১৫ আগস্ট ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনীতি

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী
খালিদ মাহমুদ চৌধুরী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী , সংসদ সদস্য, রাজনীতিক
প্রকাশিত: ০৬:০১ পিএম, ১৪ আগস্ট ২০১৭

বিশ্ব মানবতার ইতিহাসে বেদনাবিধুর ও বিভীষিকাময় এক দিন আজ। সভ্যতার ঝলমলে বিবর্তনে পঁচাত্তর এক কালো অধ্যায়, যেদিন মানবতা ডুকরে কেঁদেছিল। শোকাবহ ১৫ আগস্ট- জাতীয় শোক দিবস আজ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী। ১৯৭৫ সালের এইদিন অতিপ্রত্যুষে ঘটেছিল ইতিহাসের সেই কালঙ্কজনক ঘটনা। মূলত এটা ছিল একাত্তরের পরাজিত শক্তির প্রতিশোধ, স্বাধীনতাবিরোধী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের একটি অংশ।

এই নৃশংস ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন: বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, পুত্র মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, ল্যাফটেনেন্ট শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, ভাই শেখ নাসের ও কর্নেল জামিল, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে মুক্তিযোদ্ধা শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, শহীদ সেরনিয়াবাত, বেবি সেরনিয়াবাত, শিশু সুকান্ত বাবু, আরিফ খান রিন্টুসহ অনেক। ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর বাসভবনে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হলেও সেদিন দেশে না থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা। সে সময় স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে জার্মানিতে সন্তানসহ অবস্থান করছিলেন শেখ হাসিনা। শেখ রেহানা ও ছিলেন বড় বোনের সঙ্গে।

স্বাধীন দেশে কোনো বাঙালি তার নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে না এমন দৃঢ়বিশ্বাস ছিল বঙ্গবন্ধুর। সেজন্যই সরকারি বাসভবনের পরিবর্তে তিনি থাকতেন তাঁর প্রিয় ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর ধানমন্ডির অপরিসর নিজ বাসভবনেই। বাঙালির স্বাধিকার-স্বাধীনতা আন্দোলন সূতিকাগার এ বাড়িটি অসম্ভব প্রিয় ছিল বঙ্গবন্ধুর। এখানে থেকেই বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। সেদিন ঘাতকদের মেশিনগানের মুখেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন অকুতোভয়। খুনিদের প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোরা কী চাস’?

একাত্তরের পরাজিত শক্তি, যুদ্ধাপরাধী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী শক্তি একত্র হয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে শুরু করেছিল ষড়যন্ত্র, অপপ্রচার ও অপতৎপরতা। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেনি। বিশ্বাসঘাতক খোন্দকার মোশতাক আহমদ আর জিয়া পঁচাত্তরে-পরবর্তী রাজনীতিকে স্বাধীনতার চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য উদ্দেশ্য আর বাহাত্তরের সংবিধানের বিপরীত ধারায় রাজনীতিকে অগ্রসর করে। খুনি ফারুক-রশীদ ঘাতকচক্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের কালো ভাবমূর্তি সৃষ্টি করেছে। খুনি ও বিপথগামীদের রাষ্ট্রদূত বানিয়ে, যুদ্ধাপরাধীদের জেল থেকে ছেড়ে দিয়ে এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে ধর্মান্ধতার শক্তিকে রাজনীতির সুযোগ করে দিয়েছিলেন জিয়া। তিনি রাষ্ট্রপতি হয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনের বিচার বন্ধের জন্য ইনডেমনিটি অ্যাক্ট করেন। পঁচাত্তরে-পরবর্তী হত্যা, ক্যু, ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িক হানাহানি জিয়ার নেতৃত্বে তুঙ্গে ওঠে। বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত ধারায় চালিত করার চেষ্টা চলে।

মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ প্রতীকগুলো ধ্বংসের চক্রান্ত চলে। ভোট ডাকাতি, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ক্যাডারভিত্তিক সন্ত্রাসের রাজনীতি এবং ভয়ানক সশস্ত্র রাজনীতি প্রতিষ্ঠা হয়। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনগুলো অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। প্রগতিশীল রাজনীতির দুরবস্থা সৃষ্টি করা হয়। গণতন্ত্রহীন এ দেশকে সবদিক থেকে পিছিয়ে দেয়। জিয়া অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী, অপশক্তিকে রাজনীতি করার সুযোগ দেন তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে। জামায়াত-শিবিরের প্রবল উত্থান ও বিকাশ ঘটে। শাসক ও ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতি প্রাধান্য পায়। মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত চেতনা ধ্বংস করা হয় পরিকল্পিতভাবে। ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাশাসনের অবসান ঘটে। আমাদের লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন, কিন্তু সেদিন খালেদা জিয়া ক্ষমতা নিয়েই গণতন্ত্রের লেবাসে আবার স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চালু করে।

তার স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজনীতিকে তিনি সঙ্কটগ্রস্ত করতে ছেয়েছেন রাজনীতিবিদদের জন্য। জিয়ার মৃত্যুর পর খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারপার্সন হন এবং কয়েকবার প্রধানমন্ত্রী হন। তবে তিনি বিএনপির ধারায় কোন পরিবর্তন আনেননি। ধর্মান্ধ অপরাধীকে এখনো আঁকড়ে আছেন, যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করছেন। একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের সহিংস রাজনীতির অংশীদার এবং রক্ষক এখন বিএনপি। ২০১১-২০১৬ সালে জামায়ত-শিবিরের সঙ্গে একাকার হয়ে নৃশংসতা চালিয়েছে বিএনপি। তাদের নারকীয় তাণ্ডব ও বর্বরতা থেকে রেহাই পায়নি ব্যাংক, বীমা, মসজিদ, কোরআন শরিফ ও মসজিদের জায়নামাজ।

ঈদের জামাত, মসজিদ, হিন্দু মন্দির, বৌদ্ধ বিহারে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও নৃশংস হত্যা হার মানিয়েছে যাবতীয় বর্বরতাকে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায়ের আগে ও পরে এবং বিএনপি-জামায়াতের হরতালের আগে-পরে বিএনপির যোগসাজশে ভয়াবহ নাশকতা সংঘটিত করেছে। তাছাড়াও ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধরূপে চিহ্নিত হয়েছে। সেসময় দুর্নীতি দুঃশাসন ও লুণ্ঠনের রাজত্ব কায়েম করেছিল বিএনপি-জামায়াতচক্র। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বেনিফিসিয়ারি বিএনপি সে ধারা অব্যাহত রেখেছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গুলিস্তানের আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে খালেদা জিয়ার কুপুত্র হাওয়া ভবনের নির্দেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে আইভী রহমানসহ ২৪ জনের হত্যা সংঘটিত হয়েছিল। যারা ১৫ আগস্টের সুযোগ প্রাপ্ত; যারা ২১ আগস্টের মত ঘটনা ঘটায় তাদের হাতে দেশ ও দেশের স্বাধীনতা নিরাপদ না। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে তারা আবারো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে চায়।

আশার কথা হচ্ছে, এ দুষ্টচক্রের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে জাতির পিতার খুনিদের বিচার কার্যকর হয়েছে। পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। মানবতার শত্রু একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয়েছে এবং রায় কার্যকর করা হয়েছে। দুর্নীতির দায়ে পাচারকৃত তারেক ও কোকোর অর্থ দেশে ফেরত আনা হয়েছে। দেশের ৬৪ জেলায় একযোগে বোমা হামলার ঘটনা, দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের আটক হওয়ার ঘটনার বিচারিক কার্যক্রম চলছে। জঙ্গি ও সন্ত্রাসী তৎপরতা সাহসিকতার সঙ্গে তিনি দমন করেছেন। সব ক্ষেত্রে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি এখন অব্যাহত। দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্ব আজ দেশে ও বিদেশে প্রশংসিত এবং পুরস্কৃত হয়েছে।

অন্যদিকে খালেদা জিয়া স্বাধীনতাবিরোধীচক্রের প্রতিভূ এবং জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসবাদী নেতৃত্বের প্রতীক হয়ে আছেন। জামায়াত-শিবির ত্যাগ করেননি তিনি, বারবার তাকে আহ্বান জানানোর পরও। যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে ঘৃণা পোষণ করেন না, তাদের বিচারে তৎপর হননি খালেদা জিয়া। স্বাধীন দেশে তিনি কয়েকবার ক্ষমতাসীন হয়েও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তার অবস্থান। দেশের সেনাবাহিনীকে তিনি বারবার উস্কানি দিয়েছেন। ক্ষমতার মোহে ১৫০ জন মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছেন। নির্বাচিত সরকারকে টেনে হিঁচড়ে নামানোর হুমকি দিয়েছেন ধারাবাহিকভাবে।

নির্বাচন বিমুখ, গণতন্ত্রবিমুখ হয়ে মৌলবাদী, জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে তিনি রাজনীতি করতে চাচ্ছেন যা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে প্রযোজ্য হতে পারে না। আকারে ইঙ্গিতে তিনি এবং তার দলের নেতারা দেশে আরেকটি ১৫ আগস্ট ও ২১ আগস্ট ঘটানোর হুমকিও দিচ্ছেন। ১৫ আগস্টের জাতীয় শোকের দিনে খালেদা জিয়া ভুয়া জন্মদিন পালন করেন জনমতের বিপরীত ধারায়। সংসদ, নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগ নিয়ে নোংরা রাজনীতি করছেন। মূলত তার প্রতিটি পদক্ষেপ দেশবিরোধী। সকল ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে এখন দেশের বাইরে গিয়েও দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র করছেন। এই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে।

বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে নাই, কিন্তু তাঁর আদর্শ আমাদের অনুপ্রেরণা। ঘরে ঘরে জন্মেছে হাজারো মুজিব। স্বাধীনতার স্বপ্ন আজ বাস্তবায়নের পথে, এর সুফল যাচ্ছে কোটি বাঙালির ঘরে ঘরে। জাতির পিতার আরাধ্য স্বপ্নই আজ পূরণের পথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার হাত ধরে। দেশরত্ন শেখ হাসিনা মানেই বঙ্গবন্ধুর আকাঙ্খিত স্বপ্ন পূরনের ছোঁয়া। বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ। মুজিব আদর্শ আজ বিশ্বময়।

লেখক: জাতীয় সংসদ সদস্য, সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

এইচআর/বিএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।