পাহাড়ে আগুন : স্থায়ী সমাধান জরুরি


প্রকাশিত: ০৪:০৩ এএম, ০৪ জুন ২০১৭

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতায় কাশীর মহিষী শীতে কিছুটা উত্তাপ পেতে দরিদ্র প্রজার গৃহে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। পরে গৃহহীন প্রজা রাজার কাছে অভিযোগ করলে রাজা তার মহিষীকে তলব করে জানতে চান কেন এই হীন আচরণ। রানী উত্তরে বলেন, ‘গেছে কত কটি জীর্ণ কুটির, কতটুকু ক্ষতি হয়েছে প্রাণীর? কত ধন যায় রাজমহিষীর এক প্রহরের প্রমোদে।’ ছোটবেলায় পড়া কবিতাটি নতুন করে মনে পড়লো লংদুর আগুনের খবরটি পড়ে।

আবার পাহাড়ে সমস্যা। এবার লংদুতে আগুন। যুবলীগ নেতার মৃত্যুর ঘটনায় রাঙামাটিতে পাহাড়ীদের শতাধিক বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ লোকজন। পাহাড়ে এমনিতেই সমস্যার শেষ নেই। সেসব সমস্যার দিকে ঢাকার সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে সরকার পর্যন্ত যতই চোখ বন্ধ করে থাকুক না কেন, সমস্যাগুলো কিন্তু চলছেই। মনে রাখতে হবে অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না আর নগর পুড়লে দেবালয়ও বাকি থাকে না।

পাহাড়ে যে অশান্তি চলছে তার স্থায়ী সমাধান এখন সময়ের দাবি। পাহাড়ে মূল সমস্যা হলো সেটেলার বাঙালি ও সেখানকার আদিবাসী পাহাড়ি জনগোষ্ঠির মধ্যে স্বার্থের সংঘাত। পাহাড়িরা চায় তাদের বাপ-দাদার ভিটেবাড়ি ও জমিতে তারাই বসত করবে। এই দাবি অন্যায্য নয়। অনেক ক্ষেত্রে বংশানুক্রমে বাস করে আসা এসব জমির পর্চা, দলিল ইত্যাদি তাদের কাছে নেই। পাহাড়িরা মূলত সহজ সরল। তারা এত জমির আইনী অধিকারের মারপ্যাঁচ বোঝে না। সেটেলার বাঙালিরা দলিল করে সেখানে বাস করছে এবং পাহাড়িদের অধিকার প্রায়শই হরণ করছে। এই সমস্যা আজকের নয়। সেই ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল থেকেই এই সমস্যা চলছে। পাহাড়িদের জমি ও রাজপ্রাসাদ ডুবিয়ে দিয়ে কৃত্রিমভাবে কাপ্তাই লেক তৈরির পর থেকে এ সমস্যা ধীরে ধীরে বাড়ছেই।

স্বাধীনতার পরও এ সমস্যার পুরোপুরি সুষ্ঠু সমাধান কখনও হয়নি। বরং দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৫০০০ এর মতো সেটেলারকে জিয়াউর রহমানের আমলে পাহাড়ে স্থাপন করা হয়। এরপর সব সরকারের আমলেই সমস্যাগুলো বেড়েছে বৈ কমেনি। পরে অবশ্য শেখ হাসিনার আমলে শান্তিচুক্তি হয়েছে, পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কিন্তু ‘সকলি গরল ভেল’। সমস্যার পুরোপুরি সমাধান হয়নি।

পাহাড়িদের উপর যে নির্যাতন নিপীড়ন চলছে তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন হয় না। তাদের বংশানুক্রমে বাস করা জমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে, প্রায়ই যে কোন ছুতায় তাদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হচ্ছে, তাদের নারীদের উপরও চলছে ধর্ষণ, অপহরণ, নিপীড়ন। কোনো সভ্য দেশের বিবেকবান মানুষ এগুলো সমর্থন করতে পারে না। পাহাড়ে অনেকটা জোর যার মুল্লুক তার অবস্থা। এই অবস্থায় কিন্তু ক্ষোভের বারুদ স্বাভাবিকভাবেই পাহাড়ি জনগোষ্ঠির মনে জমা হচ্ছে। এই বারুদের বিস্ফোরণ হবে খুবই ভয়াবহ। পুরো দেশকে কাঁপিয়ে দিতে পারে এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।

অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবার আগেই প্রয়োজন বিষয়টির সুষ্ঠু ও স্থায়ী সমাধান। পাহাড়িদের এবং পাহাড়ে অবস্থানরত সকল মানুষের সমস্যাগুলো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা প্রয়োজন। পাহাড়ি-বাঙালি উভয় পক্ষের অভিযোগই গুরুত্ব দিয়ে শুনতে হবে। এক তরফাভাবে নয় বরং উভয়ের প্রতিই ন্যায়বিচার করতে হবে।

পাহাড়ি জনগোষ্ঠি বাংলাদেশের নাগরিক। যে কোন নাগরিকের মতো তাদের পূর্ণ অধিকার রয়েছে জীবন ধারণের এবং সম্পত্তি ভোগ দখলের। তাদের সেই অধিকার থেকে কোনভাবেই বঞ্চিত করা চলবে না। পাহাড়ে এমনিতেই অনেক সমস্যা। অবকাঠামোগত উন্নয়ন দরকার। দরকার পাহাড়িদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার, দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচি এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। পার্বত্য জেলাসমূহ তো বাংলাদেশের বাইরে অবস্থান করে না। বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে পার্বত্য জেলাসমূহের টেকসই উন্নয়নও নিশ্চিত করতে হবে।

বাঙালি ও পাহাড়ি সকলেই বাংলাদেশের নাগরিক। প্রত্যেক নাগরিকের সকল প্রকার মানবাধিকার ও সংবিধানসম্মত অধিকার রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। মুক্তিযুদ্ধে পাহাড়িরাও অংশ নিয়েছেন, বাঙালিদের পাশে থেকেছেন। তাদের মধ্যে বীরপ্রতীক খেতাবও পেয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তাহলে পাহাড়িদের উপর জুলুম নির্যাতন কেন চলবে? কেন তাদের উচ্ছেদ করা হবে বংশানুক্রমিক বাসভূমি থেকে? কেন তাদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হবে? কেন হত্যা করা হবে তরুণদের, ধর্ষণ করা হবে নারীদের?

বাংলাদেশ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। এই দেশে সকল নাগরিক মিলেমিশে শান্তিতে বাস করা যায় না কি? পার্বত্য জেলাগুলোতে অশান্তির আগুন জ্বলছে। সে আগুন জ্বালিয়ে রেখে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। পাহাড়ের দিকে অবিলম্বে সরকারকে নজর দিতে হবে। পাহাড়ি জনগণের অধিকার রক্ষায় সরকারি-বেসরকারি সকল সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে। শোনা যায় রোম যখন পুড়ছিল নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। লংদুর আগুন যখন পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে অসহায় পাহাড়ি জনগণের বসতবাড়ি, তাদের শেষ সম্বল, তখন কি চুপ করে থাকা শোভা পায়?

আমরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা জাতি। আমরা যে কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে জানি। আজ পাহাড়ি ভাইবোনের উপরে যে নিপীড়ন, নির্যাতন চলছে তারও প্রতিবাদ হওয়া প্রয়োজন। পাহাড়ি জনগোষ্ঠির সমস্যা স্থায়ীভাবে সমাধান করতে হবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে। সমাধান করতে হবে অতি দ্রুত। এই দাবি আজ সকল সচেতন নাগরিকের।

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।