রোহিঙ্গা সংকট ও আমাদের কূটনীতি

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ০৪:০৩ এএম, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

মায়ানমারের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার আন্দোলনের নেত্রী অং সান সুচি রোহিঙ্গা মুসলিমদের প্রতি সংঘটিত অন্যায় বৈষম্যের বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন না। রাখাই প্রদেশে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বৌদ্ধ সন্ত্রাসী ও নিরাপত্তাবাহিনীর গণহত্যার বিষয়ে বরাবরই সুচি মুখে কুলুপ এঁটে আছেন। এই সমস্যা সংক্রান্ত কোনও প্রশ্নের জবাবও দিতে চান না তিনি। যেন দেশে বসবাসকারী দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার মানুষের মতো বাঁচার অধিকারই নেই।

সুচি কিছু বলছেন না, করছেন না, করবেনও না। কিন্তু বিশ্ব বিবেক কি করছে? কিংবা আমরাই বা কতটা কি করতে পারছি বা করতে পারি? মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে দেশ থেকে বিতাড়নের লক্ষ্যে সেদেশের সরকার ও বৌদ্ধ সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠির পোড়ামাটি নীতি যে মানবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে তাতে বিশ্ব পরিসরে যতটা আলোচনা হওয়া দরকার, তা হচ্ছেনা। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সে দেশের সামরিক দমন নীতির প্রত্যক্ষ এবং তাৎক্ষণিক প্রভাবে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা এখন বড় মানবিক সংকটের মুখে। দুই লাখেরও বেশি ঢুকেছে গত কয়েকদিনে এবং আরো লাখো অসহায় আশ্রয়প্রার্থী সীমান্ত দিয়ে আসার অপেক্ষায়।

সামর্থ্য ও সক্ষমতা না থাকলেও বাংলাদেশকে তার সীমানা খুলে দিতে হয়েছে। এ দফায় যারা এলো তার আগে আরো পাঁচ লাখের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। প্রায় তিন দশক ধরে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে বাংলাদেশে। মিয়ানমারে যখনই জাতিগত দাঙ্গা হয়েছে তখনই রোহিঙ্গারা নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছে এদেশ। মিয়ানমারে সুপরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা গণহত্যা চলছে। এটি বৌদ্ধদের সঙ্গে মুসলমানদের বিরোধ শুধু নয়, রোহিঙ্গাদের মধ্যে হিন্দুও আছে, তারাও একইভাবে নির্যাতিত হচ্ছে।

এই মানবিক সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের যেখানে উচিত ছিল নিরাপত্তা পরিষদের সহায়তা কামনা, সেই কাজটি করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তিনি ৫ সেপ্টেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের কাছে চিঠি লিখে মানবিক দুর্যোগ এড়ানোর জন্য এখনই পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বলতেই হবে, রোহিঙ্গা সমস্যা ইস্যুতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা যথেষ্ট নয়।

বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরেছে এমন কোন ধারণা একন পর্যন্ত জনগণের সামনে নেই। বাংলাদেশে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে এক সপ্তাহের মধ্যে দু'বার ডেকে পাঠানো ছাড়া বড় কোন তৎপরতা বাংলাদশের গণমাধ্যম দেখেনি। আর এক ধরনের দ্বৈত অবস্থানও দেখছি বাংলাদেশের। একদিকে রোহিঙ্গাদের প্রবেশে বিজিবির বাধা দেখি, পুশব্যাক দেখি, আবার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের প্রতি মানবিক আচরণের নির্দেশনার কথাও শুনি।

বাংলাদেশ শুরু থেকেই দ্বিপাক্ষিকভাবে সমস্যাটি সমাধানের চেষ্টা করেছে৷ বিবেচনা করেছে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক, ব্যবসা-বাণিজ্য৷ বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চেয়ে আসছে। ফলে আর্ন্তজাতিকভাবে এর সমাধানের দিকে যায়নি বাংলাদেশ৷ কিন্তু মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের যে আচরণ, তাতে এটি আর দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধানের সুযোগ নেই। বাংলাদেশে পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আরো জোরালো প্রতিবাদ এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শক্ত অবস্থান নেয়া উচিত৷ আর সেই শক্ত অবস্থান নেয়ার সুযোগ এখন তৈরি হয়েছে। কারণ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়টি কিছুটা হলেও প্রতিবাদ ও নিন্দার মুখে পড়ছে৷

তবে বাংলাদেশের জন্য পরিস্থিতি এতোটা সহজও নয়। কোনো সন্ত্রাসী বা উগ্রপন্থিরা যেন বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে, তা-ও দেখা৷ কারণ আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির সাথে পাকিস্তানের আইএসআই এবং উগ্র জঙ্গি গোষ্ঠি আইএস’র সম্পর্কও নানা স্তরে উচ্চারিত। সাম্প্রতিক সমস্যার শুরু গত ২৪ আগস্ট। সেসময় রাখাইন রাজ্যের ‘বিদ্রোহী রোহিঙ্গারা' ২৪টি পুলিশ চেকপোস্টে সমন্বিত হামলা চালায় বলে দাবি করে মিয়ানমার সরকার৷ হামলার দায় স্বীকারও করে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)৷ পুলিশ পোস্টে হামলার পর রাখাইন রাজ্যে ব্যাপক অভিযান শুরু করে সরকারি বাহিনী যার পরিণতি সাম্প্রতিক পরিস্থিতি।

তবে একথাও ঠিক যে, ইসলামি জঙ্গিদের এমন দু’একটি বিচ্ছিন্ন আক্রমণের কথা বলে একটি দেশ আজকের এই সভ্য দুনিয়ায় এমন একটি মানবিক সংকট কি সৃষ্টি করতে পারে? আরসার সাম্প্রতিক দুই দফা হামলা হয়েছে একথা সত্য। কিন্তু মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নাগরিকত্বের ইস্যুটিই হচ্ছে আমল সমস্যা। কফি আনান কমিশনও বলেছিল, রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার স্বীকৃত হতে হবে। এবং কফি আনান কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতেই বাংলাদেশ এবং বিশ্ব সম্প্রদায়কে সমাধান খুঁজতে হবে।

বাংলাদেশরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে কোনভাবেই সক্রিয় দেখছিনা। হয়তো তিনি বলবেন, তিনি কাজ করছেন, সরকার কাজ করছেন। কিন্তু দৃশ্যমান কোন উদ্যোগ নেই। ঢাকায় আশিয়ানভুক্ত দেশগুলোর কূটনীতিকদের সাথে কোন আলোচনা নেই, ব্রিফিং নেই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমার সফরে যাচ্ছেন, এতো সবার জানা ছিল। কিন্তু আমরা কি তার আগে দিল্লীতে একজন বা দু’জন কূটনীতিক পাঠিয়েছি বাংলাদেশের সংকটটা তার কাছে তুলে ধরতে যাতে নিকট প্রতিবেশি হিসেবে তিনি সেকথা মিয়ানমারকে বলেন? সরকার কি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সাথে কোন যোগাযোগ করেছে? এমনকি যে মানবিকতা দেখিয়ে আমরা লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাকে গ্রহণ করেছি, তাও কি সঠিক ভাবে বিশ্ব দরবারের তুলে ধরতে পেরেছি? জানি এসব প্রশ্নের কোন উত্তর কখনো পাওয়া যাবে কিনা।

যারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তাদের ফেরত পাঠানো নিয়ে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন কূটনৈতিক আলোচনা চালিয়েও ২০০৫-এর পর থেকে নতুন কোনো প্রত্যাবাসন করতে পারেনি। বিষয়টি শুধু প্রত্যাবাসনের ব্যাপারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, রোহিঙ্গারা যে মিয়ানমারের নাগরিক তা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে সে দেশের সরকারের উপর চাপ দেওয়ার ব্যাপারটি কোন আমলেই করতে পারেনি বাংলাদেশ।

চীন, যুক্তরাষ্ট্র ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো নিজ নিজ স্বার্থে মিয়ানমারের প্রতি কোমল দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রেখেছে। চীন আনেকটা আগ্রাসিভাবে মিয়ানমারের পক্ষে জাতিসংঘে ভেটো পর্যন্ত দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তার সামরিক উপস্থিতি বাড়াতে চলেছে। উদীয়মান শক্তি চীনকে মোকাবিলা করতে যুক্তরাষ্ট্র চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক চাচ্ছে। এছাড়া মিয়ানমারের প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের আকর্ষণ তো আছেই।

এমন এক বাস্তবতায় বাংলাদেশের কাছে একমাত্র পথ চীনসহ মিয়ানমারের ওপর প্রভাববিস্তারকামী দেশগুলোকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আরও সক্রিয় নীতি গ্রহণ করার উদ্যোগ নিতেই হবে। কেননা এই সমস্যা শুধু জনসংখ্যার সমস্যা নয়। বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা উপস্থিতি বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামো ভেঙ্গে দিতে পরে, নতুন ধরনের জঙ্গি মনোভাবাপন্ন জনগোষ্ঠির উত্থান ঘটাতে পারে, সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে বড় সংকট সৃষ্টি করতে পারে।

লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।

এইচআর/এমএস

‘এমন এক বাস্তবতায় বাংলাদেশের কাছে একমাত্র পথ চীনসহ মিয়ানমারের ওপর প্রভাববিস্তারকামী দেশগুলোকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আরও সক্রিয় নীতি গ্রহণ করার উদ্যোগ নিতেই হবে।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।