আসা-যাওয়ার পথের ধারে


প্রকাশিত: ০২:০০ এএম, ২২ মে ২০১৫

ড. আহমেদ আমিনুল ইসলাম :
বছরের কিছু বেশি হলো মাসে একবার কি দুবার কোনো না কোনো জেলায় কিংবা উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাই। এটি আমার জন্য একটি সুযোগ। এ সুযোগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল এবং সেসব অঞ্চলের মানুষ সম্পর্কে কিছু না কিছু জানতে পারি। আমার এ ভ্রমণের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, শিশু এবং বিভিন্ন ধরনের মানুষের সঙ্গে দুটো কথা বলারও সুযোগ হয়। মোটকথা, যাকে বলে মানুষের কাছে যাওয়া সেই মানুষের কাছে যাওয়ার মতোই যেন অনেকটা। গত এক বছরে অন্তত ১২টি জেলার ২৭টি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে যাবার সুযোগ হয়েছে। সুযোগটি আমাকে দিয়েছে বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশন নামের সংস্থা।

বলে রাখা ভালো এতে দুটো পয়সাও জোটে। অর্থাৎ একসঙ্গে দুটো কাজ হয় এক. দুটো পয়সা জোটে এবং দুই. অচেনা জায়গার অজানা মানুষের সঙ্গে জানা শোনা, কথা-বার্তা হয়। আমার এ ‘আসা-যাওয়ার পথের ধারে’ বিগত এক বছরে যাদের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে তাদের অনেকেই বিভিন্ন উৎসব-পার্বনে যখন ফোনে শুভেচ্ছা জানান তখন ভালো লাগে। তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ছবিটি মনের চোখে আরেকবার মিলিয়ে নিই। এ ভালো লাগার অন্য রকম এক আনন্দও আছে।

আমার এ ভ্রমণের উদ্দেশ্য হলো স্থানীয় পর্যায়ের এনজিওগুলো বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশন থেকে প্রাপ্ত আর্থিক সহায়তায় সংশ্লিষ্ট কর্মসূচিটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করছে কি-না তা দেখা। অর্থাৎ এ ফাউন্ডেশন থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়ে বিভিন্ন জেলা বা উপজেলার স্থানীয় এনজিওগুলো দরিদ্রদের মধ্যে নানা ধরনের যেসব উপকরণ বা সেবা প্রদানের কথা তা যথার্থভাবে করেছে কি-না সে সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়া। আরো বিশদ করে বললে আমার বা আমার মতো আরো কিছুসংখ্যক মনিটরিং অ্যাডভাইজারের কাজ হলো দরিদ্রদের মধ্যে বিশেষ করে দরিদ্র নারীদের মধ্যে নানা ধরনের যেসব উপকরণ বা সেবা নিশ্চিত করার কথা তা কতোটুকু সফলভাবে বিতরণ করা হয়েছে তার মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করা। শুধু তাই নয়, এর পাশাপাশি হিসাব-নিকাশ পর্যালোচনাও করতে হয়।
   
‘বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে’ এ দৃশ্যটি বর্তমান বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম-গঞ্জে গিয়েও উপলব্ধি করা সম্ভব। উপলব্ধি করা সম্ভব একটা ইতিবাচক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সত্যিই এগিয়ে যাচ্ছে। প্রসঙ্গত, কিছু দিন আগের একটি অভিজ্ঞতার কথা এখানে তুলে ধরছি : বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলার ‘বগুড়া গ্রামীণ উন্নয়ন সংস্থা’ চারটি ইউনিয়নের ৯টি গ্রামের প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নের লক্ষ্যে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের শারীরিক প্রতিবন্ধী যেমন- দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, শ্রবণ-প্রতিবন্ধী, দুর্ঘটনাজনিত প্রতিবন্ধী এবং বুদ্ধি ও বাক-প্রতিবন্ধীদেরকে সংস্থাটির কর্মসূচির আওতাভুক্ত করা হয়েছে। প্রতিবন্ধীদের সচল ও সক্রিয় জীবন যাপনের লক্ষ্যে সংস্থাটি হুইল চেয়ার, ট্রাই সাইকেল, ক্র্যাচ, সাদাছড়ি প্রভৃতি প্রদান করেছে।

এছাড়া, বয়স্কদের চোখের ছানি অপারেশনের মাধ্যমে চিকিৎসা সহযোগিতা প্রদান করেছে। আর অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য চলাচলে সক্ষম কিন্তু বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের মাঝে ছাগল বিতরণ করেছে। প্রতিবন্ধী হয়েও যখন কেউ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয় সে আর তখন অন্যের করুণার পাত্র থাকে না। সেও সমাজের সচল মানুষের একজন হিসেবে নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা লাভ করে।

কর্মসূচি-সংশ্লিষ্ট গ্রামে গ্রামে গিয়ে বর্তমান সংস্থার নিকট থেকে বিভিন্ন ধরনের অনুদান প্রাপ্তদের সঙ্গে আলোচনা করে, তাদের কথা শুনে ব্যক্তিগতভাবে আমি আনন্দিত ও আশাবাদী হয়েছি। বিভিন্ন দুর্ঘটনায় শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়ে যখন কেউ একেবারে অচল ও অক্ষম জীবন যাপন করছিলেন তখন বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহায়তায় স্থানীয় সহযোগী সংস্থাটি তাদেরকে নানা রকম উপকরণ প্রদান করে। এসব উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের জীবনে সচলতা ফিরে এসেছে, ফিরে এসেছে সক্ষমতাও।

আবার, প্রতিবন্ধী হয়েও দুঃস্থ নারীরা ছাগল লালন-পালনের মাধ্যমে পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছ্লতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছেন। অলস বসে না থেকে প্রতিবন্ধীরাও আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দরিদ্র, অসহায়, মানুষের এই জীবন সংগ্রাম আমাদের আশাবাদী করে তোলে বৈকি।  

পথে-প্রান্তরে সমাজের প্রান্তজনের সঙ্গে পরিচয়ের মেলবন্ধনে অন্যরকম অভিজ্ঞতাও সঞ্চিত হয়েছে। এ মুহূর্তে মনে পড়ছে সামান্য একটি ক্র্যাচ অনুদান হিসেবে পেয়ে বয়সের ভারে ন্যূব্জ এবং চলাচলে প্রায়-অক্ষম এক ব্যক্তি আমাকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তার ধারণা যেন সেই ক্র্যাচটি আমিই তাকে দিয়েছি!

দরিদ্র ও দুঃস্থ মানুষের এ ধরনের অসহায়তা দেখে আবেগ-আপ্লুত না হয়ে থাকা যায় না। ক্র্যাচটির সাহায্যে হাঁটতে পারেন বলে তিনি সরকারের প্রতি অপরিসীম কৃতজ্ঞতায় ও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। থুত্থুড়ে ওই লোকটি আমাকে সরকারের কেউ ভেবে অঝোরে ফেলেছিলেন চোখের জল! এই দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে নিজেকে তখন খুবই ছোট, খুবই ক্ষুদ্র মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল আমরা কি এরকম অসহায় মানুষকে একটি ‘লাঠি’ও দিতে পারি না? যে লাঠির সাহস নিয়ে জীবনের শেষ দিনগুলো নিশ্চিন্তে নির্ভার কাটাতে পারেন আমাদের প্রবীণরা।

জানি, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এ কোনো দুর্লভ অভিজ্ঞতা নয়। তবু, সামান্য একটি লাঠি (ক্র্যাচ) যে গভীর আবেগ নিয়ে আমাকে বিহ্বল করেছিল তা ভোলা কঠিন! সরকার যদি অসহায় এসব প্রবীণদের পাশে দাঁড়ায় তবে এদের নীরব চোখের অশ্রুজাত আশীর্বাদ এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের উদ্দেশ্যেই নিবেদিত হবে।  

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এইচআর/বিএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।