হার্টের স্টেন্টিং ব্যবসা এবং হৃদয়ের যাতনা

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪:০১ এএম, ০৫ জুন ২০১৭

এখন অনেকেই হয়ত জেনে থাকবেন যে হার্ট অ্যাটাক হলে বা হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন এমন রোগীদের ক্ষেত্রে এনজিওগ্রাম নামক একটা পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। এনজিওগ্রাম করলে হার্টের রক্তনালীর কত শতাংশ ব্লক এবং সেটা কোন কোন রক্তনালীতে আছে তা সহজেই জানা যায়। সে অনুযায়ী তখন চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন যে, রোগীর হার্টে স্টেন্ট বা রিং লাগবে কিনা। অথবা স্টেন্টিং করা লাগলে তা কোথায় এবং কয়টা করতে হবে। যদিও অনেক ক্ষেত্রে বাইপাস সার্জারিও লাগতে পারে। সেটা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ।
রক্তনালীতে ব্লকের কারণে হার্টে রক্ত চলাচলে যে বাধার সৃষ্টি হয় সেটা স্টেন্টিং করলে দূরীভূত হয়। ফলে হার্ট অ্যাটাকের হাত থেকে রেহাই পাওয়া সহজ হয়। যেহেতু হার্ট অ্যাটাকের কারণে তাৎক্ষণিক মৃত্যু ঝুঁকি বেশি এবং স্টেন্টিং করলে সে ঝুঁকি থেকে রেহাই পাওয়া যায় ফলে এটা যে একটা ভালো ব্যবসাক্ষেত্র হতে পারে কিছু মানুষ সেটা খুব দ্রুত বুঝতে পারলো। আর সেটাকেই সম্বল করে তারা কোম্পানি খুলে হার্টের স্টেন্ট বা রিং স্বল্প দামে বিদেশ থেকে কিনে এনে লাখ লাখ টাকায় বিক্রি করতে শুরু করলো। এর ফলে জন্ম নিলো রোগীর পকেট কাটার এক অনৈতিক জমজমাট এবং তুঘলগি ব্যবসার। রোগীরা তাদের কাছে জিম্মি হয়ে গেলো। শোনা যায়, কিছু চিকিৎসক এবং হাসপাতালেরও নাকি তাতে সায় আছে। মিলেমিশে এ ব্যবসা তাই চলতে লাগলো দারুণ লাভজনক গতিতে।

কিন্তু সমস্যা হলো যখন আমাদের দেশের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর দীর্ঘদিন পর এমন গলাকাটা ব্যবসার লাগাম টেনে ধরতে চাইলো। সে লক্ষে ১১ এপ্রিল ১৭ তারিখে ১৭ সদস্যের একটা বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠিত হলো। খুব দ্রুততম সময়েই তারা স্টেন্টের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যও নির্ধারণ করে দিলেন। সেই সাথে স্টেন্টের প্যাকেটে তার দাম, ড্রাগ রেজি নং এবং মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ লিখতেও নির্দেশনা প্রদান করলেন। এর আগেই অবশ্য, জানুয়ারি মাসে ভারতের ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটি (এনপিপিএ) জীবন রক্ষাকারী এ স্টেন্টের দাম তাদের দেশে অর্ধেকে নামিয়ে ফেলবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। তারা স্টেন্টের সর্বনিম্ন দাম ২০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৪০হাজার রুপি করার চেষ্টা শুরু করে। কারণ, ভারতে হৃদরোগীদের প্রতিবছর প্রায় ১০ লক্ষ স্টেন্ট লাগে। আমাদের দেশে অবশ্য ১৮ হাজার স্টেন্ট বিক্রি হয় প্রতিবছর।

ভারতের যেখানে ৬টি কোম্পানি সে দেশে স্টেন্ট উৎপাদন করে সেখানে আমাদের দেশে কোন কোম্পানিই স্টেন্ট উৎপাদন করে না। তারা বিদেশ থেকে এগুলো আমদানি করে থাকে। দেশে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান বলছে, আমাদের দেশে ঔষধ প্রশাসনের অনুমোদপ্রাপ্ত মোট ২১ টি কোম্পানি ৪৭ রকমের স্টেন্ট আমদানি করে থাকে। সুখের বিষয় হচ্ছে, এগুলো আমদানিতে কোন ট্যাক্স লাগে না। ফলে এগুলোর দাম কোনভাবেই আকাশছোঁয়া হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এতদিন বাস্তবতা ছিলো ভিন্ন। কোম্পানি এবং হাসপাতালভেদে এগুলোর দামে ব্যাপক তারতম্য দেখা যেতো।

সে যাই হোক, প্রশাসনের চেষ্টায় যখন স্টেন্টের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে মর্মে খবর প্রকাশিত হলো তখন কোম্পানিগুলো এর প্রতিবাদে গত ১৯ এপ্রিল ১৭ ধর্মঘটের ডাক দেয় যা সমস্ত গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয়। তখন ভেবেছিলাম যে, যেহেতু অনেক সময় দেখা যায় এ ধরনের অনৈতিক চাপের কারণে সরকারকেই ছাড় দিতে হয় বা আপোসকামী হতে হয় সেহেতু প্রশাসনের একটা শুভ উদ্যোগ মনে হয়ে ভেস্তে যেতে বসেছে ( যেভাবে অনেক ভালো উদ্যোগও পরে আর আলোর মুখ দেখে না!)। তবে আনন্দের ব্যাপার হলো যে, এক্ষেত্রে কিন্ত তা হয়নি। জনবান্ধব এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রশাসন অত্যন্ত কঠোর হয়েছে। এ প্রচেষ্টা তাই দ্বিধাহীনভাবে সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।

নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে জনবান্ধব এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হওয়ায় সাধারণ মানুষের উপকার হলেও বরাবরের মতোই উচ্ছিষ্টভোগী কমিশনখোর আর অতি মুনাফালোভীরা মনে মনে যে দারুণ অসন্তোষ্ট ছিলো তা বুঝে নিতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। কথায় আছে দুর্জনের ছলের অভাব হয় না। এখানেও এখন অবধি স্টেন্টের দাম কম নিলেও নানা রকম ছলাকলা দেখিয়ে রোগীর পকেট থেকে যেন শেষ অবধি মোটা অংকের টাকা বের করে নেয়া যায় নতুন করে নাকি সে চেষ্টা শুরু হয়েছে। দাম নির্ধারণ করে দেয়ার ১ মাস পরে এমনতর অশুভ চেষ্টার খবর দেখেই আমি আবারও আতংকগ্রস্ত হয়েছি। আমার সে আতংক বা আশংকা দুটোই যেন শেষ অবধি মিথ্যে প্রমাণিত হয় মনেপ্রাণে সে কামনাই করি।
‘স্টেন্টের নির্ধারিত মূল্যের সুফল নিয়ে সংশয়’ শিরোনামে গত ২৭ মে দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবরে তেমন উদ্বেগের কথা জানানোই হয়েছে। সে প্রতিবেদনে স্টেন্টের দাম কমানোর খবর অনেক রোগীই জানে না বলে জানানো হয়েছে। আবার স্টেন্টের দাম ঠিক রেখেও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ বেশি দেখিয়ে চিকিৎসা ব্যয় বাড়ানোর জন্য অনেক হাসপাতাল চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ প্রকাশিত হয়েছে।

অন্যদিকে ১৯ মে তারিখে দৈনিক যুগান্তেরে প্রকাশিত খবরের শিরোনাম ছিলো ‘ হার্টের রিংয়ের দাম কমানোর পরেও কমিশন দাবি’। এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, আমদানিকারক কোম্পানিগুলোর কাছে অনেক হাসপাতাল স্টেন্ট কেনার সময়ে কমিশন দাবি করছে। কমিশন না দিলে তারা স্টেন্ট কেনা থেকেও বিরত থাকছে। কোম্পানিগুলো ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে গণশুনানিকালে এ অভিযোগ করেছে। এ তো দেখছি ভয়াবহ ব্যাপার! এখনই এ ব্যাপারে জরুরি ব্যবস্থা নেয়া তাই সময়ের দাবি।

মুনাফালোভী এবং কমিশনখোর চক্রের বিরুদ্ধে অনড় অবস্থানে থেকে প্রশাসন যেন তার এ জনবান্ধব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সজাগ ও সচেষ্ট থাকে-সে আশা করছি। কারণ কোনভাবেই ভদ্রবেশী এ দুষ্টচক্র যেন আর সাধারণ মানুষের পকেট থেকে অহেতুক টাকা হাতিয়ে নিতে না পারে সে ব্যাপারে জনগণকেও সচতন করা জরুরি বলে মনে করি। যেখানে প্রয়োজন হবে (খাতওয়ারি দেখে দেখে) সেখানেই কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ করে স্বাস্থ্যখাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। তাহলেই সাধারণ মানুষ প্রকৃত অর্থেই উপকৃত হবে। আর তখনই কেবল তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে।

লেখক : চিকিৎসক।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।