চিন্তার বিভ্রান্তি থেকে বের হতে না পারাই কি তবে অপরাধ?
পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির ধর্মব্যবসায়ীদের ধর্মাশ্রয়ী ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে বিতাড়িত করে একটি উদার ও অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার প্রত্যয়ে লাখ লাখ মানুষ জীবন দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিল। মানুষের সেই আত্মত্যাগকে মর্যাদা দিতে বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষকে যে সংবিধান উপহার দেন তাতে রাষ্ট্রীয় চার মূল নীতির একটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। বঙ্গবন্ধুকে প্রায় সপরিবারে হত্যা করে দেশকে পাকিস্তানি পথে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় এই ধর্মনিরপেক্ষতাকে ছুঁড়ে ফেলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সূচনা করে জাতির জনকের ঘাতকরা। এরপর থেকে একুশটি বছর জাতির উপর চেপে ছিল এই রাজনীতির কারিগররা।
১৯৯৬ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে এগিয়ে নেয়ার সুযোগ এসেছিল। তবে ২০০১-এ প্রবলবেগে তালেবানি ধরনের রাজনীতির আবির্ভাব দেশকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারিগরদের হাতে তুলে দেয়। ২০০৮ এ দেশবাসী জীবনের বিনিময়ে আবারো প্রত্যয় ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফেরার। যুদ্ধাপরাধের বিচারসহ একাত্তরের আদর্শে ফেরার বেশ কাজও হচ্ছিল লড়াই সংগ্রাম করে। কিন্তু আজ হঠাৎ করে রাজনীতির নতুন মেরুকরণ দেখছে দেশ। হঠাৎ করে ধর্মনিরপেক্ষতাকেই সব ধরনের রাজনীতির তাদের শত্রুতে পরিণত করেছে। অবস্থাটা এমন, মনেই হচ্ছেনা যে রাজনীতিতে আসলে কোন মেরুকরণ আছে। সব এক জয়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেন জাতির এক নম্বর সমস্যা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতাকে এতোদিন যারা গালি দিয়েছে তারাতো আছেই, আছে নতুন করে জন্ম নেয়া কিছু রাস্তার নেরি সারমেয়। এবার বাকি যারা ছিল, যাদের কাছে কখনোই প্রত্যাশা ছিলনা তাদেরও ক্ষোভের একমাত্র টার্গেট এই নিরস্ত্র যুক্তিবাদি ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ। আর এতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে উল্লসিত একাত্তরের পরাজিত শক্তিসহ নতুন গজিয়ে উঠা সেই তালেবানি গোষ্ঠি।
এমন একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে যে, ধর্মনিরপেক্ষতা শুধুই বামপন্থিদের রাজনীতি। সব দল আর গোষ্ঠি যখন একজোট হয়েছে তখন তাহলে বলতেই হয় ক্ষমতায় না থাকলেও এদেশে বামপন্থীরা রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রভাবশালী। সাম্প্রদায়িক চিন্তামুক্ত রাজনীতির একটা প্রয়োজন আছে। আর তার জন্যেই আলোকিত মানুষ এদের কথার গুরুত্ব দেয়। গুরুত্ব দেয়, কারণ এরা অন্যদের চেয়ে আলাদা, ছোট হলেও এরাই প্রথম প্রতিবাদী হয়। তাই কোন বিশেষ সময়ে, প্রয়োজনের সময় এদের ক্ষীণ কণ্ঠ চিন্তাশীল মানুষকে ভাবায়। তবে সময়টা এমনভাবে বদলে গেলো যে, এক সময়ের উদারপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোও আজ আচরণ করে দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক শক্তির মতো।
মানুষ মনে করে, বিশেষ করে নাগরিক সমাজ, যারা সমাজের চলার পথে বড় ভূমিকা রাখে, তারা ভাবে, রাজনৈতিক চিন্তার জায়গাটায় এরা মানুষের খোরাক জোগায়। কিন্তু এমন যদি অবস্থা হয় তাহলে মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষের রাজনীতির ভাবনা মুখ থুবড়ে পড়ে।
বামপন্থীরা সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী। কিন্তু তারাতো এদেশে কখনোই ক্ষমতায় ছিলনা, নিকট ভবিষ্যতে যাওয়ারও সম্ভাবনা নেই। কিন্তু তবুও এদেশে এখনো রাজনৈতিক অর্থনৈতিক চিন্তা, সরকারি কাজকর্ম কী উপায়ে ঠিক ভাবে, ভাল করে চলতে পারে, এবং দেশে যারা কোনরকম অর্থনৈতিক প্রগতির সুযোগ পান না, কীভাবে তাদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যের প্রসার করা যেতে পারে, কীভাবে তাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ানো যেতে পারে, এই আলোচনাগুলো তো বামপন্থীদেরই কাছ থেকেই আসে। যারা হঠাৎ করে ধর্মনিরপেক্ষতাকে আক্রমণ করছে তারা হয়তো বুঝতে পারছেনা সাম্প্রদায়িকতা বর্জিত সাধারণ রাজনৈতিক শক্তির প্রয়োজন আছে, তবে বামপন্থী চিন্তারও প্রয়োজন সাধারণ রাজনৈতিক শক্তিকে নাগরিকের পক্ষে রাখতে।
বামপন্থীরা অনেক দুর্বল।কেন এমনটা হলো সেই আলোচনা, সেই বিশ্লেষণ হতে পারে।কিন্তু আমাদের মূল্যবোধ চর্চাকারী নাগরিক সমাজের কাছে বামপন্থীরা যেসব ভাবনা তুলে ধরে সেসব এখনো অনেক প্রাসঙ্গিক। তাদের জীবনের সমস্যাগুলো হয়তো বামপন্থাতে সমাধানের চেষ্টা করেন না, কিন্তু আশ্বস্ত হন যে, এরা অন্যায়টা বলেনা, অন্যায় করেনা। বাম দর্শনের আমূল বাস্তবায়ন করতে এরা পারবেনা একথা সত্য, কিন্তু তারা যা বলে সবই কি উড়িয়ে দেয়ার মতো?
বাজার অর্থনীতির যে আগ্রাসী তত্ব কিংবা ধর্মভিত্তিক সহিংস শক্তির কাছে আত্ম-নিবেদনের রাজনীতির জবাবে নতুন চিন্তার আশা করে মানুষ। সরকার স্ব-উদ্যোগে এদেশের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ দিচ্ছে, স্বাস্থ্যসেবার কথা ভাবছে, বিধবা নারীর সামাজিক সুরক্ষার কথা ভাবছে, নারীর এগিয়ে যাওয়ার কথা বলছে। সরকারের সেই ভাবনার জায়গায় আরো কী করা উচিত, কী ভাবে করা উচিত, সে-সব বিষয়ে সুস্পষ্ট ও সাবলীল বক্তব্য সময়ের দাবি। তাই সেকথা কেউ বললেই, এমনকি ভুলভাবেও যদি উচ্চারণ করে, সে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হতে পারে কী?
জমির অধিকার, আদিবাসীদের অধিকার, নারী অধিকারের দাবি থেকে দূরে রাখা সম্ভব সেই মানুষকে যার ভেতরে কিছুটা হলেও মানবিকতা আছে? এসব মৌলিক দাবিই হতে পারে মানুষের নৈকট্য পাওয়ার বড় পথ। চিন্তার বিভ্রান্তি থেকে বের হতে না পারাই কি তবে অপরাধ? গরিব এবং বড়লোক, অবস্থাপন্ন এবং অবস্থাহীন, ক্ষমতাশীল এবং ক্ষমতাহীন, এমন ধারায় বিভক্ত সমাজে যা আশা করি তা পাওয়া যায় না, কিন্তু পাওয়ার আশা নিশ্চয়ই ছাড়া যায় না?
লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।
এইচআর/পিআর