বন্ধ হোক ধর্ষণ
তখন আমি থার্ড ইয়ারে। সামার স্কুল ধারণার সঙ্গে খুব একটা পরিচয় নেই। তবে তাতে অংশগ্রহণের সুযোগ সামনে এলো। যেহেতু ক্লাসের সবাই পনের দিনের এই আবাসিক কর্মশালার ছাত্র হতে চায়, তাই সুযোগ সীমিত, তা বলাই বাহুল্য। সিদ্ধান্ত হলো মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে কয়েকজনকে বাছাই করা হবে। এখনকার আইন কমিশনের সদস্য ড. শাহ আলম স্যার তখন আমাদের, মানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন। সাক্ষাৎকার তার কক্ষে। আরো স্যার আছেন। শুরুতেই আমাকে প্রশ্ন করা হলো এমন একটা আইনের নাম বলতে যেখানে নারী তুলনামূলক কম প্রতিকার পায় বা বঞ্চিত হয়। আমার সামনে ভাবার সুযোগ কমই ছিলো। জানার পরিধি নিয়ে নাই-ই বা বললাম। প্রতিযোগিতা অবশ্য তীব্র। আমি বললাম, ধর্ষণ সম্পর্কিত আইন।
স্যাররা একে অন্যের চোখে তাকালেন। তারপর তারা জানতে চাইলেন কীভাবে?
আমি বললাম, ধর্ষণ প্রমাণ করার জন্য সাক্ষী দরকার। কোনো ধর্ষক কি সাক্ষী রেখে ধর্ষণ করে? কাজেই এ আইন নারীকে প্রতিকার পেতে বঞ্চিত করে।
এখন যদি কেউ আমার কাছে জানতে চায়, ধর্ষক সাক্ষী রেখে ধর্ষণ করে না, এ কথা আমি এখনো বিশ্বাস করি কি-না, তবে মনে দ্বিধা না রেখেই বলবো, বিশ্বাস করি না। এখন যোগসাজশে ধর্ষণ হয়। যার নাম গণধর্ষণ। যেখানে একজন ধর্ষক, বাকীরা সাক্ষী। যেখানে অংশগ্রহণকারী, পরিকল্পনাকারী, সাক্ষী সবাই অপরাধী। বেশ কিছুদিন আগে প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলন্ত বাসে ধর্ষণের একটি ঘটনা আলোড়ন তুলেছিল বেশ। এরপর আমাদের দেশেও এ ধরনের ঘটনার খবর মেলে। অতি সম্প্রতি অভিজাত শপিংমলে কর্মরত এক নারী গণধর্ষণের শিকার হন। আশার কথা ধর্ষক ধরা পড়েছে। এলিট ফোর্স র্যাবের এ কর্মতৎপরতা প্রশংসা কুড়িয়েছে অনেক। তবে মামলা নিতে দেরি করায় সমালোচিত হয়েছে পুলিশ। এমনকী উচ্চ আদালতের একটি রুলেরও মুখোমুখি হয়েছে তারা।
এরপর অল্প সময়ে বেশ কিছু ধর্ষণের ঘটনার খবর গণমাধ্যমে আসে। কিশোরগঞ্জের পর স্কুলছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগ আসে ঝালকাঠি ও নাটোর থেকে। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় পার পেতে পেতে পরে আটক হন অভিযুক্ত। নারায়ণগঞ্জে আরেকটি গণধর্ষণের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় বাসচালক চান্দু মিয়া। এরমধ্যে নাটোরের ঘটনা একটু বেশিই অমানবিক। সেখানে ভিকটিম প্রথম শ্রেণির ছাত্রী। তাকে দেখানো হয়েছে লিচু খাওয়ার প্রলোভন। হাসপাতালের বিছানায় কাতরানো মেয়েটি বড় হয়ে স্বাভাবিক জীবনে আর কখনো ফিরতে পারবে কি-না ভেবে আমার খুব বিষণ্ণ লেগেছে।
পত্রিকার পাতা থেকে হয়তো আরো কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতো। তা আর করছি না। তবে চারদিকে অনেকের একটি সাধারণ মন্তব্য উল্লেখ না করে পারছি না। অনেকেই বলছেন, একটি ঘটনা হলে এরকম আরো ঘটনা হতে থাকে। আমি অবশ্য এ বক্তব্য মানতে নারাজ। আসলে ঘটনা হয়। হয়তো আড়ালে থাকে। বড় একটি ঘটনা হলে, ছোট ঘটনাগুলো গুরুত্ব দেয় গণমাধ্যম। অতি ব্যক্তিগত আবেগ এবং এ বিষয়ে অপরাধ আমাদের সমাজে গোপনই থাকে। এই সমাজ চাদরে ঢাকা। সে চাদর অবশ্যই স্বচ্ছ নয়। তাই আমরা জানতে পারি না অনেক কিছুই। আবার গণমাধ্যম সরব হলে জানা যায় অনেক কিছু। যতো জানা, ততোটাই প্রতিকার পাওয়ার আশা থাকে। এ বিষয়ে সবাই আশা করি একমত হবে।
রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোডে গণধর্ষণের সংবাদ পরিবেশন করে এবার বেশ সমালোচনায় এসেছে গণমাধ্যমও। উদাহরণ টেনে বলা যায় পশ্চিমের কোনো মেয়ে নির্যাতনের শিকার হলে লেখা হয় না- কালো মেয়ে বা সাদা মেয়ে ধর্ষণের শিকার। অথচ, কুড়িলে ধর্ষিতার সম্প্রদায়ের পরিচয় গুরুত্ব দিয়ে প্রতিবেদন লেখা হয়েছে প্রধান প্রধান পত্রিকায়, টিভিতে। এমনকী তার সম্প্রদায়ের পক্ষের সংগঠন মাঠে নেমেছে প্রতিবাদ করতে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই সম্প্রদায়ের একটি ঘোষণা বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। সেই সম্প্রদায়ের স্বেচ্ছাসেবকরা নিজেদের বোনদের কর্মক্ষেত্র থেকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ধর্ষকদের র্যাব গ্রেফতার করতে না পারলে এ ঘোষণা প্রচলিত আইনের প্রতি এক কঠিন উপহাস হয়ে থাকতো। আইন নিজস্ব গতিতে চললে তা কষ্ট জর্জরিত মানুষের পদক্ষেপ হিসেবেই দেখবে জনতা।
টার্গেটেড ক্রাইম ঠেকানো কঠিন। বলা যায় প্রায় অসম্ভব। চুপচাপ কে কোথায়, কখন কী অপরাধের ফন্দি করে তা আগেভাগে টের পাওয়া মুশকিল। কিন্তু ঘটনা বড় হলে, এর পরিকল্পনা অনেক বড় হলে গোয়েন্দারা জেনে যায়। অপরাধ ঠেকাতে পারে। কিন্তু কম মানুষের অংশগ্রহণে কোনো পরিকল্পিত অপরাধ ঠেকানো কঠিন। সে হিসাব বিবেচনা করলে ধর্ষণ ঠেকানো হয়তো কঠিন। কিন্তু অপরাধী যদি যথাযথ সাজা পায় কিংবা সমাজে যদি এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা যায় যে, ধরা পড়লে পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই, তবে টার্গেটেড অপরাধ করতে ভয় পাবে দুর্বৃত্তরা। পশ্চিমের উন্নত দেশেও অপরাধ হয়। তবে সেখানে ধরা পড়লে পার পাওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না।
‘সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী, একজন নারী ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর আদালতে জেরার মাধ্যমে আবারো তার সম্ভ্রম নষ্ট করা হয়। এ আইনের ১৫৫ ধারায় জেরা করার সময় নির্যাতিত নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। তাই ব্রিটিশ আমলে করা ওই আইন সংশোধন করতে হবে।’ এটি আমার কথা নয়। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে ‘নারীর প্রতি সহিংসতাবিষয়ক যুগান্তকারী রায় : বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান’ শীর্ষক বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। সে অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এসব কথা বলেন।
যাহোক, কুড়িল গণধর্ষণের খলনায়কদের গ্রেফতারের পর র্যাব জানিয়েছে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে কর্মজীবী নারীকে ধর্ষণ করে বায়িং হাউজের গাড়ির দুই ড্রাইভার। আমরা বলতে চাই, নারীকে কাজ করার সুযোগ অবশ্যই দিতে হবে। কেননা, আমাদের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। তারা ঘরে বসে থাকলে জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতি হবে না। ধরুণ, আপনার পরিবার দুই সদস্যের। আপনারা দুজনই আয় করেন। আবার আপনার পাশের বাসার দুই সদস্যের পরিবারের একজন আয় করে অন্যজন করেন না। তাহলে অগ্রগতি কাদের হবে। হিসাব সহজ। যারা নারীর কাজের পরিবেশ বিষিয়ে দেয় তারা উন্নয়নের শত্রু। মোটা দাগে জাতির অগ্রগতির শত্রু, এ কথা বলাই যায়।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, নারী পুরুষের খুব দূরের কেউ নয়। পুরুষের জন্ম হয় নারীর পেটে। একজন নারী কোনো এক পুরুষের মা। কোনো এক পুরুষের বোন। কোনো এক পুরুষের প্রেয়সী। কোনো এক পুরুষের বন্ধু। অস্তিত্বের জন্য একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। হাত ধরাধরি করে নারী-পুরুষ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী।
যাহোক, সাক্ষাৎকারে স্যাররা আমার জবাব গ্রহণ করেছিলেন কি-না, তা আমার আজ মনে নেই। শুধু মনে আছে সে কর্মশালায় যাওয়ার সুযোগ আমি পেয়েছিলাম। চমৎকার, অনাবিল এক কর্মশালা। সে গল্প না হয় আরেক দিন বলা যাবে।
এইচআর/বিএ/এমএস