‘সালোয়ারের ওপর গেঞ্জি’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলের একটি নোটিশকে কেন্দ্র দুদিন আগে তোলপাড় ছিল সামাজিক মাধ্যমে। সে ঢেউ লেগেছিল গণমাধ্যমেও। পরে হল কর্তৃপক্ষ, স্বাক্ষর ও সিল ছাড়া নোটিশটিকে ‘বিকৃত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ হিসেবে অভিহিত করে দাবি করেছে, এটি তাদের দেয়া নয়। ঘটনা তদন্তে হল কর্তৃপক্ষ তিন সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করেছে। তবে হলের ছাত্রীদের কেউ কেউ বলছেন, হলের সাধারণ নোটিশ বরাবরই এমন সিল-স্বাক্ষর ছাড়া নোটিশ বোর্ডে ঝুলানো হয়। এখন বিতর্কের কারণে তারা নোটিশটি অস্বীকার করছেন।
আবার কেউ কেউ বলছেন, হল কর্তৃপক্ষ সিল-স্বাক্ষর ছাড়া একটি নোটিশ দিয়েছিল বটে, যাতে যথাযথ পোশাক পরে হল অফিসে আসতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তাতে নির্দিষ্ট কোনো পোশাকের কথা বলা হয়নি। কিন্তু যে নোটিশ নিয়ে তোলপাড়, তাতে লেখা ছিল ‘হলের অভ্যন্তরে দিনের বেলা অথবা রাতের বেলা কখনোই অশালীন পোশাক (সালোয়ার এর ওপর গেঞ্জি) পরে ঘোরা ফেরা অথবা হল অফিসে কোন কাজের জন্য প্রবেশ করা যাবে না। অন্যথায় শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য হল কর্তৃপক্ষ বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
হলের ছাত্রীদের কেউ কেউ বলছেন, পোশাক সংক্রান্ত প্রথম নোটিশটি হল কর্তৃপক্ষ দিলেও ক্ষুব্ধ ছাত্রীরা তাকে ব্যঙ্গ করে পরে আলোচিত হওয়া নোটিশটি ছড়িয়েছে। আর ছাত্রীদের আরেকটি অংশ হল কর্তৃপক্ষের সাথে সুর মিলিয়ে বলছে, নোটিশের পুরো বিষয়টিই ভুয়া। হল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেজ নষ্ট করতে একটি মহল সুকৌশলে এই নোটিশটি অনলাইনে ছড়িয়েছে। ছোট্ট একটা নোটিশ নিয়ে কতটা বিভ্রান্তি ছড়ানো সম্ভব, তার একটি উদাহরণ এই ঘটনা। এমনকি সামাজিক মাধ্যমের বিতর্ক পৌঁছে গিয়েছিল গণমাধ্যমেও। তবে নোটিশটি সত্য না ভুয়া, তা নিয়ে এই লেখা নয়। আজকের লেখা মানুষের পোশাক নিয়ে।
সালোয়ারের ওপর গেঞ্জি পরলে কেমন দেখা যায় জানি না, আমি এই পোশাক পরা কাউকে দেখিনি। মেয়েরা যদি এই গরমে হলের ভেতরে সালোয়ারের ওপর গেঞ্জি পরে স্বাচ্ছন্দ্য পায়, আমার আপত্তি নেই। কেউ যদি বোরখা বা হিজাব পরে থাকে তাতেও আমার আপত্তি নেই। আমার আপত্তি খালি বাধা দেয়ায়, চাপিয়ে দেয়ায়।
সামাজিক মাধ্যমে বিতর্কের পয়েন্টও ছিল এটাই। পোশাক হলো একজন ব্যক্তির রুচি, স্বাচ্ছন্দ্য ও শালীনতার ব্যাপার। আমার পরিচিত নারীদের মধ্যে যারা বোরকা বা হিজাব পরেন, তাদেরকেও আমার ভালো লাগে, আবার যারা জিনস-টি শার্ট পরেন তাদের পছন্দকেও আমি সম্মান করি।
আমি জানি সব মানুষই সমাজ-পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনা করেই পোশাক নির্বাচন করে। ব্যতিক্রম ছাড়া শাড়ি পরে যেমন কেউ সাগরে নামে না, তেমনি থ্রি কোয়ার্টার পরে কেউ ঢাকার রাস্তায় ঘোরাঘুরি করে না। মর্নিং ওয়াক করতে সবাই ঢিলেঢালা ট্রাউজার পরেই বের হয়। আমি ঢাকায় থ্রি কোয়ার্টার পরে ঘর থেকে বের হই না। কিন্তু নয়াদিল্লী চষে বেরিয়েছি থ্রি কোয়ার্টার পরে। বাসায় আমি লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে থাকি। অফিসে যাই জিন্স-টি শার্ট পরে। আর কোনো অনুষ্ঠান বা টক শো হলে শার্ট এবং ফর্মাল প্যান্ট পরে যাই। এই নিয়ম কিন্তু আমাকে কেউ বলে দেয়নি।
আমি আমার রুচি আর স্বাচ্ছন্দ্য অনুযায়ী করে নিয়েছি। আমার সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য লুঙ্গিতে। কিন্তু সেটা পরে অফিস করা যাবে না। তাই জিন্স-টি শার্ট পরি। আর বেশিক্ষণ আমি ফর্মাল পোশাকে থাকতে পারি না। জীবনে আমি একদিন স্যুট পরেছি। টাই পরি কালেভদ্রে টক শো’তে।
ঢাকা ক্লাবসহ কয়েকটি ক্লাবে ড্রেস কোড আছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইউনিফর্ম আছে। বিভিন্ন বাহিনীর আলাদা ইউনিফর্ম আছে। কিন্তু সাধারণ ভাবে বাংলাদেশে কোনো ড্রেস কোড নেই। আপনি চাইলে যে কোনো অনুষ্ঠানে যে কোনো পোশাক পরে যেতে পারেন। আইনি কোনো বাধা নেই। কিন্তু তবুও সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ অনুষ্ঠানের মেজাজ বুঝেই পোশাক নির্বাচন করেন। এমনিতে খুব পছন্দ না হলেও ঈদ বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আমি পাঞ্জাবি পরি। আবার অনেককে দেখি বেশিরভাগ সময়েই পাঞ্জাবি পরেন। আবার শীত-গরম ১২ মাসই ব্যাংক কর্মকর্তাদের স্যুটেড-বুটেড হয়ে অফিসে যেতে হয়। তবে ছেলেদের পোশাক ততটা বিতর্ক নেই। বাংলাদেশে সব বিতর্ক নারীর পোশাক নিয়ে। একটা মহল ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীদের বোরকার অবগুণ্ঠনে রাখতে চান।
বাংলাদেশের অনেক নারীই বোরকা পরেন। ইদানিং নারীদের মধ্যে হিজাবের জনপ্রিয়তা বেড়েছে দারুণভাবে। দারুণ স্টাইলের অনেক হিজাব পাওয়া যায়। তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, চাইলেও কর্মজীবী নারীদের পক্ষে বোরকা পরা সম্ভব নয়। নারীদের পক্ষে বোরকা পরে ঢাকার পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ধাক্কাধাক্কি করে চড়া সম্ভব নয়। ঢাকায় ইদানিং স্কুটি চালানো নারীর সংখ্যা্ও বেড়েছে। এখন বোরকা বা শাড়ি পরে তো আর স্কুটি চালানো সম্ভব নয়। স্কুটি চালানোর সময় তাকে অবশ্যই নিরাপত্তার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। প্রতিদিন সকালে গামের্ন্টস এলাকায় কর্মজীবী নারীদের মিছিল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির চিত্র হয়ে আছে। তারাও কিন্তু স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবেই পোশাক নির্বাচন করেন।
শুধু গার্মেন্টস নয়, নারীরা এখন সব ক্ষেত্রেই পুরুষদের সাথে পাল্লা দিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। বোরকা বা শাড়ির দোহাই দিয়ে চাইলেও আপনি তাদের আটকে রাখতে পারবেন না। যত বিপ্লবীই হন, বাংলাদেশে কোনো নারী হাফপ্যান্ট পরে ঘরের বাইরে যান না। কক্সবাজার বিচেও বিকিনি পরা কোনো নারীর দেখা মিলবে না। কিন্তু নিউইয়র্ক শহরে অসংখ্য স্বল্পবসনা নারীর দেখা মিলবে, পাতায়া বিচে বিকিনির আধিক্য। সব সুস্থ স্বাভাবিক মানুষই তার সমাজটা চেনে, সীমাটা জানে। তাই কারো ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়া উচিত না। বা্ংলাদেশে কোনো নারী হাফ প্যান্ট বা বিকিনি পরে ঘরের বাইরে গেলে লোকে তাকে পাগল বলবে। ঢাকায় জিন্স-টি শার্ট পরে দাবড়ে বেড়ানো নারীটিও কিন্তু গ্রামে শ্বশুর বাড়িতে গেলে শাড়ি পরে চিরন্তন বাঙালির সাজ নিয়েই যায়।
বাংলাদেশে ধর্ষণের জন্য কেউ কেউ নারীদের পোশাককে দায়ী করেন। যারা এই দাবি করেন, তাদের কষে চড় মারা উচিত। ধর্ষণের জন্য যদি পোশাকই দায়ী হবে, তাহলে শিশুরা ধর্ষিতা হয় কেন? ধর্ষণ পুরুষদের একটি রোগ। পোশাকটা নিছক একটা অজুহাত। নারীদের পোশাক নিয়ে চিল্লাফাল্লা না করে পুরুষদের উচিত নিজেদের দৃষ্টি এবং রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করা। যাদের নজর খারাপ, তারা নারীদের শাড়ির ভাঁজেও অশ্লীলতা খোঁজেন।
নারী-পুরুষ যেই হন, মানুষ অবশ্যই পোশাক নির্বাচন করবে তার রুচি, স্বাচ্ছন্দ্য, ধর্মীয় বিবেচনা, সাসাজিকতা, শালীনতা বিবেচনা করেই। যে ‘সালোয়ারের ওপর গেঞ্জি’ নিয়ে তোলপাড়, সুফিয়া কামাল হল বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কোনো হলের মেয়েরা যদি এই গরমে সেই পোশাকে হলে ঘুরতে আরাম পায়, আমাদের বা হল কর্তৃপক্ষের তাতে আপত্তি থাকা উচিত নয়। আমরা তো আর হলে উঁকি দিতে যাচ্ছি না।
নিশ্চয়ই হলে সালোয়ারের ওপর গেঞ্জি পরে কোনো মেয়ে ইউনিভার্সিটির ক্লাশে আসেনি, আসবেও না। আসলে তাকে নিয়ে নিউজ হবে। যেমন লুঙ্গি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ করতে আসা এক ছাত্রকে নিয়ে নিউজ হয়েছে। তাই ব্যক্তির ওপরই তার পোশাক নির্বাচনের স্বাধীনতা ছেড়ে দেয়া উচিত। সেই ব্যক্তিই নির্ধারণ করবেন তার শালীনতার মানদণ্ড, স্বাচ্ছন্দ্যের ধরন।
এইচআর/জেআইএম