রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি এবং স্বাস্থ্যঝুঁকির নানা দিক

ডা. পলাশ বসু
ডা. পলাশ বসু ডা. পলাশ বসু , চিকিৎসক ও শিক্ষক
প্রকাশিত: ০৪:২৭ এএম, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

১৯৭৭ সাল থেকে শুরু করে আজ অবধি যখনই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় দমন পীড়নের শিকার হয়েছে তখনই তারা দলে দলে চলে এসেছে বাংলাদেশে। মানবিক কারণে আমরাও তাদের আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়েছি।কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আটকে পড়া বিহারীদেরকে যেমন পাকিস্তান এখন আর তাদের দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না বা পাকিস্তানে ফিরিয়েও নেয় না তেমনিভাবে মিয়ানমারও বাংলাদেশ পালিয়ে আসা এ অসহায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিকে তাদের দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকারই করে না। ফলে বিপুল জনসংখ্যার চাপে আমরা যখন পিষ্ট হচ্ছি তখন রোহিঙ্গা স্রোত আমাদের জন্য স্থায়ী এক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ মিয়ানমারকে বাধ্য করতে না পারলে তারা কখনই তাদেরকে আর মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেবে না বলেই মনে হয়। অবস্থাদৃষ্টে তাই তো মনে হচ্ছে। ফলে বিহারীদের মতো এরাও স্থায়ীভাবে আমাদের দেশে থেকে যেতে বাধ্য হবে। আর উপায়হীন হয়ে আমরাও তাদেরকে রেখে দিতে বাধ্য হব।

আমাদের দেশটা যদি বড় হতো বা আমাদের জনসংখ্যা অনেক কম হতো, আমাদের অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, ব্যবসা এবং সামাজিক অবস্থা যদি উন্নত দেশের মতো হতো তাহলে লাখ ছয়েক এ আর্ত দুখী মানুষগুলোকে আশ্রয় দেয়া আমাদের জন্য তেমন কোনো সমস্যা হতো না। কিন্তু আমাদের বাস্তবতা তো আমরা সকলেই ভালো জানি। আমাদের অর্থনীতির সক্ষমতা কেমন সেটাও কারো অজানা নয়। তার উপরে রোহিঙ্গাদের সাথে আমাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়টাও কিন্তু গভীরভাবে জড়িত।

রোহিঙ্গাদের আমাদের এখানে আগমনের ফলে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং নিরাপত্তার মতো বিষয় নিয়ে আমরা যতটা উদ্বেগ প্রকাশ করছি ঠিক ততটা কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে সেভাবে উচ্চবাচ্য করছি না। বেঁচে থাকার জন্য যেভাবে খাবার এবং পানি লাগে সেভাবেই অসুস্থ মানুষের সুস্থ্যতার জন্যও লাগে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা—এটা এক চরম বাস্তবতা। এটাকে এড়ানোর কোনো সুযোগ আছে কি?

জীবন থেমে থাকে না এটা এক অমোঘ সত্য। রোহিঙ্গা পল্লীগুলোতে তেমনি জন্ম নেবে নতুন জীবন । আর অন্যদিকে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের মাধ্যমে জানা যায়, আমাদের দেশে এ অবধি যত রোহিঙ্গা এসেছে তার ৬০ ভাগই শিশু। যেহেতু এ জনগোষ্ঠি আগে থেকেই চরম রাষ্ট্রীয় নিগ্রহের শিকার ফলে এই যে শিশুরা আমাদের দেশে এলো মোটামুটিভাবে ধরে নেয়া যেতেই পারে যে এদের টিকাদান প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার সে অর্থে সুযোগ কখনই ছিলো না। কারণ মিয়ানমার তো তাদেরকে নিজের দেশের নাগরিক বলে স্বীকারই করতো না! ফলে এসব শিশুর মাধ্যমে সহজেই আমাদের দেশের ভেতরে টিকাদান কর্মসূচির আওতায় শিশুদেরকে যে সকল রোগ প্রতিরোধ কল্পে টিকা দেয়া হয়ে থাকে তা কিন্তু ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটা মাথায় রাখতে হবে।

আবার যে শিশুটা আশ্রয় শিবিরে জন্ম নিবে তাকেও টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে। তা না হলে পোলিওর মতো শিশুদের অন্যান্য সংক্রামক রোগ হয়তো আবার নতুন করে বিস্তার লাভ করতে পারে। এ ব্যাপারে তাই আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দ্রুত উদ্যোগী হতে হবে। মনে রাখতে হবে, সীতাকুন্ডের ত্রিপুরা পাড়ায় গত জুলাই মাসে শতাধিক শিশু হামে আক্রান্ত হলে তার মধ্যে ১০ জন শিশুর মৃত্যু হয়। পরে সেখানকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ৪৬ হাজার শিশুকে সরকার আবার নতুন করে হামের টিকা দিতে বাধ্য হয়। এই যখন একদম অতি নিকটের তিক্ত অভিজ্ঞতা তখন রোহিঙ্গাদের কারণে ভবিষ্যতে আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি যে তৈরি হতে পারে সেটা মনে রাখতে হবে। রোহিঙ্গারা নাকি এরই মধ্যে জীবন এবং জীবিকার তাগিদে কক্সবাজার এমনকি চট্রগ্রামেও নাকি ছড়িয়ে পড়েছে। কোনভাবেই তাই এদের মাধ্যমে সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ার যে আশঙ্কা রয়েছে সেটাকে ছোট করে দেখার একদমই সুযোগ নেই।

এছাড়া্ সুপেয় পানির অভাবে কলেরা, ডায়রিয়া, আমাশয়সহ নানা রকম পানিবাহিত রোগ সংশ্লিষ্ট এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। ইতোমধ্যেই জ্বর ও জায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্রে। এ ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মলমূত্রের মাধ্যমেও রোগজীবাণু পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ার পথকে সুগম করে দিতে পারে। খোসপঁচড়া সহ নানারকম চর্মরোগে আশ্রয় শিবিরে থাকা লোকগুলো আক্রান্ত হতে পারে। ঘিঞ্জি, স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে গাদাগাদি করে থাকার ফলে এ মানুষগুলো শ্বসনতন্ত্র ও ফুসফুসের রোগ, যক্ষাসহ অন্যান্য রোগের শিকার হতে পারে। এসব রোগবালাই সহজেই শরণার্থী শিবিরে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সহসা হবে— সে আশা সুদূর পরাহত। তাই যা করার তা আমাদেরকেই করতে হবে বাস্তবতা মেনে। তাদেরকে আশ্রয় দেয়ার মতো মানবিক দিককে যেমন উপেক্ষা করা যাবে না তেমনিভাবে আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং নিরাপত্তা ঝুঁকির মতো বিষয়গুলোর সাথে সাথে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি কিভাবে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে। রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিতে হবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা।মনে রাখা জরুরি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো এ ব্যাপারে যথাযথ ভূমিকা পালন করলেই কেবল ঝুঁকি মোকাবেলা করা সহজতর হবে।

লেখক : চিকিৎসক ও শিক্ষক, সহযোগী অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ।

এইচআর/এমএস

‘রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিতে হবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। মনে রাখা জরুরি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো এ ব্যাপারে যথাযথ ভূমিকা পালন করলেই কেবল ঝুঁকি মোকাবেলা করা সহজতর হবে।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।