ভুগছে হজযাত্রীরা, ভোগ করছে অন্যরা!
রাহেলা বানু টাকা জমাত, কখনও বাঁশের খুঁটিতে, মাটির হাঁড়িতে, কখনও মাটির ব্যাংকে। এক টাকা, দু’টাকা, পাঁচ টাকা, দশ-বিশ টাকা, কখনও বড়জোর পঞ্চাশ-একশো। যখন যা পারতো, পেত তাই জমাতো সে। বয়স যখন নিতান্ত কম, কুড়ি পঁচিশ, তখন থেকেই টাকা জমাত রাহেলা বানু। এখন তার বয়স প্রায় পয়ষট্টি। ছ’সন্তানের জননী। রাহেলা যে জমিজমা কিনবার জন্য, সন্তানের বিয়ের জন্য, ঘরদোর ঠিক করবার জন্য, ন্যূনতম কোন বিলাসিতার জন্য টাকা জমাতো তা নয়। রাহেলা বানু তিলতিল করে, কাজ করে, কষ্ট করে, জীবনের দীর্ঘসময় টাকা জমিয়েছিলেন শুধুমাত্র হজে যাবার জন্য।
ছোট বেলা থেকেই রাহেলা বানু খুব ধার্মিক ছিলেন। অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। তাহাজ্জতের পড়তেন। হজ তার সারাজীবনের স্বপ্ন ছিল। আল্লাহর ঘর দেখবেন। প্রিয় নবীর (স.) যেখানে জন্ম, সেখানে যাবেন। দুরূদ পড়বেন। ডাকবেন আল্লাহকে হজে গিয়ে, বলবেন, লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। মনে মনে বলবেন, হাজির, হাজির, হে মহান আল্লাহ, আমি হাজির হয়েছি আপনার দরবারে। আমাকে কবুল করে নিন, আমাকে ক্ষমা করুন, করুণা করুন, দয়া করুন।
রাহেলা বানু আমার খালা, মায়ের বোন হয় সম্পর্কে। মায়ের কাছেই তার গল্প শুনেছি। ভীষণ পরহেজগার মানুষ। যে বছর আমি বিদেশে আবারও মাস্টার্স করতে গিয়েছি সে বছর এসেছিলেন ঢাকায়। সেটাই তার প্রথম শহরে আসা। আশা মিটেছিল তার। গিয়েছিলেন হজে। আমি কখনও দেখিনি রাহেলা খালাকে। কেবল গল্প শুনেছি তার। শুনেছি হজে যাবার আগে, প্রতিটি দিন তার উৎকণ্ঠায় কাটতো ঢাকায় এসে। যেতে পারবো তো? এতো দিনের স্বপ্ন! খোদার কাছে নিয়ত। নিশ্চয়ই, খোদা কবুল করবেন।
অদেখা রাহেলা খালার উৎকণ্ঠিত, অনুমিত মুখটি কদিন ধরে খুব মনে পড়ছে। আত্মীয়, অনাত্মীয় নানাজনের হজ ফ্লাইট মিসের খবর শুনছি। মনে হচ্ছে তারা প্রত্যেকই একেকজন রাহেলা বানুর ‘সেই উৎকণ্ঠিত মুখ’। হয়তো দেখিনি তাকে, কিন্তু মায়ের কাছে তার আবেগ, হজের জন্য, খোদার জন্য আকুতির যে বর্ণনা শুনেছি তাতে মন খারাপ করে দেয়া মুখাবয়ই ভেসে ওঠে।
কী দোষ ধর্মপ্রাণ এই মানুষগুলোর। অদ্ভুত অনিশ্চয়তার মধ্যে যারা দাঁড়িয়ে আছে। জানে না এখনও, তারা হজে যেতে পারবে কি না। এ উৎকণ্ঠা কেবল যে এ বছরের তা নয়, প্রায় প্রতি বছরের। ই-ভিসা জটিলতা, ফ্লাইট বিপর্যয়, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের খামখেয়ালিপনা, মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রতারণা আর এক শ্রেণির অতি মুনাফালোভী ‘অমানুষ হজ এজেন্ট’দের পাকচক্রে পড়ে, দুঃসহকাল যাপন করছেন হজ যাত্রীরা। হজ এজেন্ট আর ধর্ম মন্ত্রণালয় দোষ দিচ্ছে একে অপরকে। অনেক এজেন্টদের বৈধ লাইসেন্সই নেই। অথচ ‘চটকদার অফার’ এ বিভ্রান্ত করে আসছে তারা ধর্মপ্রাণ মানুষদের।
আর কিছুদিন পর সৌদি সরকার ভিসা দেবে না। হজের শেষ ফ্লাইট ২৬ আগস্ট। অনেক এজেন্ট যাত্রীদের ভিসার আবেদন জমাই দেয়নি মন্ত্রণালয়ে। প্রায় প্রতিদিনই বাতিল হচ্ছে ফ্লাইট। অনেকে ই-ভিসার প্রিন্ট নিয়ে গিয়ে যান্ত্রিক ত্রুটিতে আটকা পড়ছেন। টিকিট কনফার্ম থাকার পরও পারছেন না, বিমানে উঠতে। এই সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে।
সৌদি সরকার নতুন ভিসা কার্যকর করে ১ মহররম। ২ অক্টোবর। নতুন নিয়মে উল্লেখ রয়েছে, পুনরায় হজে গেলে ২ হাজার রিয়াল ফি দিতে হবে। অথচ ধর্ম মন্ত্রণালয় জানতোই না নিয়ম ও শর্তটি। তা নইলে গত ফেরুয়ারিতে যখন সরকার বিশাল হজ প্যাকেজ প্রচার করে তার কোথাও শর্তটি উল্লেখ ছিল না কেন? ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অমন উদাসীনতায় ২৫ কোটি টাকা দণ্ড দিতে হচ্ছে ৫ হাজারের বেশি হজ যাত্রীদের, অমনটাই শোনা যাচ্ছে। অতিরিক্ত ফি’র কথা হজ প্যাকেজে থাকলে এমন ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতো এ ধর্মপ্রাণ মানুষেরা। এখন যে পরিস্থিতি অনেকে বলছেন, প্রায় ৪০ হাজার যাত্রীর হজ অনিশ্চয়তা দেখা দেবে। যদিও এজেন্ট নেতারা বলছেন, এ সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি নয়।
কি করবে এই ধর্মপ্রাণ মানুষেরা, তাদের তো কোন অন্যায় নেই, অপরাধ নেই। অন্যের দোষে তারা আজ ভোগান্তির শিকার, ভুক্তভোগী। এটাই কি নিয়ম জগতের, ভোগে একজন, ভোগ করে অন্যে। অনেকেই হয়তো বাড়ি ফিরে যাবে, যেতে বাধ্য হবে। যারা ফিরে যাবে তাদের বেদনা, হাহাকার, কাতরতা, অন্তক্রন্দন কেবল জানে তারাই, যারা বেড়িয়েছিল বাড়ি থেকে নিয়ত করে। তারা আল্লাহর ঘর দেখবে, তাওয়াফ করবে, আরাফাতের ময়দানে খোদাকে ডাকবে, নিজেকে হাজির-নাজির করবে। ক্ষমা চাইবে প্রতিপালকের কাছে, রবের কাছে, যিনি স্রষ্টা মহান আল্লাহতায়ালা তার কাছে। খোদার প্রেমের সে কী এক ঘোর, লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়াননি’ মাতা লাকা ওয়ালমুলক... লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক...।
পুঁজির বিশাল হাত গ্রাস করতে চলেছে সবস্ব, সর্বত্র। অর্থের জন্য আজ মানুষ অন্ধ। মানুষের আবেগ, বিশ্বাস, ধর্ম সবকিছুকে বিকোতে, বাণিজ্য করতে, পুঁজি করতে, পুঁজি তৎপর। এই দুর্ভোগের পেছনে রয়েছে মানুষেরই কালো হাত, লুটেরা সিন্ডিকেট। যারা কেবল যে কোন মূল্যে উর্পাজন করতে চায়। এই হাতের সঙ্গে যোগ হয়েছে বেসরকারি-সরকারের নামধারী কিছু হাত। এই হাতগুলো যতদিন না ভাঙবে, দুর্ভোগ পোহাবে ততদিন ধর্মপ্রাণ এ মানুষেরা।
আমি মানবতাবাদী, প্রতিটি মানুষের ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রতিটি মানুষের ধর্ম পালনের অধিকারের প্রতি সোচ্চার। ধর্ম পালনে মানবসৃষ্ট সকল দুর্ভোগ বন্ধ হোক। জয় হোক মানুষের, মানবতাবাদের।
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
[email protected]
এইচআর/এমএস