বাংলার ভেনিস ও গুপ্তধন সমাচার


প্রকাশিত: ০৪:০৪ এএম, ১০ জুলাই ২০১৭

কয়েকমাস আগে ফেসবুকে এক বন্ধুর ছবি দেখলাম। তিনি ভেনিসে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মনে বড় দুঃখ হলো। মার্চেন্ট অব ভেনিস পড়েছি সেই কবে। অথচ ভেনিসে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। আরও অনেক জায়গাতেই যাবার সুযোগ হয়নি। কিন্তু ভেনিসের প্রতি একটা বিশেষ আকর্ষণ ছিল অনেক হলিউডি মুভিতে সেই শহরের সৌন্দর্য অবলোকনের সুবাদে। তবে এবারের বর্ষাকালে সেই খেদ মিটতে চলেছে। কারণ শহরের বুকে নৌকা চলার সুযোগ আর বিরল কোন বিষয় নয়। যারা শহরের মধ্যে নৌভ্রমণের আনন্দ নিতে চান তাদের ঢাকা শহরের জুড়াইন ও অন্যান্য নিচু এলাকায় সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আর চট্টগ্রামবাসীর আনন্দের কথা তো লিখে প্রকাশ করা সম্ভবই না। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম এখন বাংলার ভেনিসে পরিণত হয়েছে। বড় বড় সড়কে বহিছে জলধারা। কি সুন্দর দৃশ্য। নগরীর অনেক এলাকাতেই বহুতল ফ্ল্যাটবাড়ির একতলা পুরোপুরি ওয়াটার গার্ডেন। পানির উপরে ভাসছে জলচৌকি আর খাট পালংক। সবাই এখন মারমেইড।

শুনোছি আমরা নাকি মধ্যম আয়ের দেশের সারিতে পা রেখেছি। সেই উন্নয়নের কি সুন্দর নমুনাই না দেখা যাচ্ছে। জলে ভাসছে মধ্যম আয়ের দেশের দুটি প্রধান শহর ঢাকা ও চট্টগ্রাম। অথচ সমন্বিত পরিকল্পনা থাকলে এই জলাবদ্ধতার সমস্যা দূর করা কোন অসম্ভব বিষয় নয়। শুধু জলাবদ্ধতা নয়। বলুন তো ঢাকায় এবং চট্টগ্রামে নাগরিকরা কি অসাধারণ সব সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন! ঢাকায় তো সড়কগুলোকে রাজপথ না বলে রাজখানাখন্দ নামে ডাকলেই এগুলোর প্রতি সুবিচার করা হয়।

বর্ষা আসা মাত্র রাজধানীর বুকে শুরু হয় ব্যাপকমাত্রায় খোঁড়াখুঁড়ি। ঢাকা তো মোগল আমলের শহর। মনে হয় শায়েস্তা খানের আমলের প্রচুর গুপ্তধন এই শহরের এখানে ওখানে পুতে রাখা হয়েছে। সেটা সম্ভবত টাকায় আটমণ দরের চালের বস্তা। সেই গুপ্তধনের বস্তার খোঁজেই প্রতিবছর শহর জুড়ে চলে খোঁড়াখুঁড়ি। শীতকালে তাই এ শহরের বুকে ওড়ে ধুলা আর বর্ষাকালে আমরা তলিয়ে যাই কাদার তলে। যে ফুটপাত দিব্যি ছিল। সেটিকেও অযথা খুঁড়ে নষ্ট করে ফেলে রাখা হয়। বাজেটের বরাদ্দ টাকা যদি খরচ না হতেই ফিরে যায় তাহলে তো সর্বনাশ। সে টাকা খরচ করতেই যে এত খোঁড়াখুঁড়ির চল সেটা বুঝতে শার্লক হোমস হতে হয় না।

ঢাকাকে কোন সভ্য দেশের রাজধানী বলতে সত্যিই লজ্জা হয় যখন এর রাস্তায় যত্রতত্র মানুষের মলমূত্র ত্যাগের দৃশ্য চোখে পড়ে। এটা কোন সভ্যদেশের পরিচয় হতে পারে কি? চিন্তা করুন তো একবার কোন বিদেশি যখন ঢাকার রাস্তায় ওপেন এয়ার ল্যাট্রিন দেখে তখন তার মনের অবস্থা কি হয়। ডাস্টবিনগুলোর দৃশ্যও পাশাপাশি কল্পনা করুন। ময়লা উপচে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য ডাস্টবিন একেবারে নগরের প্রধান প্রধান সড়কের উপরেই। তারই পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছে নির্বিকার মুখে মানুষ। ঢাকায় সম্প্রতি কয়েকটি পাবলিক টয়লেট তৈরি হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় এই টয়লেট হলো সমুদ্রের কাছে গোস্পদ। পাবলিক টয়লেট দরকার শহরের প্রতিটি রাস্তায়। প্রয়োজনে ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে অল্প পরিমাণ অর্থ নিয়েও যদি টয়লেটগুলোর পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা যায় তাহলে সেগুলো নাগরিকদের জন্য অনেক বড় সেবা নিয়ে আসবে। পুরুষরা যদিও লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে যেতে পারে, নারীরা তো তা কোনভাবেই পারে না। ঢাকার নারীদের কিডনি ও ব্লাডারের সমস্যার অন্যতম কারণ এই পাবলিক টয়লেটের অভাব। এ নিয়ে পরে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা রাখি।

একটি শহরের সামগ্রিক মান বোঝা যায় তার নাগরিকদের প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধা দেখে। রাজধানীবাসী হয়ে কি সুযোগ সুবিধা পাচ্ছি আমরা? ঢাকার এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাবার কথা ভাবলে তো রীতিমতো কান্না আসে। বিশেষ করে যাদের নিজস্ব গাড়ি নেই। গণপরিবহনগুলোর অবস্থা চিন্তা করুন একবার। অধিকাংশ বাসে দৌড়ে উঠতে হয়, দৌড়ের উপরে নামতে হয়। কতটা বিপদজনক সেটা? আমাদের গণপরিবহনের এই বেহাল অবস্থা শুধু প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে। সেইসঙ্গে কিছুসংখ্যক নেতানামধারী দুর্বৃত্তের হাতে পুরো পরিবহন ব্যবস্থা জিম্মি হয়ে পড়ায় এই অরাজকতা চলছে। গণপরিবহনে নারীদের হয়রানির বিষয়টিও বহুল আলোচিত ও সমালোচিত। বাসে নারীর সিট রাখা আর কাজীর গরু কেতাবে থাকার উদাহরণটিও ক্লিশে হয়ে গেছে। অবস্থা দেখে মনে হয় এমনটাই চলছে ও চলবে। নারীরা পারলে চলফেরা করুক। না পারলে নিজের রাস্তা নিজে মাপুক। সরকারের কোন দায়দায়িত্ব এ বিষয়ে নেই।

নগরে চিকুনগুনিয়া রীতিমতো মহামারী আকার ধারণ করেছে। তবু মশা মারতে কামান দাগা তো দূরের কথা কোন কার্যকর উদ্যোগই নিচ্ছে না সিটি করপোরেশন। আমাদের নগরের আবার দুই পিতা। কিন্তু দুই পিতা মিলেও কোন ফল উপহার দিতে পারছেন না নগরবাসীকে। মনে হয় দুই পিতা নয়, এ শহরটি একেবারেই এতিম। এই এতিমের উপর অবাধে নিপীড়ন চালাচ্ছে মশককুল। ঢাকার সমস্যার চেয়ে চট্টগ্রামের সমস্যা কোন অংশে কম নয়, বরং বেশি। ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত লিখেছিলেন, রাতে মশা দিনে মাছি এই নিয়ে কলকাতায় আছি। আমাদের মধ্যে যারা ঢাকায় ও চট্টগ্রামে আছি তারা যে কী কী নিয়ে আছি তা ভুক্তভোগীরাই ভালো জানি। কৌতুক সম্রাট ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় মরণের উপায় নাই বলেই বেঁচে আছি। বিষ যে বিষ তাতেও ভেজাল।

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/জেআইএম

বন্দরনগরী চট্টগ্রাম এখন বাংলার ভেনিসে পরিণত হয়েছে। বড় বড় সড়কে বহিছে জলধারা। কি সুন্দর দৃশ্য

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।