নির্ভরতার আরেক নাম বাবা


প্রকাশিত: ০৬:০৯ এএম, ১৮ জুন ২০১৭

যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশ। শেষ হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। কিন্তু অভাবের সঙ্গে গণমানুষের যুদ্ধ শেষ হয়নি বরং শুরু। এমনি এক সময়ে দুই শিশু সন্তানের বাবা এক যুবক নিজের পরিবারের অন্ন সংস্থান করতে যুদ্ধ চালান বেকারত্বের সঙ্গে। একটি চাকরি পান তিনি। সে চাকরিতে যোগ দেওয়ার শর্ত হলো তার একটি নিজস্ব বাইসাইকেল থাকতে হবে। তার একটি বাইসাইকেল ছিল কিন্তু সেটি টাকার অভাবে বাঁধা পড়েছে বন্ধকী দোকানে। স্বামী-স্ত্রী মিলে অনেক কষ্টে ঘরের কিছু সামগ্রী বিক্রি করে টাকা জোগাড় করেন। সাইকেলটি নিয়ে আসেন বাড়িতে। কিন্তু চুরি হয়ে যায় সাইকেলটি। বাবা তার শিশুপুত্রকে নিয়ে সাইকেল চোরের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে বাপ-বেটা একটা সাইকেল চুরি করতেও চেষ্টা করেন। যদিও সফল হন না সে কাজে।

বাস্তব ঘটনা নয়। এটি একটি চলচ্চিত্রের কাহিনী। সর্বকালের অন্যতম সেরা এই চলচ্চিত্রের নাম ‘বাইসাইকেল থিভস’। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইতালির রোম শহরের হতভাগ্য পিতা-পুত্রের কথা সিনেমার পর্দায় তুলে ধরা হয়েছে। লুইজি বারতোলিনির উপন্যাস অবলম্বনে ভিত্তোরিও ডি সিকা পরিচালিত এই ছবিতে বাবা ও ছেলের সম্পর্ক যেমন মধুর ও করুণভাবে তুলে ধরা হয়েছে তার জুড়ি মেলা ভার। বাবা দিবসে তাই মনে পড়লো ছবিটির কথা। অনেকেই বলেন ‘বাবা দিবস’, ‘মা দিবস’ এগুলোর কোন মানে নেই। বাবা-মাকে কি দিবস মেনে ভালোবাসতে হবে? এগুলো হলো বাবা-মায়ের প্রতি ভালোবাসার বাণিজ্যিকীকরণ। কার্ড আর গিফট বিক্রির প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশেষ কৌশল। তাদের কথায় যুক্তি নেই, তা নয়। তবুও আমি ব্যক্তিগতভাবে এই দিবসগুলোর পক্ষে। কারণ জানতে চাইলে চলে যান বৃদ্ধাশ্রমে। সেখানে এমন অনেক প্রবীণ মানুষের দেখা পাবেন জীবন সায়াহ্নে যাদের খোঁজ করতে বছরে একটি বারও আসে না সন্তান। এমনকি ঈদের দিনেও না। মা দিবস, বাবা দিবসের মতো বিশেষ দিনগুলোতে অন্তত একটিবারের জন্যও যদি তাদের মনে পড়ে বাবা-মায়ের কথা তাহলেই বা ক্ষতি কি। এই দিনগুলো পালন করার মানে এই নয় যে বছরের অন্যান্য দিন বাবা-মাকে ভালোবাসা যাবে না।

বাঙালি আবেগপ্রবণ জাতি। কিন্তু প্রাত্যহিক জীবনে আমরা ইতিবাচক আবেগের প্রকাশ কম করি। যেমন, আমরা যত সহজে রিকশাওয়ালার উপর খাপ্পা হয়ে উঠি বা প্রতিবেশির সঙ্গে ঝগড়া করি, একটি দরিদ্র শিশুকে দেখে তত সহজে চোখের জল ফেলি না। বাবা, মাকে আমরা যে কম ভালোবাসি তা নয়। কিন্তু মুখে সে কথা খুব কমই প্রকাশ করি। আমরা লজ্জা পাই। বাংলা চলচ্চিত্র ছাড়া ঘটা করে বাবা তোমাকে ভালোবাসি একথা বলতে তো দেখা যায় না সাধারণত। বাবা-মায়েরাও বুঝে নেন যে সন্তান তাকে ভালোবাসে, মুখে বলার প্রয়োজন পড়ে না। এমনকি মাকে বলা হলেও বাবাকে খুব কমই বলা হয়। কারণ বাবার সঙ্গে অনেক বাঙালি পরিবারে একটু সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধার দূরত্ব থাকে। আজকাল অবশ্য সেই দূরত্ব অনেক কমে গেছে।

বাবা এখন বন্ধু হয়ে উঠেছেন অনেক পরিবারেই। বন্ধু হলেও তার প্রতি ভালোবাসার প্রকাশটা মুখে খুব কমই হয়। কিন্তু মাঝে মাঝে মুখে বলাটা দরকার। বিশেষ করে বৃদ্ধ বয়সে। তখন রোগে শোকে শরীর জীর্ণ হয়ে পড়ে, মনও হয়ে যায় দুর্বল। বাবা তখন সন্তানের কাছে ভরসা চান, সাহস চান। একদিন যিনি ছিলেন পুরো পরিবারের নির্ভরতার মানুষ, একদিন যিনি সকলের আরামে থাকার ব্যবস্থা করতে গিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, আজ তিনি হয়ে পড়েছেন অপরের উপর নির্ভরশীল। এই সময়ই বন্ধুর মতো তাঁর পাশে থাকতে হবে। কারণ এই সময় তিনি সন্তানের উপরে একান্ত ভাবে নির্ভর করেন এবং আর্থিক প্রয়োজন যদি নাও থাকে তো মানসিকভাবে অন্তত নির্ভর করতে চান।

সম্রাট বাবর যেমন তার পুত্র হুমায়ূনের জন্য নিজের জীবন দিতে কুণ্ঠিত হননি তেমনি ইতিহাসে রয়েছে নিবেদিতপ্রাণ সন্তানের নামও। সম্রাট শাহজাহানের কন্যা জাহানারা ছিলেন পিতার জন্য নিবেদিতপ্রাণ সন্তান। বৃদ্ধ শাহজাহানকে তিনি একাধারে কন্যা ও মায়ের মতো শ্রদ্ধা ও মমতায় ঘিরে রেখেছিলেন। বিষ প্রয়োগে বন্দী সম্রাটকে হত্যা করা হতে পারে এমন আশংকা ছিল। জাহানারা তাই নিজে আগে খাদ্য খেয়ে পরীক্ষা করে তারপর তা বাবার পাতে তুলে দিতেন। কন্যা ফাতেমার (রা.) সঙ্গেও রসুল (স.) এর সম্পর্ক ছিল বিশ্বস্ততা ও নির্ভরতার।

সন্তানের মধ্যেই বেঁচে থাকে বাবার আদর্শ। বাবার আরাধ্য কাজকে এগিয়ে নিয়ে যান সুসন্তান। ইন্দিরা গান্ধী, শেখ হাসিনা, মেঘবতী সুকর্ণপুত্রীর মতো সুযোগ্য কন্যারা বাবার আদর্শকে ধারণ করে জয়ী হয়েছেন। কিছুদিন আগে গাজীপুরে হতভাগ্য বাবা হযরত আলী ও তার আট বছরের মেয়ে আয়শার করুণ মৃত্যুর খবর আমরা পড়েছি। কন্যাকে রক্ষা করতে না পারার কষ্টে মেয়েকে সাথে নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন বাবা। এরই নাম পিতৃ স্নেহ। প্রার্থনা করি এমন পরিণতি যেন আর কোন মানুষের না হয়। সকল সন্তান ও তাদের বাবা-মায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক। বাবা দিবসে বিশ্বের সকল পিতার প্রতি শ্রদ্ধা ও শুভকামনা।

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।