ধর্ষণের রাজনীতি
প্রতিদিনই খবর আসছে। বার্তা কক্ষের মানুষগুলো এই খবর পরিবেশন করছে মন খারাপ করে। তিন বছরের শিশু কিংবা পরিণত বয়সের নারী কেউ বাদ যাচ্ছে না ধর্ষকের থাবা থেকে। আমি কারো নাম নিচ্ছি না. ধর্ষকের নাম জপার কিছু নেই।
নানাজনে নানা কথা বলছেন, এমপি-মন্ত্রীরাও বলছেন। শাসক দল আবার বহিষ্কারের খেলাও খেলছে। ধর্ষণের একটা ঘটনাও ঘটা উচিত নয়, তা নিয়ে কেউই বিতর্ক করবে না। কিন্তু দেশে ধর্ষণসহ নারী নির্যাতনের ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে, এই সত্য মাথায় নিয়েই নীতিনির্ধারকদের কথা বলতে হবে, রাজনৈতিক দলকে বহিষ্কার বা আবিষ্কারের কথা ভাবতে হবে। শাসন কাজ পরিচালনায় সাফল্য বা ব্যর্থতার বিরাট বিতর্কে আপাতত যাচ্ছি না, কিন্তু একথাতো বলাই যায় যে, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এমন কোন খামতিতো আছে যা মেয়েদের বিপদ বাড়াচ্ছে, বগুড়ার তুফানদের মতো ধর্ষকরা দলে পদ-পদবী পেয়ে যাচ্ছে।
দেশে মেয়েদের উপর অপরাধ অন্য সব অপরাধকে ছাড়িয়ে গেছে। সব ধরনের নারী নির্যাতনের মধ্যে ধর্ষণের হার বেশি। অনেকেই বলতে চাইবেন, যে এই সরকারের আমলে নারীরা এখন নির্ভয়ে থানায় অভিযোগ দায়ের করতে পারছে, তাই সংখ্যা বেশি মনে হচ্ছে। দলের নেতারা বলবেন, দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, বহিষ্কার করা হচ্ছে। এগুলো সব নিখাদ রাজনৈতিক বক্তব্য। বাস্তবতা যদি কিছু থাকেও তাদের কথায়, তাতে এই ধর্ষণ সংস্কৃতির বাড় বাড়ন্ত নিয়ে কোন দ্বিমত থাকেনা।
রাজনৈতিক অস্ত্রে ধর্ষণের অভিযোগের মোকাবিলা করতে গেলে শাসক দল অঙ্কে ভুল করবে। কারণ মানুষের মনে এসব কথার কোন ইতিবাচক প্রভাব পড়েনা, দলীয় দুর্বৃত্ত বুদ্ধিজীবীরা তর্ক করার উপাদান পেলেও পেতে পারে। যে রাজনীতি ধর্ষণকারীকে দল থেকে বহিষ্কারের মধ্যে সুখ দেখে সে তো বহু দিনের চেনা রাজনীতি।এ রাজনীতিতে রাজনৈতিক বোধের প্রচণ্ড অভাব।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীর অগ্রযাত্রায় সচেষ্ট সবসময়। কিন্তু যে সংস্কৃতি কম বেশি সব রাজনৈতিক দল ও নীতি নির্ধারকদের মধ্যে বিরাজমান, তা নারী প্রগতির পক্ষে নয়। নারীর সক্ষমতা, আত্মবিশ্বাস কেড়ে নেওয়ার সব চাইতে সহজ যে উপায় পুরুষদের হাতে রয়েছে, তা হল যৌন সহিংসতা। একটি তিন বছরের মেয়েকে ধর্ষণ করে যখন মেরে ফেলা হয়, যখন বিচার চাওয়ার কারণে ধর্ষিতা ও তার মাকে মাথা ন্যাড়া করে সেই ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, তখন তা কেবল দুটি কি তিনটি মেয়ের মধ্যে, বা তাদের পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনা। সেই হিংসার বার্তা ছড়িয়ে যায় কোটি কোটি নারীর কাছে। তারা আতংকিত হয়, তাদের পরিবার মেয়েদের ঘরে আটকে রাখতে মনস্তাত্বিক লড়াইয়ে পড়ে যায়।
নারী স্কুল-কলেজের পাবলিক পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাক, বেশি রোজগার করুক, এমনকি ভোটে দাঁড়িয়ে হারিয়ে দিক কোন জাঁদরেল পুরুষকে, কিন্তু এতে কিছু আসে যায় না। এই সমাজ এক সংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছে, যা বলছে এমন অসংখ্য সাফল্য সত্বেও নারীকে ধর্ষণ করে খুন করে ফেলা যায়। পুরুষের এই দুর্বিনীত ক্ষমতার বার্তাই প্রতিদিন পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে একটির পর একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে। বহিষ্কার নাটক করে, বা দু’একজনকে গ্রেফতার করে প্রকারান্তরে ধর্ষণের এই রাজনীতিটাই বেমালুম চেপে যাওয়া হচ্ছে।
রাষ্ট্র যদি সত্যি এই সমস্যার সমাধান চায় তাহলে এই সংস্কৃতির গভীরে দৃষ্টি দিতে হবে। সাধারণ লিপ সার্ভিসে কিছু হবেনা। ধনি-গরিবের মতোই, নারী-পুরুষের মধ্যেও রয়েছে ক্ষমতার প্রশ্নে শ্রেণি-সংঘাত। পুরুষ কখনোই সচ্ছন্দ্যে-সানন্দে নারীর দেহ এবং শ্রমের উপর তার অধিকার ছাড়তে চাচ্ছেনা। কখনো আইন দিয়ে, কখনো শরীরের উপর চড়াও হয়ে নারীকে বশে রাখার কথা সরবে উচ্চারণ করছে পুরুষ। তাই এই দিকে দৃষ্টি না দিয়ে শুধু কথা বলে চললে বুঝতে হবে রাষ্ট্র নারী নির্যাতনের অংশীদার।
একটা সময় বাম রাজনীতি এমন ধারণাই করতো যে, রাষ্ট্রের মদত না থাকলে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ চলতে পারেনা। রাষ্ট্রের সেই মুখ বদলাতে নারীরা কত না আন্দোলন করেছে। নারীদের নিরন্তর সংগ্রামের কারণে কঠোর সব আইনও হয়েছে। কিন্তু আমাদের সমাজ-সংসার এখনো সেই আদি জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। এখানে ক্ষমতা-কাঠামোর বুনিয়াদটাই মানবতাবিরোধী। দলীয় রাজনীতি এই সত্যকে এড়িয়ে গিয়ে নির্বিকার আচরণ করছে।
রাজনীতি এই ধর্ষণ সংস্কৃতির বিকাশ রোধে মাঠেই নামছেনা আসলে। একটা ‘অ-রাজনীতি’ আছে আমাদের রাজনীতিতে। আমাদের ক্ষমতার বলয়ে যে রাজনীতি আছে, সেই রাজনীতি ধর্ষক, মাদক ব্যবসায়ী, খুনি, সন্ত্রাসীকে দলে টেনে আনে। এই রাজনীতি মনে করে দলের এই ‘ভাইরাই’ আসল ভরসা, সাধারণ মানুষ নয়। এই ধরনের ‘ভাই’ বা ‘ভাইয়ারা’ রাজনীতিতে নারীবিদ্বেষ বাড়িয়ে তুলছে। এভাবেই নারী বিরোধী সংস্কৃতির জমি তৈরি হয়েছে রাজনীতির মাঠে।
গত কিছুদিন ধরে ধর্ষণের যে ব্যাপকতা বেড়েছে, তার সাথে ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা কর্মীর জড়িত থাকার যেসব কথা গণমাধ্যমে আসছে তা অপ্রত্যাশিত বা আকস্মিক নয়। গত কয়েক দশক ধরে দেশের সর্বত্র রাজনীতির যে পরিকল্পিত দুর্বৃত্তায়ন ঘটানো হয়েছে, যেভাবে প্রতিটি এলাকার চিহ্নিত সমাজবিরোধী ও দুষ্কৃতীদের দলে দলে পার্টির ছায়ায় আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, এধরনের ঘটনার মূলে সেই রাজনীতি। এই দুর্বৃত্তদের দিয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে, সহিংসতাকে আশ্রয় করে, নিরীহ জনসাধারণকে সন্ত্রস্ত রেখে রাজনীতির মাঠ দখলে রাখার সংস্কৃতিই আজকের ধর্ষণ সংস্কৃতির বিকাশের কারণ।
কঠোর হোক রাষ্ট্র। রাজনীতি নিজেকে ঠিক করুক। প্রধানমন্ত্রী যদি সত্যিই চান, লক্ষ্যে পৌঁছুতে গেলে কঠিন পথটা নিতেই হবে, এ ছাড়া কোন উপায় নেই। কী ভাবে সেই কঠিন পথ হাঁটতে হবে, তার একটা পথ দিশা হবে আগে নিজ দলের যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে কঠোর বার্তা দেওয়া। মানসিকতা পরিবর্তনের আন্দোলন চলুক, কিন্তু দু’একটা ধর্ষণকারীর চরম পরিণতি দ্রুত দেখুক সমাজ। অন্যথায় এর প্রতিকার করা অসম্ভব হবে, নারীরাও রাষ্ট্রের প্রতি, সমাজের প্রতি বিশ্বাস ফিরে পাবেনা।
লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।
এইচআর/এমএস