বাঙালি নারী পুরুষের সাথে প্রতিযোগিতা করে পুরুষের ঘাড়ে বসেই
পৃথিবীতে বাঙালি নারীই হচ্ছে একমাত্র হাস্যকর জাতি যারা পুরুষের মতো হতে চায়, পুরুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে চায়, কিন্তু সেটা করতে চায় পুরুষের ঘাড়ে বসে। পান থেকে চুল খসলে কমন ডায়লগ, ‘খাওয়াতে না পারলে বিয়ে করছে কেন?’ আরে, বিয়ে কি ছেলেরা একা করে নাকি? এ যুগের ছেলেদেরও একটা নতুন ডায়লগ ডেভেলপ করা দরকার, ‘তুমি বসেছিলে বলেই বিয়ে করছিলাম, খাওয়াইতো চাকর-বাকরকেও।’
গত বছর আনিসুল হক স্যার এই বিষয়ে আমার একটা পোস্ট শেয়ার করেছিলেন। সেদিনের সেই পোস্টটা তিন ঘণ্টার মধ্যে ১২২টা শেয়ার হয়েছিল। বুঝতে পেরেছিলাম বাঙালি পুরুষ বড় নাজুক অবস্থার মধ্যে আছে। আমি যেন ওদের না বলা কথাগুলোই তুলে ধরেছিলাম। পোস্টটার বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশে মেয়ের মায়েদের অযথা হস্তক্ষেপের কারণে মেয়ের সংসারে অশান্তি প্রসঙ্গে। কতো সংসার যে ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে এই দুপক্ষের মা’দের ইগো ক্লেশের কারণে। যদিও ছেলের মায়েরাও কোয়ালিটির দিক থেকে এর চাইতে খুব একটা উন্নততর নয়, তবুও মনে হচ্ছে আমাদের দেশের মেয়েদের তুলনায় ছেলেরাই দুরবস্থাপন্ন ইদানিং।
এখন তো আরও সুবিধা। বাংলাদেশ সরকার মেয়েদের পক্ষে কীসব আইন করেছে, পান থেকে চুন খসলে আম্মা, আব্বা, ভাইয়া, আপা, আত্মীয়-স্বজন নির্বিশেষে গ্যাতি-গোষ্ঠী সবাই মিলে বরের কাছ থেকে কাবিনের টাকাটা হাতিয়ে নেন। সন্তান থাকলে পিতার সেই সন্তানের ভরণ-পোষণের দায়িত্বভার নিতে হবে এই আইনের যুক্তি আছে। নিম্ন শ্রেণির নির্যাতিত মেয়েদের জন্য নারী নির্যাতন আইনেরও অপরিহার্যতা আছে। কিন্তু কাবিনের টাকার ব্যাপারটা কিছুটা গোলমেলে। বলে যে ছাড়বে তাকেই কাবিনের টাকা দিতে হবে। কিন্তু এ পর্যন্ত কোন পুরুষকে কাবিন পেতে শুনিনি। এতো দেখছি এক নির্যাতন বন্ধ করতে আরেক নির্যাতনের সূচনা। বিয়ে ভাঙলে ক্ষতি কি কেবল মেয়েদের একার হয় নাকি? কলঙ্কের দাগ কি পুরুষের গায়ে লাগে না? নারীকে পুরুষের সমান অধিকার দাও। কই কাবিনের টাকাটা তো সমান ভাগে ভাগ করেন না। মানুষ কতটা আত্মসম্মানবোধহীন হলে নিজের ক্ষতিপূরণ করতে অন্যের রক্তে অর্জিত আয়ের ওপর নির্দ্বিধায় ভাগ বসায়।
বিয়েতে আবার ক্ষতিপূরণ কিসের? এটা কি ব্যবসা নাকি যে ব্যাংক ক্রাপ্ট হবে? তাও আবার ব্যাংক ক্রাপ্ট হয় এক পার্টনারের। যদি ব্যবসাও ধরি, ব্যবসার নিয়মানুযায়ী তাহলে বিয়েটা হবে পার্টনারশিপ। মিনিমাম দু’জন পার্টনার নিয়ে লিমিটেড কোম্পানির মতো। আরে লিমিটেড কোম্পানির পার্টনারশিপেওতো ইনভেস্টমেন্ট অনুযায়ী প্রফিট অ্যান্ড লস দুটোই সমানভাগে দুই পার্টনারের মধ্যে ভাগ হয়। এতো একমাত্র ডাকাতির পর্যায়েই পড়ে।
আমাদের দেশের ছেলেদের এ নিয়ে বিরোধ করা দরকার। কিন্তু ওরা করবে না। কারণ পৃথিবীতে ছেলেরা মেয়েদের মতো অবলা নয়, যদিও ওরাই বলে কম। তাই বোধহয় রবীন্দ্রনাথ রসিকতা করে মৈত্রীয় দেবীকে বলেছিলেন, ‘তোমরা অবলারা এতো বল কেনগো বলতে পারো?’ পুরুষ বরাবরই দায়িত্ববান, মর্যাদাবান। ওরা জানে অধিকার এবং সম্পদ অর্জন করতে হয়। সরকার রাষ্ট্রীয় আইনের দ্বারা যাদের অধিকার আদায় করতে বাধ্য করে তারা ‘পিপল উইথ স্পেশাল নিডস’।
প্রতিবন্ধীর তো ক্ষমতা নেই, শারীরিক, মানসিকভাবে তারা অক্ষম। কিন্তু মেয়েরা কি অক্ষম? বিশেষ করে যদি সে হয় ঊনিশ শতকের নারী! একদিন বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষীয় বাঙালি মধ্যবিত্তই ছিল এই জাতির সংস্কার ও মূল্যবোধের একমাত্র ভিত্তি। বাঙালি মধ্যবিত্তই এই গোটা বাঙালি জাতিকে একদিন সমৃদ্ধ করেছিল।
আজকের মধ্যবিত্ত বাঙালি যেটা হারাচ্ছে সেটা হলো মূল্যবোধ, আত্মসম্মানবোধ। আধুনিক বাংলাদেশে বিয়ে ভেঙে মেয়ের জীবনের মূল্য আদায় করতে সপরিবারে নির্দ্বিধায় আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যেতে মধ্যবিত্ত বাঙালির আর মানসম্মানে বাধে না। টাকা দিয়ে কি মানসম্মানের ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব? ঘর-সংসার, মানসম্মান যাবে যাক, কিন্তু মধ্যবিত্ত বাঙালির আজ টাকা চাই। অথচ একদিন এই আদর্শ, নীতি, মানসম্মানের জন্যই এই মধ্যবিত্ত সকল বৈষয়িক সুখ-শান্তি, লোভ-লালসাকে মুহূর্তে তুচ্ছ করে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে।
আগে যেমন মেয়ে হলে বাঙালি অখুশি হতো, সেদিন আর দূরে নয় যখন বাংলাদেশে কন্যাসন্তান মানেই হবে বিরাট এক আয়ের উৎস, আর পুত্রসন্তান মানেই হবে বিরাট বোঝা। তাতে কি? পুরুষতো যুগ যুগ ধরে এই বোঝা বয়ে অভ্যস্ত, তাই দিন শেষে পুরুষই খেটে মরবে। আপাতদৃষ্টিতে আমার লেখাটি নারীর বিপক্ষে মনে হলেও, আসলে লেখাটির উদ্দেশ্য ন্যায়ের পক্ষে। অর্থাৎ লেখাটি পুরুষের ওপর অন্যায়ের বিপক্ষে। এ কথা সত্য একদিন পুরুষ নারীর ওপর অন্যায় করেছিল, কিন্তু একথাও ভুলে গেলে চলবে না যে একদিন নারী নির্যাতন বন্ধ করে নারীকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে সেই পুরুষই সক্রিয় হয়েছিল। পুরুষে পুরুষে যেমন ভেদাভেদ আছে, তেমনি নারী জাতেরও ভিন্নতা আছে। সুতরাং আজ যেটুকু নারী এগিয়েছে এর পেছনে পুরুষের অবদান অস্বীকার করা যায় না। এখানে নির্যাতনের বিচার না করার আভাস নেই, তবে নির্যাতনের নামে নির্লজ্জের মতো যারা পুরুষের অর্জন নির্দ্বিধায় আত্মসাৎ করতে চায়, সেইসব নারীকে কাপুরুষের মতো কুনারী আখ্যা দেয়া প্রয়োজন।
আমি নিজেই যেহেতু নারী, স্বাভাবিকভাবেই আমি শতভাগ নারী উন্নয়নের পক্ষে। তবে আমি নারী উন্নয়নের নাম করে, অবলা দাবি করে ফায়দা লুটার বিপক্ষে। একদিন এবং আজো যদি পুরুষ নারী উন্নয়নের পক্ষে দাঁড়ায় তাহলে মেয়েরা কেন, কিসের অভাবে পুরুষের পক্ষ নিতে পারে না? নারী মনের এই সংকীর্ণতার জন্যও কি পুরুষই দায়ী? আজ এই একুশ শতাব্দীতে আর সতীদাহ প্রথা, বাল্যবিবাহ, বিধবা আইন এইসব মান্ধাতা গল্প বলার দিন শেষ হয়েছে। আর কতো চোখের জল আর করুণা ভিক্ষা? আমাদের বাংলাদেশে যেখানে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, মন্ত্রী, সংসদের স্পিকার, ব্যাংকের প্রধানসহ প্রায় সবই নারী, নারীকে করুণা করার দিনও ফুরিয়েছে। গতবার চট্টগ্রাম পাসপোর্ট অফিসে গেলাম, টপ র্যাংক থেকে নিম্ন শ্রেণির টাইপিস্ট মিলে আগ্রাবাদ ব্রাঞ্চে মোট চৌদ্দজন নারী।
সুতরাং এদের অবলা বলার দিন শেষ, অবলা এখন সবলা হয়েছে। এখন দায়িত্ব নেয়ার পালা, মেকআপ আর পার্লার কম, কাজ বেশি। পশ্চিমা কোন নারী স্বামীর ঘাড়ে বসে খায়? সেজন্যই ওদের ওখানে নারী উন্নয়ন হয়েছে। শুধু আইন নয়, দায়িত্ব পালন করছে ওরা। নইলে রাষ্ট্রীয় আইন ও সামাজিকীরণে ভারসাম্যহীনতা দেখা দিতো। যেকোনো সুস্থ ইকোনমির লক্ষণ হচ্ছে টাকার বিপরীতে যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ গচ্ছিত রাখা। এই টাকা সম্পদের তুলনায় বেশি হলে ইনফ্লেশন (দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি) হয়, কম হলে ডিফ্লেশন (দ্রব্যমূল্য হ্রাস) হয়। দুটোই দেশের অর্থনৈতিক দুর্যোগ এনে দেয়। আমাদের আধুনিক নারী অধিকারেও ইনফ্লেশন চলছে।
আধুনিক সমাজ, সংসার, কর্মক্ষেত্রে সবক্ষেত্রে নারী তার পূর্ণ অধিকার দাবি করছে, কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণে দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি, অক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছে। নিম্ন শ্রেণির মেয়েদের উন্নয়ন রাষ্ট্রীয় কাঠামোর হাতে। কেবল নারী নির্যাতন দমন করলে নারীর উন্নয়ন হয় না। নির্যাতিতাকে রক্ষা করা হয় মাত্র। আইনস্টাইন যেমন বলতেন, ‘এক সমস্যার সমাধান আরেক সমস্যা দিয়ে হয় না’, তেমনি এক অন্যায়ের প্রতিরোধ আরেক অন্যায় দিয়ে হয় না। এতে কেবল বিশৃঙ্খলাই বাড়ে, আর সেই বিশৃঙ্খলার জলজ্যান্ত প্রমাণ আধুনিক বাঙালি সমাজের চিত্র।
লেখক : ডাবলিন ট্রিনিটি কলেজের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।
এইচআর/পিআর