বর্ষার দরকার নেই, মেঘ ডাকলেই ভেসে যায় আমাদের শহর

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ০৪:০২ এএম, ২৯ জুলাই ২০১৭

বৃষ্টির অবিরাম ধারাপাতে পানি নিষ্কাশনের হতশ্রী চেহারাটা আরো একবার স্পষ্ট করে দিল এই রাজধানীতে। মতিঝিল থেকে সচিবালয়, ভিআইপি রোড থেকে অলিগলি, ঢাকার সর্বত্র এবার জলজট দেখা গেলো। এ বছর বেশি হলো নাকি অন্য যুগে বেশি ছিল তা নিয়ে তর্ক চলছে। তবু পরিসংখ্যান ছাড়াই বোধহয় এটা বলা চলে যে, এত দ্রুত এবং ব্যাপক পানি জমে যাওয়া নগরবাসী দেখলো অনেকদিন পর। কী করে দিন দিন এমন ভয়ানক আকার নিচ্ছে জলাবদ্ধতা সেই ইতিহাস খোঁজার চেয়ে সমস্যার সমাধানে দৃষ্টি দেয়াই শ্রেয়।

যারা কথায় কথায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে নিয়ে ঠাট্টা করে এই সমস্যার সঙ্গে রাজনীতি মেশান, তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, সেই ভারী বৃষ্টি হলে শহরের বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে যাওয়াটা নতুন ঘটনা নয়। ফি বছর লাগাতার বৃষ্টিতে শহরে পানি জমে। শহরের কেন্দ্রস্থলে, সচিবালয়ে বিগত জোট সরকারের আমলে পানি জমে গিয়ে মাছ ধরার দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে। মনে রাখতে হবে এই শহরে দীর্ঘ সময় মেয়র ছিলেন বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা এবং তার সময়ে কি কাজ হয়েছে সেকথাও আলোচনায় আসা প্রয়োজন। তাই সমস্যা নিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ খুব কম।

রাজধানীতে এমন বেশ কিছু জায়গা আছে যেখানে প্রায় সারা বছরই কমবেশি পানি জমে থাকে। আর বর্ষাকালে তো কথাই নেই। জল থইথই এলাকাগুলি মূল সড়ক থাকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জমে থাকা নোংরা পানি মাড়িয়ে যাতায়াত করতে হয় নাগরিকদের। পানি ঢুকে পড়ে ঘরের ভিতরেও।

প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়েছিল গত বুধবার। বুধবার কেন, কয়েকদিন ধরেই বিরামহীন চলছিল। আর এতে ডুবে যায় রাজধানী। ডুবন্তই থাকছে বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। আসলে অবস্থাটা এখন এমন বর্ষার দরকার নেই। মেঘ ডাকলেই ভেসে যায় আমাদের শহর। অথচ এই শহর গুলোর নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়নে কোটি কোটি টাকা নানা সরকারের আসলে ব্যয় হয়েছে। কিন্তু তারপরেও আমাদের শহরসমূহের নিষ্কাশন এমন বেহাল কেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন শহরের বাসিন্দারা। কিন্তু উত্তর নেই। নেই কারণ শুধু মেয়রদের দোষ দিয়ে এই উত্তর পাওয়াও যাবে না।

যে কথা বলা হয়েছে বহুবার, এবারও উচ্চারিত হয়েছে যে পানি নিষ্কাশনের কাজ হয়েছে এবং বহুবারই হয়েছে। কিন্তু পুরোটাই হয়েছে অপরিকল্পিত ভাবে, সমন্বয়হীনভাবে। এলাকা ভিত্তিক বিচ্ছিন্ন ভাবে কাজ হয়েছে, বিভিন্ন সংস্থা তাদের মতো করে হয়েছে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন নিজস্ব পরিকল্পনায় কিছু করতে পারেনি। কারণ এসব ব্যবস্থাপনায় ডাকা ওয়াসা আছে, আছে আরো নানা সরকারি সংস্থা। ফলে সমন্বিত পরিকল্পনা না থাকায় সে সব কিছুই মানুষের কাজে এলো না। শহরের নিষ্কাশন সমস্যার কোনও সমাধান তো হলই না, বরং মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়ল।

রাজধানীর চারদিকে একসময় কত খাল ছিল। ঝিল বেশ কিছু বড় জলাশয়ও। আগে যখন সে ভাবে এই শহরে নিকাশি-নর্দমা তৈরি হয়নি তখন প্রাকৃতিক ভাবেই বর্ষার জল এই সব জলাশয়, নদী-খাল ও নিচু এলাকায় গিয়ে পড়ত। তাতে শহরে তেমন পানি জমত না। এখন একের পর এক জলাশয় বুজিয়ে তৈরি হচ্ছে বাড়িঘর আর স্থাপনা। ফলে শহরের নিজস্ব প্রাকৃতিক নিষ্কাশন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। তার উপরে কৃত্রিম ভাবে তৈরি নর্দমা বা হাইড্রেনগুলিও বিজ্ঞানসম্মত ভাবে তৈরি না হওয়ায় শহরের পানি সব জমে গিয়ে তৈরি করে এই বেহাল অবস্থা।

এ শহরে মানুষের আচরণও আজ প্রশ্নের মুখে। সামাজিক মাধ্যমে সরকার বা মেয়রদের গালি দিয়ে, ট্রল করে মজা পাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার হওয়া যায় না। যেখানে সেখার ময়লা আবর্জনা ফেলার যে অভ্যাস আমরা করেছি, যেভাবে পলিথিন ও প্লাষ্টিক সামগ্রী ফেলছি রাস্তায়, তা পৃথিবীর খুব দেশের নাগরিকরাই করে।

এসব পলিথিন আর প্লাস্টিকে আটকে যাচ্ছে ড্রেনের মুখ। বৃষ্টি হলেই ড্রেনের পানিতে ভেসে যাচ্ছে রাস্তা। তবু আমাদের প্লাস্টিক ব্যবহারে কমতি নেই। শরীরে রোগ বাসা বাঁধতে পারে, বুঝতে কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট। সেই কাণ্ডজ্ঞান কী আছে আমাদের? বাজার বা বাড়ির জঞ্জাল রাস্তায় ফেলা আমাদের সংস্কৃতি। যে কোন বাড়িতে খাবারের পর ময়লা ফেলা হচ্ছে নর্দমায়, বাড়ির বাইরে সদর রাস্তায়। যে নগরীর মানুষের এমন সংস্কৃতি, তারা আবার কর্তৃপক্ষকে দোষ দেয় কি করে, তারা আবার ট্রল করে কাকে নিয়ে?

আমাদের আরো কীর্তি আছে। যত আধুনিক হচ্ছি, প্রকৃতিকে ততই লুণ্ঠনের সামগ্রী বিবেচনা করছি আমরা। অরণ্য ও নদনদী সেই লুণ্ঠনের প্রধান শিকার। খাল, বিল দখলতো হয়েছেই, নদীও নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। পানি প্রবাহের যেসব পথ ছিল সেসবের উপর যে পরিমাণ অত্যাচার হয়েছে, তা আক্ষরিক অর্থেই ভীতিপ্রদ। নদী ও অন্যান্য জলাশয় ভরাট করে, স্বাভাবিক গতি রোধ করে বিপুল পরিমাণে জৈব ও রাসায়নিক আবর্জনা ফেলে, অকল্পনীয় অবিবেচনায় আধুনিক নগরসভ্যতা গড়তে গিয়ে পানি প্রবাহের সব পথ বন্ধ করে এখন কেবল মাতম করছি আমরা।

বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য আগে যেসব খাল ছিল, সেগুলো ভরাট করে ঘরবাড়ি-দালান করা হয়েছে। রাস্তা হয়েছে। এগুলো খাসজমি, যা কিনা ইজারা বা দালান করা বা ভরাট করার কথা নয়। ওয়াসা খালের পথ ধরে নয়, রাস্তা ধরে কালভার্ট অথবা পাইপ ড্রেনেজ নির্মাণ করেছে। এসব ড্রেন সোজাসুজি পথে যায়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বে আগের খালগুলো দখল ও ভরাটমুক্ত করে, ঠিকমতো নকশা করে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের পথ করতে বেশ কয়েক বছর লাগবে।

তবুও শহরের সার্বিক নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন চাই। করতেই হবে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন গত বৃহষ্পতিবার বলেছেন, আগামী বছর থেকে আর জলাবদ্ধতার সমস্যা থাকবে না। তিন ঘণ্টার মধ্যেই সব পানি নেমে যাবে। আমরা আস্থা রাখতে চাই। তবে বলতেই হবে, এ এক কঠিন কাজ।

লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।

এইচআর/জেআইএম

‘আমাদের আরো কীর্তি আছে। যত আধুনিক হচ্ছি, প্রকৃতিকে ততই লুণ্ঠনের সামগ্রী বিবেচনা করছি আমরা।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।