নতুন আইনে জ্বললো আশার আলো

ডা. পলাশ বসু
ডা. পলাশ বসু ডা. পলাশ বসু , চিকিৎসক ও শিক্ষক
প্রকাশিত: ০৪:১০ এএম, ১১ আগস্ট ২০১৭

একজন ব্যক্তি শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ আছেন- এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি মনে হয় জীবনে আর খুব বেশি কিছু নেই। কিন্তু এটাও তো ঠিক, শরীর থাকলে শারীরিক অসুস্থতাও তো থাকবে। আর সেক্ষেত্রে সুস্থ হতে চিকিৎসারও প্রয়োজন হবে। বেশিরভাগ সময় রোগীর সে চিকিৎসা শুধু ওষুধ বা অপারেশনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু কখনও কখনও জীবনে বেঁচে থাকার জন্য শরীরে বিদ্যমান অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে বাদ দিয়ে নতুন করে সংযোজনেরও প্রয়োজন হতে পারে। সেটা না করলে ধীরে ধীরে যন্ত্রদায়ক এক মৃত্যুকেই তখন মেনে নেয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না। তবে বেঁচে থাকার সুযোগ থাকলে মৃত্যুকে সহজে কে মেনে নিতে চায় বলুন?

বস্তুতঃ শরীর হচ্ছে নানা ধরনের জৈবিক মেশিনের ( যাকে আমরা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বলছি) ক্রিয়াকলাপের সমন্বিত রূপ। কৃত্রিমভাবে তৈরি যন্ত্রপাতির (টিভি, ফ্রিজ, গাড়ি, এসি, ফোন ইত্যাদি) কলকব্জা যেমন অনেক সময় প্রতিস্থাপন বা সংযোজন প্রয়োজন হয় তেমনিভাবে আমাদের গোটা শরীরকেও যদি এমন মেশিন বা যন্ত্র এবং সেখানে অবস্থিত অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে ( হার্ট, কিডনি, লিভার, ফুসফুস ,চোখ ইত্যাদি) কলকব্জার সাথে তুলনা করেন তাহলে তারও যে প্রতিস্থাপন বা সংযোজনের প্রয়োজন হতে পারে সে ব্যাপারে মনে হয় আর সন্দেহের অবকাশ থাকে না। বরং মনে হবে এটাই বাস্তব।

এই বাস্তবতার নিরিখেই বর্তমানে ১৯৯৯ সালে প্রণীত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনীর উদ্যোগ নিলো সরকার; যা খুবই সময়োপযোগী এবং বাস্তবসম্ম্ত সিদ্ধান্ত বলেই আমার মনে হয়। এটা আরো আগেই হওয়া উচিত ছিলো। তবুও না হওয়ার চেয়ে দেরীতে হলেও তা ভালো। এ কারণে তাই সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।

কারণ এ আইন প্রথম ১৯৯৯ সারে প্রণয়নের প্রায় ১০ বছরের মাথায় ( ২০০৯ সালে) অঙ্গপ্রতঙ্গ সংযোজন নিয়ে গণমাধ্যমে নানা ধরনের নেতিবাচক খবর প্রকাশিত হতে থাকে। আর সেটা মূলত কিডনি প্রতিস্থাপনকেই ঘিরে। এর ফলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকবৃন্দ ব্যাপক সমালোচিত হন। আর এ ধরনের সমালোচনার ফলে একাজে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা পারিবারিক, সামাজিক এবং আইনগতভাবে নানা ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে থাকেন। ফলে এক সময় দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন প্রায় বন্ধই হয়ে যায় । বা হলেও এ যাবৎকাল খুবই সীমিত পরিসরেই তা চলছিলো। এর কারণ নিকটাত্মীয় নির্ধারণ বিষয়ক বিদ্যমান আইনের জটিলতা যা চিকিৎসকদেরকে বিব্রত করে তুলছিলো। কিন্তু তাই বলে কি বিদেশে গিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন বন্ধ ছিলো? উত্তর হচ্ছে , না ছিলো না। এখন ভাবুন তাহলে কি পরিমাণে টাকা এ বাবদ বিদেশে চলে গেছে! অথচ এ টাকাগুলো দেশে রাখার সুযোগ তো ছিলোই। কিন্তু তা হলো না মূলত আইনের সীমাবদ্ধতার কারণেই।

দেখা গেছে, বিদ্যমান আইনের কারণে কিডনি দাতার সংখ্যা প্রায় সীমাবদ্ধ থাকার ফলে এক শ্রেণির দালালের আবির্ভাব ঘটলো। এরা টাকার বিনিময়ে গরীব লোকজনকে কিডনি দানে উৎসাহিত করতে লাগলো। আর গরীব মানুষগুলো সামান্য কিছু টাকার আশায় সে প্রস্তাবে রাজিও হতে থাকলো। কারণ সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, একটা সুস্থ কিডনি নিয়েই তো ভালোভাবেই বেঁচে থাকা যায়। ফলে একটা কিডনি বেঁচে দিলে যেহেতেু মৃত্যু ঝুঁকি নেই এবং উপরন্তু কিছু টাকা আয়ের সুযোগ আছে এ কারণে গরীব মানুষগুলো ( বিশেষ করে আমাদের দেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষ) এ কাজে উৎসাহিত হতে থাকলো। বিভিন্ন সময় পত্রিকায় “কিডনি চাই” শিরোনামে বিজ্ঞাপনও হয়ত দেখে থাকবেন। সেখানে লোভনীয় নানা উপঢৌকনের কথাও নিশ্চয় আমাদের ভুলে যাবার কথা নয়।

১৯৯৯ সালের আইনে অঙ্গ দাতা হিসেবে বিবেচিত হতেন পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, ভাই, বোন ও রক্তসম্পর্কিত আপন চাচা, ফুফু, মামা, খালা ও স্বামী-স্ত্রী। প্রস্তাবিত খসড়া আইন, ২০১৭তে নিকটাত্মীয়ের এ সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে যাতে কিডনি বেচাকেনার মতো ঘটনা আর না ঘটে। খসড়া এ আইনে পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী ও রক্তের সম্পর্কের আপন চাচা, ফুফু, মামা, খালার সাথে সাথে নানা-নানি, দাদা-দাদি, নাতি-নাতনি এবং আপন চাচাতো, মামাতো, ফুফাতো, খালাতো ভাই-বোনদেরকেও নিকটাত্মীয়ের সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ( সূত্র : সম্পাদকীয়, Jagonews24.com, ২০ জুলাই, ২০১৭) ।
এদের মধ্য থেকে যে কেউ কিডনি, লিভার, হার্ট বা অন্যান্য টিস্যু প্রযোজ্য ক্ষেত্রে দান করতে পারবেন। তবে চোখ ও বোনম্যারো ( ব্লাড ক্যান্সারসহ কিছু রক্ত রোগে প্রযোজন হয়) সংযোজনের ক্ষেত্রে নিকটাত্মীয় হওয়ার আবশ্যকতা নেই। অর্থাৎ যে কেউ তা দান করতে পারবেন। তবে, মিথ্যা তথ্য দিয়ে কেউ আইনের বরখেলাফ করলে দাতা, চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান, গ্রহীতা এবং সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের জন্য দণ্ডও সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে; যা ১৯৯৯ সালের আইনে ঢালাওভাবে বিদ্যমান ছিলো।

পরিসংখ্যান বলছে, আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রায় ৯ হাজার বিকল কিডনিরোগীর দেহে কিডনি সংযোজনের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ১০টি সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে নাকি প্রতি বছর মাত্র ২০০ কিডনি সংযোজন করা সম্ভব হতো। বাদ বাকি কিডনি রোগীরা তাহলে কি করে? উত্তর হচ্ছে অবস্থাপন্ন মানুষেরা বিদেশে গিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন করতে অনেক টাকা খরচ করে। আর গরীবেরা ধীরে ধীরে হয়ত মৃত্যুকেই বরণ করে নেয়!

পরিশেষে অন্য একটা পরিসংখ্যানের দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমার এ লেখা শেষ করতে চাই। পরিসংখ্যানটা হচ্ছে, আমাদের দেশে কিডনি প্রতিস্থাপনে খরচ হয় যেখানে মাত্র ২ থেকে ৭ লাখ টাকা সেখানে এ কাজে সিঙ্গাপুর এবং আমেরিকায় লাগে প্রায় ২ কোটি টাকা এবং পাশের দেশ ভারত এবং শ্রীলংকায় খরচ পড়ে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা ( সূত্র : জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও মহিব উল্লাহ খোন্দকার এর নিবন্ধ; ৯ এপ্রিল, ২০১৭, দৈনিক সমকাল)। উপরের তথ্য একদমই বাড়িয়ে বলা নয়। এটা ঠিক, কিডনি ছাড়াও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজনেও আমাদের দেশে খরচ অনেক কম পড়ে। তাহলে বিদেশমুখিতার কারণ কি?

সুতরাং দেশেই কিডনি প্রতিস্থাপনসহ অন্যান্য অঙ্গ সংযোজনের জন্য আইনের পাশাপাশি যোগ্য, দক্ষ চিকিৎসক এবং সুযোগ সুবিধা সংবলিত ইন্সটিটিউট আরো বেশি করে তৈরি করা খুবই জরুরি যেন রোগীরা স্বল্প টাকায় দেশেই কিডনি প্রতিস্থাপনসহ অন্যান্য উন্নতমানের চিকিৎসা সেবা পেতে পারে। কারণ, নিজেদেরকে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত করতে হলে দেশকে শুধু আর্থিকভাবে নয় ; বরং সবদিক দিয়েই শক্তিশালী হয়ে উঠতে হবে। সেক্ষেত্রে সবধরনের চিকিৎসা সেবা পাওয়ার সুযোগ যেন দেশেই সৃষ্টি করা যায় সে ব্যাপারে রাষ্ট্রকেই সবার আগে উদ্যোগী হতে হবে। চিকিৎসা সেবা পাওয়া যেহেতু মানুষের সাংবিধানিক অধিকার সেহেতু রাষ্ট্রের সে দায়ভার এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ খুব একটা আছে কি?

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ।

এইচআর/এমএস

‘দেশে কিডনি প্রতিস্থাপনে খরচ হয় যেখানে মাত্র ২ থেকে ৭ লাখ টাকা সেখানে এ কাজে সিঙ্গাপুর এবং আমেরিকায় লাগে প্রায় ২ কোটি টাকা এবং পাশের দেশ ভারত এবং শ্রীলংকায় খরচ পড়ে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।