বাজেট ২০১৭-১৮: প্রত্যাশিত দুঃসংবাদ
নির্বাচনের বছরে ভোটের বাজেট দিতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী শেষ পর্যন্ত এক ভ্যাটের বাজেট উপহার দিলেন জাতিকে। যত উপায় আছে সব পন্থায় মানুষের পকেট থেকে টাকা বের করে নেয়ার এক বিরাট দলিল এবারের বাজেট। বিগত বছরের বাজেটের সংশোধিত আকারই বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি, তবুও আরো বড়, ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক দক্ষতা বিচারে এই বাজেটকে শেষ পর্যন্ত সবাই বাস্তবায়ন অযোগ্যই বলছেন।
এ মুহূর্তে বাংলাদেশের সমস্যা হলো তার সম্ভাবনা প্রচুর, কিন্তু সেই সামর্থ্যের ধারে কাছে যেতে তার সমস্যার অন্ত নেই। তার ব্যয়ের তৃষ্ণা প্রচণ্ড, কিন্তু তার আয়ের পথ সীমিত। দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সর্বজনীন উন্নয়নের জন্য উঁচু বৃদ্ধির হারের কক্ষপথে পৌঁছানো প্রয়োজন। আর তার জন্য ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটটির লক্ষ্য কী? বলা সত্যিই মুশকিল। তবে একটা ব্যাপারে সন্দেহ নেই অর্থমন্ত্রীর একটা প্রধান লক্ষ্য ছিল এই নির্বাচনী বছরে জনতুষ্ঠির চেষ্টা করা। লক্ষণীয় যে, এবারের বাজেট ভাষণের সময় সংসদে বিশেষ কোনও শোরগোল ওঠেনি, কারণ সংসদে কোন কার্যকর বিরোধী দল নেই।
অর্থমন্ত্রী ভোটের বাজেট চান, আবার ভ্যাটও চেয়েছেন। তাই কথা দিয়েও শেষ পর্যন্ত মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট শত আপত্তি সত্বেও ঢালাও ১৫ শতাংশে নিয়ে গেছেন। যেদিন বাজেট দিলেন সেদিনই গ্যাসের দাম বাড়িয়েছেন, আর ১৫ শতাংশ ভ্যাট করায়, বিদ্যুতের বিল এখন আমরা যা দিচ্ছি তার চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি দিতে হবে। সীমিত আয়ের মানুষকে কোন ছাড় দেননি। এমনিতেই সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী ছাড়া আর সব মানুষের আয় কমেছে। নতুন করে পরোক্ষ করে চাপ বাড়বে জীবনযাত্রার ব্যয়ে, প্রকৃত আয় আরো কমবে।
গত বছরের মূল বাজেটের ১৭.৫ শতাংশ এবং সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ২৬ শতাংশ বড় এই বাজেটের জন্য অর্থসংস্থান করতে ৩৪ শতাংশ বেশি রাজস্ব সংগ্রহের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত রাজস্ব আয়ে পরোক্ষ কর প্রত্যক্ষ করের দ্বিগুণ নির্ধারণ করা হয়েছে। তার অর্থ হলো এই বাজেট বাস্তবায়ন হওয়া মানে, রাজস্ব ব্যবস্থা আরো বেশি নিবর্তনমূলক হলো। ঢালাও ১৫ শতাংশ ভ্যাটসহ পরোক্ষ কর থেকে এই বর্ধিত রাজস্ব আদায়ের যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা সকল পণ্য ও সেবার দাম বাড়াবে। এমনিতেই বর্তমানে খাদ্য পণ্যের দাম, বিশেষ করে মোটা চালের দাম অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিত্তবানদের উপর ধার্য্য প্রত্যক্ষ কর একই পর্যায়ে রাখা হয়েছে, কর রেয়ার অব্যাহত রাখা হয়েছে, অপ্রদর্শিত কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ রাখার মাধ্যমে দুর্নীতিকে মেনে নেয়া হয়েছে।
এবারের বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ স্মরণকালের সর্বোচ্চ। ঘাটতির পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকারও বেশি। এই অর্থের বেশিরভাগ খরচ হবে পূর্বেকার ঋণ পরিশোধ, শ্বেতহস্তির মতো বিশাল সিভিল-মিলিটারি প্রশাসনের রক্ষণাবেক্ষণ, অপচয়, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন প্রকারের সিস্টেম লস, কর-রেয়াতের নামে ধনিক শ্রেণিকে বিশাল ভর্তুকি প্রদান ইত্যাদি কাজে।
কিছু ক্ষেত্রে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দিয়ে সম্পূরক শুল্ক বসানো হয়েছে বিভিন্ন পণ্যের ওপর। শুল্ক কাঠামোর পুনর্গঠন করে বড় রাজস্ব আদায় করবার টার্গেট দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। আগামী অর্থবছরে এই টার্গেটের পরিমাণ ২ লক্ষ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। এই বিশাল অংকের টাকা আদায় করে ২ লক্ষ ৩৪ হাজার ১৩ কোটি টাকার অনুন্নয়ন ব্যয় মেটাবেন তিনি। লক্ষণীয় যে, অনুন্নয়ন ব্যয় উন্নয়ন ব্যযের চেয়ে কম। এর কারণ হলো সরকার সরকারি চাকুরীজীবীদের বেতন দ্বিগুণেরও বেশি বাড়িয়েছেন। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লক্ষ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। বলাবাহুল্য চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মাত্র ৫২ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে।
গত কয়েক বছর থরেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছেনা। এমনকি সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রাও যখন ধরাছোঁয়ার বাইরে তখন আগামী বছরে নির্বাচনী ডামাডোলে কতটা পারঙ্গমতা দেখানো সম্ভব, তা কেবল অর্থমন্ত্রীই বলতে পারবেন।
অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, বছরের যেকোনো সময় ব্যাংক হিসাবে ১ লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা জমা দিলে বা তুললে ৮০০ টাকা আবগারি শুল্ক কেটে রাখা হবে। আগে রাখা হতো ৫০০ টাকা। একইভাবে, ১০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত কোনো হিসাবে জমা দিলে বা ওই হিসাব থেকে তুললে ২ হাজার ৫০০ টাকা কেটে রাখা হবে। আগে এ সব হিসাব থেকে রাখা হতো ১ হাজার ৫০০ টাকা। ১ কোটি থেকে ৫ কোটি টাকা হিসাবে থাকলে ১২ হাজার টাকা কেটে রাখা হবে। এসব হিসাব থেকে আগে কেটে রাখা হতো ৭ হাজার ৫০০ টাকা। ৫ কোটি টাকার বেশির ক্ষেত্রে কেটে রাখা হবে ২৫ হাজার টাকা, যা আগে ছিল ১৫ হাজার টাকা। ব্যাংকে টাকা জমায় মধ্যবিত্ত ও চাকুরীজীবীরা - কারণ এটা ছাড়া তাদের ক্ষুদ্র আমানত জমা রাখার অন্য কোন নিশ্চিত ব্যবস্থা এদেশে নেই । তাঁদের এই জমানো টাকা বিগত কয়েক বছর যাবত লুটে খাচ্ছে ঋণখেলাপীরা। দুর্বিনীত লুটের দরুন ব্যাংকের মূলধনে যে ঘাটতি হলো তা আবার ২০১০ সন হতে ফিবছর জনগণের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে পূরণ করা হচ্ছে এবং এবারো ২০০০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। লুটপাট আর খেলাপী ঋণের কারণে সরকারি ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে গেছে। আর কিছু পরিবার ও ব্যক্তির কারণে বেসরকারি ব্যাংকগুলোও আজ ধ্বংসের পথে।
অর্থমন্ত্রী আবারো ৭.৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করেছেন। চলতি অর্থবছরের ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির দাবি নিয়েও বিতর্ক আছে। কারণ যে পরিমাণ বেসরকারি বিনিয়োগ প্রয়োজন, গত নয় বছরে তা দেখা যায়নি। বেসরকারি বিনিয়োগ আটকে আছে জিডিপি’র ২২/২৩ শতাংশের ঘরে। ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছেনা। যা হচ্ছে তা মূলত অনানুষ্ঠানিক খাতে। প্রবৃদ্ধির দুই চালক, অর্থাৎ রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ, দুই জায়গায়ই টান পড়েছে। তাই নতুন প্রবৃদ্ধি কী করে হবে আর সেই প্রবৃদ্ধির নতুন চালিকা শক্তি কি হবে তা পরিষ্কার হয়নি অর্থমন্ত্রীর বাজেট প্রস্তাবনায়।
চলতি বছরের বাজেটও সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। তাই যত বড় আকারের বাজেটই দেয়া হোক না কেন, বাস্তবায়ন না করতে পারলে কেন আকার বাড়িয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলা হচ্ছে? এবারের বাজেটে দেশের অর্থনীতিতে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবার শক্তি সঞ্চয়ের কি নির্দেশনা দিলেন অর্থমন্ত্রী তা শুধু তিনিই জানেন। আকার বড়, ঘাটতিও বিশাল। চলমান বিনিয়োগ খরা কাটিয়ে আসছে বছরটি উৎপাদনমুখি হওয়ার কোন দিশাও পাওয়া গেলোনা। তাই বলা যায় বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জটা থেকেই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের টানা এই নবম বাজেটেও।
লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।
এইচআর/জেআইএম