধরা যুক্তিহীন ব্যক্তিটির হাতেই।
আমাদের বাবা-মায়েরাও মানুষ, তারা অনেকেই তাদের সময়ের সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। তাদের স্বপ্ন পূরণের নামে নিজের স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দেবেন না প্লিজ! প্রথম প্রথম হয়তো আপনার কারণে মনোক্ষুণ্ণ হবেন, কিন্তু তারা দিনশেষে আপনার সুখটাকেই প্রাধান্য দেবেন- যদি প্রকৃত বাবা-মা হয়ে থাকেন।
স্টিভ জবসের বিখ্যাত উক্তি দিয়ে শেষ করছি- STAY HUNGRY, STAY FOOLISH!
# একটি হেরে যাওয়ার গল্প
বিএ